২০২১ বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক কথা….
পার্থ প্রতিম বিশ্বাস, সম্পাদক, প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি
এ বাংলায় তৃনমূল দল সরকারী ক্ষমতায় আসার সময় রাজ্যের ঘাড়ে মোট ঋণের পরিমাণ ছিলো ২ লক্ষ কোটি টাকার মতো। শোনা কথা, সেই সময়ে প্রণববাবু মমতা ব্যানার্জীকে বলেছিলেন, আগে রাজ্যের ঘাড়ে চেপে থাকা সেই ঋণ শোধ করতে। সেই সঙ্গে যতটা সম্ভব উন্নয়ন হয় হোক। তাতেই বঙ্গবাসী মমতার নাম চিরকাল মনে রাখবেন।
কিন্তু কংগ্রেসে থাকাকালীন দলের ভেতরে বিরোধী এবং রাজ্য রাজনীতিতে বিরোধিতা করেই যার মূল পরিচিতি, সেই মমতা ব্যানার্জী মোটেও সেসব কথায় কান দেননি। বদলে লোক দেখানো কাজের নামে ত্রিফলা আর নীল সাদা দূর্নীতি দিয়েই তার সরকারের কাজ শুরু হয়।
আসলে কাছের লোকেদের পকেট ভরার সুযোগ করে দিতেই তিনি এই পদ্ধতি চালু করেন। সেই সঙ্গে দলকে দিগন্ত বিস্তৃত করতে গিয়ে দুনিয়ার চোরেদের দলে টেনে ‘তৃণমূল’ আর ‘চোর’ শব্দদুটো কখন যে সমার্থক করে দিয়েছেন সেটা নেত্রী নিজেও টের পাননি।
একের পর এক চীটফান্ড কেলেংকারী, তোলাবাজি, সিন্ডিকেট, কাটমানি, মাস্তানির ঘটনা ঘটেছে। চাকরীর পরীক্ষায় লক্ষ লক্ষ টাকা ঘুষ দিয়েই নিয়োগ পত্র মিলেছে। অটো টোটো এমনকি রিক্সা চালাতে হলেও ল্যাম্পপোস্টদের দেদার খুশি করতে হয়েছে। সামান্যতম সমস্যা দুর করতে গিয়েও এই ল্যাম্পপোষ্টরা সমস্যার মূল্য কষে তার পার্সেন্টেজ চেয়ে নিয়েছেন।
গত দশ বছরে এ বাংলার ঋণের পরিমান বাম আমলের ২ লক্ষ কোটির দ্বিগুনেরও বেশী হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতেও চমকধমক দিয়ে বেশ চলছিলো শাসন-শোষণের রাজত্ব। কিন্তু বাধ সাধলো ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচন।
বেশ কিছু কাটমানিখোর ধান্দাবাজ দল বদলে হাত শক্ত করলো অসভ্য বর্বর একটি দলের। বিপুল অর্থের যোগান এবং ৩৪ বছরের ক্ষমতা থেকে সরানোর প্রতিশোধ নিতে বামেদের ২৩ শতাংশের আশীর্বাদে ফুলেফেঁপে উঠলো বিজেপি নামক দলটি।
তৃণমুলের একাংশও যে ওই দলে জুটেছে, সে কথাটাও উল্লেখ করা উচিৎ ছিলো, তবে সত্যি বলতে “তৃণমূলী ভোটার” এই কথাটা বলার সময় কখনোই আসবেনা। কারণ ব্যাক্তিতান্রিক সংগঠনে ব্যাক্তির ক্ষমতা চলে গেলেই সংগঠনের প্রাণ উবে যায়। ফলে, মমতার ক্ষমতা যতক্ষন তৃনমূল ততক্ষণ।
ইতিমধ্যেই লক্ষাধিক ধান্দাবাজ মমতার ছবিকে মুখোশ করে শুধু যে কোটিপতি হয়েছে তাই নয়, ওরা পুরো ব্যাবস্থাটাই উল্টে দিয়েছে। বাম আমলেও রাজনৈতিক রঙ দেখে শিক্ষক থেকে উপাচার্য, সব নিয়োগই হয়েছে কিন্তু টাকা দিলে শিক্ষকের চাকরী পাওয়া যায়, যবে থেকে এই মতবাদ চালু হয়েছে তবে থেকেই চিরকালীন শ্রদ্ধার পাত্র ‘শিক্ষক’ শব্দটার সম্মান বলে আর কিছু পড়ে নেই।
এ বাংলার বাবা মায়েদের জিনগত রোগ বা স্বপ্ন হলো, তার ছেলে মেয়েকে ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার অথবা শিক্ষক তৈরি করবেন। ডোমিসাইল বি সার্টিফিকেট নিয়ে এ বাংলা থেকে গত ৮-৯ বছরে যেসব ডাক্তাররা পাশ করেছেন তারা বাস্তবে কি হয়েছেন তা কেবল ঈশ্বরই জানেন।
চাকরীর বাজার শেষ হয়ে যাওয়ায় বাম আমলের শেষ দিক থেকে বাংলা জুড়ে তৈরী হওয়া গাদাগাদা বেসরকারী ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ আজ ভূত বাংলোতে পরিনত। তাই সুযোগ পেলেই এ বাংলার শিক্ষিত অশিক্ষিত সকলেই আজ ‘পরিযায়ী’।
আর এভাবেই যেমন এ বাংলায় তৃণমূল শাসনের ১০ বছর হল। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচন হতেও আর সামান্য কয়েক মাস বাকী। এতদিন মমতা ব্যানার্জী যে সমস্ত চোরেদের আড়াল করেছেন, দেদার টাকা কামানোর সুযোগ করে দিয়েছেন, ২০১৯ সালের পর আবারও তাদের একাংশ বেসুরো গাইতে শুরু করেছেন।
এমনকি আদর করে যে দুধের ছানা ভাইপোকে তিনি দুবার সাংসদ করলেন, শোনা যায় সেই ভাইপোর ভাঁড়ারেও নাকি হাজার কোটির তহবিল। একথাও শোনা যাচ্ছে যে, তার দলের অন্তত ১০ জন মন্ত্রী নাকি দলবদল করবেন। এর সাথে যুক্ত হতে পারেন বেশ কিছু বিধায়ক সহ অসংখ্য ছোটোবড়ো ল্যাম্পপোষ্ট।
এবারে কি করবেন মমতা ব্যানার্জী ? যদি তিনি মনে করেন, ‘ওরা তো আমার ছবি বেচেই বড়োলোক হয়েছে, আমার ছায়া সরে গেলেই মুখ থুবড়ে পড়বে’, তাহলে তিনি ভুল রাস্তায় হাঁটছেন। কারণ,
১) যেদিন ওরা মমতা ব্যানার্জীর ছায়ার তলায় এসেছিলো সেদিন ওরা ছিলো কপর্দকশূন্য। আজ ওদের ট্যাঁক বেশ টসটসে। সেই সাথে যন্ত্রপাতি ও লাইনঘাটেরও কোনো অভাব নেই।
২) ইতিমধ্যেই মমতা ব্যানার্জীর সততার মূর্তিসহ যাবতীয় চিহ্ন ভেঙে চুরমার হয়ে গিয়েছে, তাই নতুন করে ওনার আর কিছুই দেওয়ার নেই।
৩) যদি ওরা বিজেপি দলের কাছে নিজেকে বিক্রি করে দেয় তাহলে যে পরিমান হনুমানের উৎপাত শুরু হবে তা মমতা ব্যানার্জীর সাজানো সস্তার বাগান উপড়ে ফেলতে মুহুর্ত সময়ও নেবেনা।
সরকারে নেই দরকারে আছি….
একথা সত্যি যে, মমতা ব্যানার্জীর জন্যই ওদের যাবতীয় রমরমা। কিন্তু আজ ওরাও বেশ শক্তিশালী। জাতীয় কংগ্রেসে থাকাকালীন দীর্ঘ বছর মমতা ব্যানার্জী সোমেন মিত্র বা সুব্রত মুখার্জিদের নেতৃত্বে কাজ করেছেন। সেদিন ওরাও ভাবেননি, একদিন মমতা ব্যানার্জী ওদের ছাপিয়ে ক্ষমতার সিঁড়ির ওপরতলায় উঠে যাবেন। তাই কাউকেই ছোটো ভাবার সুযোগ নেই।
বর্তমানে এ বাংলায় তৃণমূল এতটাই বিস্তৃত যে নতুন কিছু যোগ করার কোনো সুযোগই ওখানে অবশিষ্ট নেই। তাই এখনই যেটা দরকার, তা হলো ছাঁটাই পর্ব এবং অবশ্যই আত্মসমালোচনা ও আত্মমন্থন। অহংকারের মেদ ঝরিয়ে দ্রুত হাল্কা হতে হবে। অনেকেই অনেক কিছু ভাবতে বা বলতে পারে। তবে সে সবই সাময়িক।
রাজনৈতিক স্বার্থেই দ্রুত সঠিক পরামর্শদাতা তথা সঙ্গী নির্বাচনও করতে হবে। হাতে থাকা বাকী সময়টুকু সরকার পরিচালনায় যাবতীয় দক্ষতা দেখাতে হবে।
এতদিনের ভুল এখনও করে চললে, একা তৃণমুলই উবে যাবে তাই নয়, বিজেপি ক্ষমতায় বসলে শেষ হয়ে যাবে যুগযুগ ধরে আগলে রাখা এ বাংলার অসাম্প্রদায়িক মনন ও সাংস্কৃতিক ভবিষ্যৎ। ইতিহাস মীরজাফরের পাশে মমতা ব্যানার্জীর নামটাও রেখে দেবে যুগযুগ ধরে।