বীর যোদ্ধাদের জানাই সেলাম, জয়হিন্দ….
‘তানসাহি হাটাও’দেশ বাঁচাও’: এই শ্লোগান দিল্লি শীতের দুপুরে উত্তাপ বাড়িয়েছিল। ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯। দুই তরুণ সাংবাদিককে নিয়ে দিল্লির যাত্রা। সেদিন সকাল থেকেই ঠান্ডা হাওয়া বইছিল। দুই তারুণ্যের চোখে মুখে ছিল উদ্দীপনা।সাংবাদিকতা জীবনেরই একটা সময় আমার দিল্লির সঙ্গে অতি পরিচিতি ছিল। আবার অনেক বছর পর দিল্লি যাওয়া।
তবে ২০০০ সাল থেকে ২০১৯ এর দিল্লির ছবিটা একেবারে আলাদা। শেষ দেখছিলাম শহরটাকে যখন মেট্রোর টানেল তৈরির কাজ চলছিল। আজ আধুনিক যন্ত্রের সরীসৃপ দিল্লির গাদা গাদা মানুষকে একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিত্যদিন বয়ে নিয়ে চলেছে।
পরিস্থিতির সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন হয়েছে রাজনীতিরও। শীলা দিক্ষিতের বদলে এখন মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল।তাঁরই ডাকা সভাতে মধ্যমণি ছিলেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। কে ছিল না সেদিন! চন্দ্রবাবু নাইডু, সীতারাম ইয়েচুরি, ডি রাজা আরও অনেকে। কর্মসূত্রে মমতা বন্দপাধ্যায়কে অনেক কাছ থেকে দেখেছি। সরকারের প্রতি তাঁর জ্বালাময়ী ভাষণ নতুন কিছু নয়। কিন্তু মঞ্চে তিনিই ছিলেন হিট।
বাংলায় যখন মমতাকে নিয়ে আলোচনা চলছে তখন জম্মু-কাশ্মীরে একটি বড় ঘটনা ঘটে গিয়েছে। জঙ্গিদের বেয়াদপি কায়দাতে ৪৯ জন ভারতীয় সেনাকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। শুনেই রাগে চোয়াল শক্ত হয়ে উঠেছিল। শীতের হাড়কাঁপানি ঠান্ডাতেই ঠিক করলাম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হবোই। সঙ্গে দুই সতীর্থ তপসে এবং জটায়ুও এক কথায় রাজি হয়ে গেল।
দিল্লির লালকেল্লা থেকে বাস রওনা দিল জম্মুর উদ্দেশ্যে। ঘুম ভাঙল যখন তখন ঘড়িতে ৭ টা বাজে। ফোনের নেটওয়ার্ক ততক্ষণে উড়ে গিয়েছে। রাস্তার ধারে মাইলফলকের দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বুঝতে পারলাম কাঠুয়া। মেঘলা আকাশের সঙ্গে ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। মনে হচ্ছে গতকালের ঘটনায় আকাশও ভারাক্রান্ত।
জম্মু শহরে যখন উপস্থিত হলাম তখন ৯ টা বেজে গিয়েছে। কিন্তু শহরে ঢোকার আগেই ফিরিয়ে দেওয়া হল বাস। বলা হল এর থেকে আগে যাওয়া যাবে না। পুলিশের সতর্কীকরণকে উপেক্ষা করেই এগিয়ে চললাম। জানিনা ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি কি না। গোটা রাস্তায় যান চলাচলের মাধ্যম বলে কিছু নেই। তবে নিচু এলাকা থেকে উঁচু এলাকার দিকে তাকিয়ে শুধুমাত্র যা লক্ষ্য করলাম, তা দেখে লোম খাড়া হয়ে গেল। প্রত্যকটি রাস্তার মোড়ে থেকে কালো ধোঁয়ার স্তুপ।
বাইপাস থেকে আমাদের যাত্রা শুরু। ওদের মুখ দেখেই আমার নিজের খারাপ লাগছিল। তারমধ্যে শুভজিত বলছে যা হবার হবে চাপ নেই। একটু আত্মবিশ্বাস পেলাম। প্রায় আড়াই কিলোমিটার হাঁটার পর একটি অটোকে আমাদের দিইকে এগিয়ে আসতে দেখলাম। আমাদের বলার আগেই সেই অটো ড্রাইভার বলছেন “ভাই সাব,কাঁহা জাও গে?”
আমরা বললাম বিসি রোড হোটেল রেড রোজ। অটোতে বসে জানতে পারলান সারথীর নাম পবন। টেলিপ্যাথির জোর শুনেছিলাম। কিন্তু অটোওয়ালার নাম শুনে টেলিপ্যাথি মিলে যায় তা দেখলামও বটে।
সারা শহর চক্কর মারছে অটো। ওলিগলি পার করে যখনই মেইন রোডে উঠতে চাইছে তখনই বিপদ থাবা বাড়িয়ে এগিয়ে আসছে। অনেক চেষ্টা করে পাহাড়ের গায়ে নামিয়ে দিয়ে পবন বলল, “বাবু আপকো ইস জাগা উতার না পারে গা।ইহা সে হোটেল ২ কিলোমিটার হোগা।বাবু হামকো মাপ কর দেনা”। আমি জিজ্ঞাসা করলাম “কত দেবো পবনজি?” বলল ৩০০ টাকা। বিপদের সময় নিজের জীবনকে বাজিতে রেখে যে কাজ উনি করেছেন তার জন্য ৩০০ টাকা কম।
৫০০ মিটার যেতেই বিখ্যাত তাওয়ি নদীর কাছে উপস্থিত হলাম। অপরূপ সেই দৃশ্য। তাওয়ির স্বচ্ছ জলে এলাকার প্রতিবাদের ছবি ভয়ঙ্কর আকার ধারণ করেছিল। কাতারে কাতারে ভিড় পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসছিল। হাজার হাজার মানুষের সেই ভিড় দেখে হাড় হিম হয়ে গিয়েছিল।
সামনে ও পিছনে বল্গাহীন চিৎকার।কারো হাতে তলোয়ার।কারো হাতে রড-টায়ার-পাথর।মোটর সাইকেলে চেপে পাকিস্তান বিরোধী নাড়া চলছেই। রাস্তার ওপরেই জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে আস্ত গাড়িগুলোকে। গতকালের(১৪ ফেব্রুয়ারী) ঘটনার প্রতিবাদে জম্মুর মানুষ একজোটে রাস্তায় নেমে এসেছে।
ব্যাগপত্র নিয়ে কিছুটা যাচ্ছি আবার থমকে দাঁড়িয়েছি। দমকা ঠান্ডা হাওয়া শরীরকে নাড়িয়ে দিচ্ছে।এই করতে করতেই তিন কিলোমিটার রাস্তা পার হতে দু ঘন্টা সময় লাগলো। জম্মু পুলিশ লাঠি উচিয়ে তাড়া করছে।
আমরা তিনজনের মুখ তিনজন দেখছি। টেনশনও বাড়ছে। কিছুটা দূরে গিয়ে সিআরপিএফ ক্যাম্পে গিয়ে বললাম আমরা হোটেল রেড রোজ যাবো । আমরা কলকাতা থেকে আসছি। এই আমাদের পরিচয় পত্র। চার জন জওয়ান আমাদের হোটেল অবধি পৌঁছে দিয়ে গেল।
টেনশন কাটিয়ে হোটেলের বাইরে থেকে বলছি আমাদের রুম নেওয়া আছে। অনেক বলার পর চৌধুরী মহাম্মদ আক্রম জি’র নাম করতে হোটেল যাওয়া গেল। যা পরিস্থিতি তাতে সকলেই টেনশনে থাকা স্বাভাবিক।হোটেল গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খাবারের টেবিলে বসে প্ল্যান করছি।
সেদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি। শুনেছি জম্মুর বিরিয়ানি স্বাদ আলাদা হয়। উচ্চ রক্তচাপ কমাতে বিরিয়ানি খেয়ে একবার ঢুঁ মারতে নামলাম। ততক্ষণে শহরজুড়ে কার্ফু লাগু হয়ে গিয়েছে। হোটেলের বাইরে নিরাপত্তারক্ষীতে ছয়লাপ।
২০০ মিটার যেতেই দেখলাম একদল যুবক বাইক নিয়ে আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। হিংস্রতার ছাপ তাদের চোখে। কর্মজীবনে থাকা স্বভাবের দোষে ফোন বের করে তাঁদের ছবি যাই তুলতে গেলাম। ভিড় দেখি আমার দিকেই তেড়ে এল। হাত থেকে ফোন কেড়ে নিল একজন। সজোরে মাটিতে ভেঙে ফেলার আগেই তাদের মধ্যে একজন বলে উঠল ছবিটা ডিলিট করে ফোনটা ফিরত দিয়ে দিতে।
হোটেল ম্যানেজারের দৌলতে ওয়াইফাইয়ের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। হোটেল ফিরেই আক্রমজিকে হোয়াটস্অ্যাপে কল করে জিজ্ঞেস করলাম “আমরা কি করবো”? আক্রম সাহেব বললেন “আপ কলকাতা ওয়াপস যাও। মহল আভি গরম হেয়”। হোটেলের টিভিতে তখন রোমহর্ষক ঘটনা চলছে। গোটা দেশ শোর তুলেছে। সেনাদের কফিন কাঁধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং।
হোটেলে বসে সহেলি ও শুভদীপ কে ফোনে টিকিট কাটতে বললাম। ১৬ ফেব্রুয়ারি হোটেল থেকে স্টেশন যাবো কি করে? কোনো গাড়ি নেই।দোকান সব বন্ধ।জম্মু পুলিশকে অনুরোধ করলাম।আমরা সাংবাদিক আমরা কলকাতা ফিরে যাবো। কিন্তু কোনো গাড়ি চলছেই না। কিছুতেই বোঝানো যাচ্ছে না।
অনেক বলার পর একটি জিপের ব্যবস্থা করলেন এক অফিসার। পুলিশ জীপ করে জম্মু স্টেশন। রাস্তার চারদিকে কাঁটাতার যেন অজান্তেই দেশের মধ্যে দাগ কেটে দিয়েছে। গত কয়েকদিনে আন্দোলনে যে পরিমাণ আগুন জ্বলেছে তারই ছাই ছড়িয়ে রয়েছে গোটা শহরে। কবির লাইন ধার করে বলি,”এই উত্তপ্ত নগরী আমার দেশ নয়”।
আমাদের ট্রেন অনেক রাতে।জম্মু থেকে অমৃত্সর এলাম ভোর ৪টে হবে।বিরাট ঠান্ডা।হাত জমে যাওয়ার জোগাড়।অমৃত্সর থেকে ট্রেন করে দিল্লি।
দুপুরে আমরা দিল্লি পৌঁছে হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।জওয়ানদের মারা যাওয়ার গোটা দেশ চোখের জল ফেলেছিল। অনেকে বলছেন বা বলা ভাল বলার চেষ্টা করেছিলেন এই ঘটনা মোদির নাকি প্ল্যান।কারণ ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে জিতে আসতেই হবে।
আমরা এরকম কোনো মতামত দিতে পারব না।এই লেখাটি স্মৃতিচারণ ছাড়া আর কিছু না। পুলওয়ামায় জঙ্গি হানায় শহীদ জওয়ানদের প্রতি শতকোটি প্রণাম।
সাহসী যোদ্ধাদের সেলাম, জয় হো….