অভূতপূর্ব গণ জাগরণ! ইতিহাস তৈরির রাতে আরজি করে নিকৃষ্ট ষড়যন্ত্র
নিজস্ব প্রতিনিধি: ইতিহাস তৈরি হল বাংলার বুকে। শেষ কবে বাড়ির মহিলারা এইভাবে বেরিয়ে এসে আন্দোলনকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, পরিচালনা করেছেন এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে নিজেদের ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন তার নজির মেলা ভার। কোনও রাজনৈতিক দলের ব্যানার ছাড়াই বাংলার বুকেও এমন গণজাগরণ যে ঘটতে পারে তা দেখিয়ে দিল ১৪ অগস্টের রাত। বাংলার মানুষ স্বাধীনতা দিবস উদযাপন করলেন মধ্যরাতে রাস্তায় দাঁড়িয়ে। দিকে দিকে, পথে পথে মধ্যরাতেও দৃপ্ত কন্ঠে সোচ্চার হতে দেখা গেল হাজারে হাজারে মানুষকে।
গণ জাগরণ ঘটলে তার ছবিটা কেমন হয় সেটা দেখিয়ে দিল বাংলার মানুষ। অপরাধীদের শাস্তির দাবির পাশাপাশি প্রশাসনের অপদার্থতা ও অপরাধ লুকনোর ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধেও সোচ্চার হয়ে উঠলেন মহিলারা। এই আন্দোলনে মহিলারা অগ্রণী শক্তি হিসেবে সর্বত্রই নেতৃত্ব দিয়েছেন। তাঁদের সহযোগী শক্তি হিসেবে হাজির ছিলেন পুরুষরা। তবে দু-একটি জায়গা ছাড়া গোটা আন্দোলনের রাশ বাংলার মা-বোনেদের হাতেই দেখা গিয়েছে।
বাংলার জনগণের বিশেষত নারী শক্তির এই অভূতপূর্ব একতাবদ্ধতা শাসকের, অপরাধীদের বুকে কাঁপুনি ধরিয়ে দিতে বাধ্য। আরজি করে নৃশংসভাবে মহিলা চিকিৎসককে হত্যা করার ঘটনায় সরাসরি শাসকদলের যোগ আছে এমনটা এখনও পর্যন্ত কোথাও শোনা যায়নি। কিন্তু প্রশাসন এবং শাসকদলের একাংশ যেভাবে প্রধান অপরাধীদের আড়াল করার চেষ্টা করছে তা বিস্মিত করেছে সকলকে। এই ঘটনাই বুঝিয়ে দিয়েছে বর্তমান সরকারের আমলে বহু ক্ষেত্রে অপরাধীরা একটা স্বস্তির জায়গা পেয়ে যাচ্ছে। বিশেষত আরজি করের এই নৃশংস ঘটনায় সঞ্জয় বলে যে ব্যক্তিকে আটক করা হয়েছে সে এককভাবে যে এই গোটা কাণ্ডটি ঘটাতে পারে না তার দিনের আলোর মত পরিষ্কার। জনগণ মোটেও কলকাতা পুলিশের এই দাবি বিশ্বাস করছে না।
এই পরিস্থিতিতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রথমে বেশ কিছু সদর্থক বার্তা দিয়েছিলেন। তিনি পুলিশকে পর্যন্ত সঠিকভাবে তদন্ত করার কথা বলেছিলেন। কিন্তু আরজি কর মেডিকেল কলেজের সদ্য প্রাক্তন অধ্যক্ষ সন্দীপ ঘোষকে যেভাবে একবেলার মধ্যে ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ করে পুরস্কৃত করা হল তাতে মুখ্যমন্ত্রী সহ গোটা রাজ্য প্রশাসনের ভাবমূর্তি তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। বাংলার আমজনতা কিন্তু আর প্রশাসনকে ভরসা করতে পারছে না। তারই ফলশ্রুতিতে ১৪ অগস্টের রাতে রিক্লেইম দ্য নাইট কর্মসূচি পালিত হল রাজ্যজুড়ে।
কিন্তু কলকাতা সহ প্রতিটি জেলায় যখন রাত দখলে নারীদের এই কর্মসূচি পালিত হচ্ছে ঠিক সেই সময় আরজি কর হাসপাতালে ঘটে যায় ভয়াবহ দুষ্কৃতী হামলা। হাসপাতালের এমার্জেন্সি বিভাগে একটিও জিনিস আর আস্ত নেই। সেই সঙ্গে ইএনটি বিভাগ সহ আরও বেশ কিছু জায়গায় তাণ্ডব চালায় ৪০-৫০ জন দুষ্কৃতী। আশ্চর্যজনকভাবে পুলিশের নাকের ডগাতেই গোটা কাণ্ডটি ঘটে। কিন্তু সেই ভাবে বাধা না দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে কলকাতা পুলিশের বিরুদ্ধে। আর এখানেই তীব্র হচ্ছে সন্দেহ ও সংশয়।
শুধু যে হাসপাতালে তাণ্ডব চলেছে তাই নয়, হাসপাতালের গেটের সামনে আন্দোলনকারীদের যে মঞ্চ ছিল সেটাও ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে এই দুষ্কৃতীরা। প্রাথমিকভাবে কলকাতার পুলিশ কমিশনার গোটা ঘটনার দায় কার্যত শান্তিপূর্ণ আন্দোলনকারীদের উপর চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। শাসক দলের পক্ষ থেকেও আন্দোলনকারীদের দিকে আঙুল তোলা হয়। কিন্তু ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী থেকে শুরু করে অন্যান্যদের থেকে জানা গিয়েছে, গোটা বিষয়টাই আন্দোলন বহির্ভূত একটি বহিরাগত শক্তির দ্বারা ঘটেছে। এই নিয়ে মধ্যরাত থেকেই উত্তাল সোশ্যাল মিডিয়া। আমজনতার বেশিরভাগ অংশের অভিযোগ, এই হামলা, ভাঙচুর চালিয়েছে শাসকদলের মদতপুষ্ঠ দুষ্কৃতীরা।
কে হামলা চালিয়েছে তা তদন্তের মাধ্যমে ভবিষ্যতে জানা যেতে পারে। কিন্তু প্রাথমিক ঘটনাক্রম থেকে সন্দেহটা শাসক পক্ষের দিকেই চলে যাচ্ছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, আমজনতার এই গণ-আন্দোলনে চাপে পড়ে গোটা নজর অন্যদিকে ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতেই পরিকল্পিতভাবে আরজি কর হাসপাতালে হামলা করা হয়েছে। সেই সঙ্গে অনেকে এর মাধ্যমে তথ্য প্রমাণ লোপাটের আশঙ্কাও প্রকাশ করেছেন। যদিও তেমন কিছু হয়েছে বলে জানা যায়নি।
সব মিলিয়ে আরজি কর কাণ্ডের প্রভাবে হঠাৎ করেই বিপুল চাপে শাসক দল তৃণমূল কংগ্রেস। অবশ্য নানাভাবে এই ঘটনার যে প্রতিবাদ চলছে সেটিকে অরাজনৈতিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা চলছে শাসকদের পক্ষ থেকে। যদিও সেই চেষ্টা এখনও পর্যন্ত ততটা ফলপ্রসু হয়নি। বরং হাসপাতালে রাতের তাণ্ডব মানুষকে আরও ক্ষুব্ধ, বিচলিত করে তুলেছে। ২০২৪ এর লোকসভা ভোটে বিপুলভাবে জয়লাভের পর তবে কি হঠাৎই চাপে পড়ে গিয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়?
এইসব প্রশ্নের উত্তর আপাতত সময়ের হাতে।