পরিবর্তনের ডাক সিঙ্গুরে, সৃজনের হাত ধরে নতুন সূর্যোদয়ের পথে বামেরা
নয়ন রায়, এডিটর ইন চিফ
২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি কেন্দ্র সিঙ্গুর। ২০১০ সালে যখন প্রথম পরিবর্তনের ডাকে উদ্বেল হয়ে উঠেছিল বাংলা তখন সিঙ্গুর ছিল তার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। ৩৪ বছরের বামদুর্গের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল। মুখ্যমন্ত্রী হন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তারপর একটা একটা করে দিন যত পেরিয়েছে ততই প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে সিঙ্গুর আন্দোলন আসলে সে সময় কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল। ১০ বছর ধরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুর নিয়ে প্রতিশ্রুতি দিলেও এখনও পর্যন্ত সিঙ্গুরের জমি পড়ে রয়েছে একইরকম ভাবে।
সেই জমি আর চাষযোগ্য নেই। বড় বড় ঘাস, রাসায়নিকের মিশ্রণে রুক্ষ মাটিতে জমির উর্বরতা হারিয়ে গেছে। একুশের নির্বাচনের আগে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন আ্যগ্রো ইন্ডাস্ট্রিয়াল পার্ক হবে সিঙ্গুরে। প্রশ্ন এখানেই আদৌ হবে তো?
কারণ তিনি একসময় সিঙ্গুরে গিয়ে ছড়িয়ে এসেছিলেন সর্ষের বীজ। তারপরের ঘটনাপ্রবাহ সর্বজনবিদিত। রাজনীতির আঙ্গিনায় বারবার উঠে আসা সিঙ্গুর এখন প্রতিশ্রুতির ভরকেন্দ্র ছাড়া অন্য কিছু নয়।
২০১০ সালে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে জমি আন্দোলনে প্রথম থেকে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন মাস্টারমশাই রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য্য,তিনি এবারে বিজেপির প্রার্থী। বাম-কংগ্রেস এবং ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের সংযুক্ত মোর্চার তরফে প্রার্থী তরুণ তরতাজা সৃজন ভট্টাচার্য। আর তৃণমূলের বাজি বেচারাম মান্না।
২০০৫ সালে তৎকালীন বাম সরকার সিদ্ধান্ত নেয় সিঙ্গুরের জমিতে তৈরি টাটাদের গাড়ি কারখানা। তাতে কর্মসংস্থান হবে প্রচুর মানুষের। বহুফসলি জমিতে গাড়ি কারখানা হবে এমনটা মেনে নিতে পারেননি চাষীরা। জমি দিতে অনিচ্ছুক কৃষকরা জানিয়ে দেন গায়ের জোরে বহুফসলি জমি অধিগ্রহণ কিছুতেই তারা মেনে নেবেন না। অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি তৈরি হয় সিঙ্গুরে।
ইগোর লড়াই ডোমজুড়ে, ব্যাক্তিগত ক্যারিশ্মায় এগিয়ে রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রতিবাদে গর্জে ওঠেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সে সময় তিনি পাশে পেয়ে যান বহু অনিচ্ছুক কৃষকদের। ঝরেছে প্রাণ। তাপসী মালিক এবং রাজকুমারের মৃত্যু কৃষক আন্দোলনে ঘৃতাহুতি দেয়। দীর্ঘ ২৬ দিন সিঙ্গুর আন্দোলনে সামিল হয়ে অনশনে বসেছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ধর্মতলার ওই চ্যানেলে। সেসময় বর্তমান প্রতিরক্ষা মন্ত্রী রাজনাথ সিং ফলের রস খাইয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অনশন ভেঙেছিলেন।
এরপর সিঙ্গুর সরণি বেয়ে মহাকরণে মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে পৌঁছান মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শপথ নিয়েই ২০১১ সালে তিনি জানিয়ে দিয়েছিলেন জমি ফেরাবে তার সরকার। এরপর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে অনিচ্ছুক কৃষকদের জমি ফিরিয়ে দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তুলে দেওয়া হয় চেক। তারপরেও খুশি হননি কৃষকরা।
২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে যখন সিঙ্গুরের রাজনৈতিক পরিস্থিতি জটিল হতে শুরু করে তখন নীরবতা ভেঙে ফের কলম ধরেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মনে করিয়ে দেন তাঁর সেই আপ্তবাক্য- কৃষি আমাদের ভিত্তি,শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ। প্রশ্ন উঠতে শুরু করে গত ১০ বছরে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কেন শিল্প আনতে পারলেন না? কেন বেকাররা চাকরী পেলেন না? কেন সিঙ্গুর থেকে টাটাদের সরিয়ে লক্ষ লক্ষ ছেলেমেয়ের কর্মসংস্থানের সুযোগ নষ্ট করলেন তিনি?
এবারের নির্বাচনে গণদেবতার রায় যদি সংযুক্ত মোর্চার পক্ষে যায়,তাহলে ধরে নিতে হবে রাজনৈতিকভাবে জয়ী হল বামেরা। এবারের নির্বাচনে বেশ কয়েকটি কেন্দ্রে সংযুক্ত মোর্চার জয় হলেও রাজ্যে সরকার গঠন করা সম্ভব নয় সেকথা আলিমুদ্দিনে কান পাতলেই গুঞ্জন শোনা যাচ্ছে।
রাজ্যে ক্ষমতায় আসতে না পারলেও সিঙ্গুরে সৃজন ভট্টাচার্যের হাত ধরে যদি বামেরা জয়ী হয়, নিঃসন্দেহে ১৬ বছরের গ্লানি মুছে নতুন করে ইতিহাস তৈরী হবে।
প্রেস্টিজ ফাইট নন্দীগ্রাম, গুরু-শিষ্য লড়াইয়ে জয়ী হবেন কে?
রাজনৈতিক মহলের মতে, সিঙ্গুরে লড়াই হবে বেচারাম মান্না বনাম সৃজন ভট্টাচার্য। গত ১০ বছরে সিঙ্গুরকে নিয়ে ঘটে চলা এক একটি ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে এগিয়ে রয়েছেন সৃজন। আর রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যকে মেনেই নিতে পারেননি আদি বিজেপির নেতৃত্বরা।
কে বলতে পারে, হয়ত ৩ মে সৃজনের হাত ধরেই নতুন সূর্যোদয় ঘটবে সিঙ্গুরের আকাশে…