শুভেন্দু এখন বিজেপির বোঝা, ৪ পুরনিগমের নির্বাচনে সেই ক্ষত কাটিয়ে ওঠার পরীক্ষায় বিজেপি

দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ বাংলার রাজনীতি দেশের বাকি রাজ্যগুলির থেকে বরাবরই কিছুটা আলাদা পথে হাঁটে। সে একই সরকারের উপর মানুষের লাগাতার ভরসা রেখে যাওয়াতেই হোক বা টানা সরকার চালানোর রেকর্ড, বাংলা হল অনন্য। বর্তমানে রাজ্যের আপাত স্বাভাবিক অবস্থার মধ্যেও রাজনীতির ময়দানে এক অবাক করা ঘটনা ঘটছে।

২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে রাজ্যের মানুষের রায় থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল আসনসংখ্যায় অনেক পিছিয়ে থাকলেও বিজেপি রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল। শুধু তাই নয় পরিসংখ্যানের দিক থেকে দেখলে তারাই রাজ্যের একমাত্র স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বিরোধীদল।

কারণ বাম ও কংগ্রেস বিধায়ক শূন্য হয়ে পড়ায় বিধানসভায় অন্তত তাদের আর অস্তিত্ব নেই। আর যে দলগুলি একজন জনপ্রতিনিধিকেও নির্বাচিত করতে পারে না, মাঠে ময়দানে তাদের কতটা জোর থাকবে সেটা সহজেই অনুমেয়।

কিন্তু রাজ্যের বিরোধী পরিসরের একচেটিয়া দখলদারি পেয়েও মাত্র ৮ মাসের মধ্যে তা বিজেপির হাতে থাকবে কিনা তা নিয়েই প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। আর এই পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে বিধাননগর, চন্দননগর, আসানসোল ও শিলিগুড়ি পুরনিগমের ভোট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ডিসেম্বর মাসে হয়ে যাওয়া কলকাতা পুরসভার নির্বাচনে ইতিমধ্যেই বামেরা বিজেপিকে ছাপিয়ে দ্বিতীয় স্থানে উঠে এসেছে।

আগামী ২২ জানুয়ারি যে চারটি পুরনিগমের নির্বাচন হবে সেখানেও যদি বামেরা বিজেপির থেকে ভালো ফল করে, তবে একটা বিষয় প্রায় স্পষ্ট হয়ে যাবে যে বিধানসভায় শূন্য হয়ে গেলেও বামেদের আবার উত্থান ঘটছে। পাশাপাশি বিধানসভায় প্রধান বিরোধী দল হলেও বিজেপি আসলে রাজ্যের বিরোধী শিবিরের দখলদারি হারিয়েছে।

ঘটনাচক্রে বিধানসভা নির্বাচনের ফলের নিরিখে আসানসোল পুরসভা ও শিলিগুড়িতে বিজেপি এগিয়ে আছে। কিন্তু গত ৮ মাসে গঙ্গা ও তিস্তা নদী দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে। আর তাতে ক্রমশ ভাঙতে ভাঙতে কোণঠাসা অবস্থা বিজেপির।

বিধাননগর, চন্দননগর তো দূর, আসানসোলেও তারা বিশেষ কিছু করে উঠতে পারবে বলে মনে হয় না। একমাত্র শিলিগুড়ি পুরসভায় তাদের অবস্থা বাকি রাজনৈতিক দলগুলির থেকে কিছুটা হলেও ভালো। কিন্তু সেখানেও যদি তারা খারাপ ফল করে তবে তা গেরুয়া শিবিরের কাছে বড়সড় ধাক্কা হবে।

কারণ এতে এগিয়ে থাকা জায়গা যেমন তাদের হাতছাড়া হবে, তেমনই তাদের এক প্রকারের ঘাঁটি উত্তরবঙ্গেও যে তারা জমি হারাচ্ছে সেটা প্রকট হয়ে উঠবে। প্রশ্ন হচ্ছে গত ৮ মাসে হঠাৎ এমন কী হল যে বিজেপি রাজ্যের বিরোধী পরিসরের দখল হারাতে বসেছে?

এক্ষেত্রে একটু গোড়ায় যাওয়া যাক। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে সবাইকে চমকে দিয়ে বিজেপি রাজ্যে ১৮ টি আসনে জয়ী হয়। প্রশ্ন তৈরি হতে পারে হঠাৎ করে রাজ্যের এতো মানুষ বিজেপির মতাদর্শে আস্থাশীল হয়ে উঠলেন কেন? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে বলতে হবে প্রশ্নের দৃষ্টিভঙ্গিটাই ঠিক নয়।

কারণ লোকসভার পর বিধানসভা নির্বাচনে যারা বিজেপিকে রাজ্যের প্রধান বিরোধী পক্ষ হিসেবে বেছে নিয়েছে, তাদের সকলে মোটেও ভারতীয় জনতা পার্টির আদর্শে বিশ্বাসী নয়। একটা বড় অংশের তৃণমূল বিরোধী ভোটাররা মনে করেছিলেন বিজেপিই একমাত্র তৃণমূলকে নির্বাচনী ময়দানে পরাজিত করতে পারবে। সেই ভাবনা থেকেই তাঁরা বিজেপিকে সমর্থন করেন।

সেক্ষেত্রে বিজেপির মতাদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকা অনেকেই শুধুমাত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে পদ্মফুল প্রতীকে ভোট দেয়। কিন্তু বিধানসভা ভোটের পর থেকে বিজেপির নানান কার্যকলাপ সেই ভোটারদের আশাহত করে তোলে। তাঁরা বুঝতে পারেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে মুখ্যমন্ত্রীর গদি থেকে সরানো বিজেপির কাজ নয়। সেই কারণেই সম্ভবত তাঁরা বিজেপির পাশ থেকে সরে আসছেন।

করোনাকে বাড়তে দিয়ে এখন কড়াকড়ি, আমজনতাকে ভাতে মারার ব্যবস্থা করল সরকার!

আসলে শুভেন্দু অধিকারীকে বিরোধী দলনেতা করাটা বুমেরাং হয়ে গিয়েছে বিজেপির কাছে। অনেক পুরনো বিজেপি সমর্থক দলের এই সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারেননি। কারণ এই শুভেন্দু তৃণমূলের মন্ত্রী থাকাকালীন বিরোধীদের সঙ্গে যে নির্মম আচরণ করেছেন তা আজও অমলিন।

সেই তিক্ত অভিজ্ঞতা অসংখ্য মানুষের স্মৃতিতে আজ‌ও টাটকা হয়ে আছে। তিনি কীভাবে ভয় দেখিয়ে বিরোধীদের তৃণমূলে টেনে আনতে সেটা আজ ওপেন সিক্রেট। স্বাভাবিকভাবেই তাঁকে নেতৃত্বে দেখে বিজেপির ওপর ক্ষুব্ধ বিরোধী ভোটারদের একটা বড় অংশ।

এর পাশাপাশি রাজ্যের বিরোধী দলনেতা হওয়ার পর শুভেন্দু অধিকারী যেভাবে মুখ্যমন্ত্রী পদের অবমাননা করে সবসময় মমতাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে বেড়াচ্ছেন সেটাও অনেকে মেনে নিতে পারছে না। শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ রাজ্যের বিরোধী দলনেতা তথা বিরোধী দলের কাছে সরকারবিরোধী আন্দোলন আশা করেন। কিন্তু কুৎসিত ব্যক্তি আক্রমণ তাঁরা কখনোই মেনে নিতে চাইবেন না। আসলে সেটা বাংলার সংস্কৃতি নয়।

এমনিতেই শুভেন্দু অধিকারীকে রাজ্যের বিরোধী দলনেতা করা নিয়ে বিজেপির একাংশ সন্তুষ্ট নয়। প্রাক্তন রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ সহ পুরনো বিজেপি কর্মীদের একটা বড় অংশ চেয়েছিলেন শুরু থেকে বিজেপি করছেন এইরকম কাউকে বিরোধী দলনেতা করা হোক। বিধানসভা নির্বাচনের মাসখানেক আগে দলে আসা শুভেন্দুতে তাঁদের প্রবল এলার্জি ছিল।

যদিও রাজ্য বিজেপির একাংশের আপত্তিতে কান দেয়নি দিল্লি বিজেপি। তারা মনে করেছিলেন মমতা সরকারের মন্ত্রী থাকার সুবাদে শুভেন্দুকে বিরোধী দলনেতা করলে তিনি রাজ্যজুড়ে আন্দোলনের ঢেউ তুলবেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে শুভেন্দু অধিকারী নানান ছুতায় খালি রাজভবনে ছুটে যান। রাজ্যপালের কাছে কথায় কথায় নালিশের এই রাজনীতি মোটেও মানুষের মনে দাগ কাটতে পারছে না।

উল্টে যেখানে সরকারকে নাস্তানাবুদ করা যেত সেই বিধানসভায় তিনি কোনও কার্যকরী আন্দোলন গড়ে তুলতে ব্যর্থ হচ্ছেন। এমনকি লোকায়ুক্ত, তথ্য কমিশনার সহ বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রধান বা সদস্য নিয়োগের বৈঠক, যেখানে বিরোধী দলনেতা হিসেবে তিনি নির্দিষ্ট ভূমিকা পালন করতে পারতেন, সেই সব জায়গাতেও হাজির হচ্ছেন না। ফলে প্রধান বিরোধী পক্ষের মত‌ই জানতে পারছে না রাজ্যের মানুষ।

সত্যি বলতে গত ৮ মাসে নানান ইস্যুতে শুভেন্দু অধিকারীর লম্বা-চওড়া কথা ও নিজেকে জাহির করা বক্তব্য শুনতে শুনতে মানুষ ক্লান্ত। কিন্তু বাস্তবে কোনও কিছুই দেখা যাচ্ছে না। উল্টে তাঁর অনুগামীদের একাংশ তৃণমূলের ফিরে যাচ্ছেন। তাছাড়া মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুষ্টিকরণের রাজনীতির মোকাবিলা করতেও ব্যর্থ হয়েছেন বিরোধী দলনেতা।

এদিকে, নানান অনুষ্ঠানে শুভেন্দু অধিকারীকে যেভাবে সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করতে দেখা যায় তা নজিরবিহীন। সংঘ পরিবার থেকে উঠে আসা দিলীপ ঘোষ, সুকান্ত মজুমদাররাও কথায় কথায় এইরকম সাম্প্রদায়িক মন্তব্য করেন না। এর থেকে একটা বিষয় স্পষ্ট, তৃণমূল থেকে বিজেপিতে এসে বড় হিন্দুত্ববাদী সাজার চেষ্টা করছেন শুভেন্দু!

তাঁর এইসব কাজকর্মের ফলে রাজ্যের তৃণমূল বিরোধী জনগণের একাংশ বিজেপির থেকে আর‌ও মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁরা আবার বামেদের উপর আস্থা রাখতে শুরু করেছেন। বিরোধী ভোটারদের এই অংশ কখনোই অশান্তি চায় না। তারা সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকেও প্রশ্রয় দেন না। শুধু মমতা বিরোধিতার জন্যই তাঁরা একসময় বিজেপির উপর ভরসা করেছিলেন।

কিন্তু দেখা যাচ্ছে শুভেন্দুর হঠকারিতার বড়োসড়ো মাশুল দিতে হচ্ছে বিজেপিকে। তারা শুধু অসাম্প্রদায়িক বিরোধী ভোটারদের আস্থা হারায়নি,  নিজের দলের পুরোনো কর্মীদের‌ও ক্ষুব্ধ করে তুলেছে। এই পরিস্থিতিতে কলকাতার পুরভোটের পুনরাবৃত্তি বাকি চারটি পুরনির্বাচনে হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। বরং সেই ঘটনারই সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।

আর সত্যি যদি চার পুরনিগমের নির্বাচনে বিজেপিকে পিছনে ফেলে বামেরা দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে তবে রাজ্যের বিরোধী পরিসরের প্রকৃত দখল পরিষ্কারভাবে বিজেপির হাতছাড়া হবে। সেক্ষেত্রে বাকি পুরসভার নির্বাচনে গেরুয়া শিবির খুব একটা দাগ কাটতে পারবে বলে মনে হয় না। আর এর চূড়ান্ত প্রভাব পড়বে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে।

যেকোনও একটি গণতান্ত্রিক দেশ বা রাজ্যে বিরোধী পক্ষ থাকবেই। সেই সূত্র ধরে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে তৃণমূল বিরোধী পক্ষ হিসেবে বিজেপিকে আবার পিছনে ঠেলে উঠে আসতে পারে বামেরা। পরিস্থিতির যেদিকে এগোচ্ছে তাতে আগামী লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় বিজেপি কতটা কী করতে পারবে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে।

আর সেক্ষেত্রে আগের জেতা ১৮ টি লোকসভা আসন তো দূরের কথা, বিজেপির সাংসদ সংখ্যা দুই অঙ্কের ঘরে পৌঁছবে কিনা তা নিয়েই সংশয় তৈরি হতে পারে। সব মিলিয়ে শুভেন্দু এখন বিজেপির কাছে শাঁখের করাতে পরিণত হয়েছে। এই সমস্যার সমাধান বার করতে করতে হয়তো দেখা যাবে রাজ্যে বামেদের উত্থান ঘটে গিয়েছে!

সম্পর্কিত পোস্ট