পাঞ্জাবের কৃষকরা মোদির ৫৬ ইঞ্চির ফানুস পুরো চুপসে দিয়েছে…
কৌস্তভ
পাঞ্জাবে মোদির কনভয় আটকে পড়া নিয়ে ব্যাপক শোরগোল শুরু হয়েছে। বিষয়টিকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হাতিয়ার করার চেষ্টা করছে বিজেপি। তাদের বিভিন্ন মন্তব্য এবং পদক্ষেপ থেকে স্পষ্ট, দেশের প্রধানমন্ত্রীকে ফিরে আস্তে হওয়ার বিষয়টিকে জাতীয়তাবাদের ইস্যু করে তুলতে চাইছে তারা। যেন মোদির ফিরে আসাটা দেশের অপমানের সমান!
পাশাপাশি এই ঘটনায় পাঞ্জাব সরকারকে কাটগড়ায় তুলে বকলমে কংগ্রেসকে জাতীয়তাবাদ বিরোধী বলে ফের একবার দেগে দেওয়ার চেষ্টাও চলছে।
গোটা ঘটনায় ইতিমধ্যে পাঞ্জাব সরকার উচ্চ পর্যায়ের তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে। তিন দিনের মধ্যে নাকি সেই বিশেষ কমিটি সরকারের কাছে রিপোর্ট জমা দেবে। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক অমিত শাহের নির্দেশে নিজেদের মতো করে আরেকটি তদন্ত চালাচ্ছে। এই নিয়ে বৃহস্পতিবার সকালে রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দের সঙ্গেও দেখা করেন প্রধানমন্ত্রী।
এই ঘটনার প্রতিবাদে দেশজুড়ে প্রতি জেলায় মিছিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিজেপি। যদিও করোনার এই বাড়বাড়ন্তের মাঝে এই মিছিল করার সিদ্ধান্ত কতটা যুক্তিযুক্ত তা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে।
তবে মোদিকে আটকে দেওয়ার এই ঘটনাকে খোলাখুলি সমর্থন করেছে বিজেপি বিরোধী কৃষক সংগঠনগুলি এবং বামেরা। বরং এই বিষয়টি নিয়ে কংগ্রেসের মধ্যে যথেষ্ট মতভেদ দেখা দিয়েছে। পাঞ্জাব প্রদেশ কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি সুনীল জাখর তীব্র সমালোচনা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী চরঞ্জিৎ সিং চন্নির।
বিষয় হচ্ছে, বুধবারের ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য। কিন্তু সত্যিই কী ভাতিন্ডা মোদির কোনও বিপদ ছিল? বিভিন্ন রাজ্যের অসংখ্য মুখ্যমন্ত্রীকে নানান সময়ে আম জনতার বিক্ষোভের মুখে পড়তে হয়। সেক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীকে বিক্ষোভ দেখানোটা কী অপরাধ? দেশের সংবিধান কিন্তু বলছে এতে অন্যায়ের কিছু নেই।
বিজেপি যেভাবে এগোচ্ছে বিষয়টিকে ভিক্টিমাইজ করার চেষ্টা করছে তাতে প্রশ্ন উঠছে আর কবে সাবালক হবে ভারতীয় গণতন্ত্র! বিশেষ করে পশ্চিম ইউরোপের দেশগুলোর দিকে তাকালে দেখা যাবে সেখানে নাগরিক অধিকার সকলের জন্য সমান। নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী সহ অন্যান্য রাষ্ট্রনেতাদের নিরাপত্তার বিষয়টিতে জোর দেওয়া হয়, কিন্তু তা বলে মৌলিক অধিকারের প্রশ্নগুলিতে সকলে এক সারিতে এসে দাঁড়ান।
কেন্দ্রীয় সরকারের বিতর্কিত তিন কৃষি আইনের প্রতিবাদে হাজার হাজার কৃষক যখন দিল্লির উপকণ্ঠে রোদ জল বৃষ্টি ঠান্ডা মাথায় নিয়েই অবস্থান করে গিয়েছেন, তখন প্রধানমন্ত্রী একদিনের জন্যও তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন? একদিনও কী প্রধানমন্ত্রী কৃষক নেতাদের নিজের বাসভবনে ডেকে তাদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন? উত্তর- না।
উল্টে এই নরেন্দ্র মোদিকেই বলতে শোনা গিয়েছিল দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদীরা কৃষকদের ভুল বোঝাচ্ছে। তিনি বলেছিলেন, অল্প কয়েকজন কৃষককে দেশবিরোধী শক্তি উস্কে দিয়ে অচলাবস্থা তৈরি করছে। এতোটুকু সংবেদনশীলতার পরিচয় দেননি তখন। আর মেঘালয়ের রাজ্যপাল সত্যপাল মালিকের বক্তব্য যদি সত্যি বলে মেনে নিতে হয়, তবে তো কৃষকদের তিনি আদৌ মানুষ বলে মনে করতেন কিনা তা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য!
নানান সময়ে আন্দোলনরত কৃষকদের নিয়ে মোদির মন্তব্য তাঁকে দেশের অন্নদাতাদের কাছে একপ্রকার অচ্ছুৎ করে তুলেছে। সে তিনি যতই চাপে পড়ে কৃষি আইন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন না কেন।
পাঞ্জাব সবার আগে ওই বিক্ষোভকারী কৃষকদের। তারা যদি প্রধানমন্ত্রীর যাত্রাপথের ৩০ কিলোমিটার দূরে বিক্ষোভ দেখান, তাতে দোষের কি আছে? হ্যাঁ, ওই কৃষকরা দাবি তুলেছিলেন মোদিকে রাজ্যে প্রবেশ করতে দেবেন না। কিন্তু তা বলে লাঠিসোঁটা নিয়ে মোদির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন, এইরকম কিন্তু হয়নি। বরং জানা যাচ্ছে চাইলে কনভয় না থামিয়ে পাশ কাটিয়ে বেরিয়ে যেতেই পারতেন প্রধানমন্ত্রী।
কিন্তু না, তিনি মুখে ৫৬ ইঞ্চি ছাতির বড়াই করলেও ময়দানে তো আর নামেন না। বরং ময়দানের যাবতীয় কাজ তাঁর হয়ে প্রশান্ত কিশোরের মতো স্ট্যাটিজিস্টরা করে দেন। তাই বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিরাপত্তা বেষ্টনীর সুরক্ষা চাদরে ঢাকা থেকেও অনুষ্ঠানস্থলে পৌঁছনোর সাহস দেখাতে পারলেন না। তাইতো পাঞ্জাব থেকে দিল্লি ফিরে গিয়ে শুরু করলেন সহানুভূতি আদায়ের রাজনীতি!
আচ্ছা নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহরা কী ভাবেন, দেশের কৃষকদের সঙ্গে তাঁরা যে আচরণ করেছেন তারপরও পাঞ্জাব-পশ্চিম উত্তরপ্রদেশে গেলে তাঁদেরকে ফুল-চন্দন দিয়ে বরণ করে নেওয়া হবে? দিল্লির শীতের ওই হাড় কাঁপানো ঠান্ডার মধ্যেই এই কৃষকদের উপর জলকামান থেকে গ্যালন গ্যালন জল ছুঁড়েছিলেন, মনে পড়ে নরেন্দ্র মোদি? দেশের সবাই তো আপনার ধামাধরা নয়।
এই দেশটা একা আপনার অনুগত হিন্দু বাহিনীর নয়। তারপরও ভাবেন কী করে একের পর এক অসাংবিধানিক আচরণ করে যাবেন মানুষের সঙ্গে শুধুমাত্র নির্বাচনী খেলায় অধিক সংখ্যার জোরে এবং তারপরও মানুষ আপনাদের ক্ষমা করে দেবে!
এই ঘটনা থেকে বিজেপির শীর্ষ নেতৃত্বের একটা শিক্ষা পাওয়া খুব জরুরী, মানুষ প্রাথমিক কিছু চাপিয়ে দেওয়া মেনে নেয়। কিন্তু সেই চাপ লাগামছাড়া হয়ে গেলে তা ফেটে যেতে বাধ্য। তাঁদের পরিচালিত কেন্দ্রীয় সরকার সাধারণ মানুষকে যে জায়গায় নিয়ে গিয়ে দাঁড় করিয়েছে তাতে সেই বিস্ফোরণটাই এখন হচ্ছে।
বরং দেশের কৃষকদের থেকে বিজেপির শেখা উচিত। তারা তো হিন্দু ধর্মের নামে গোটা দেশজুড়ে ভাঙচুরের রাজনীতি করে বেড়ায়। কোনও আইন-শৃঙ্খলার তোয়াক্কা করে না। কিন্তু এই কৃষক সম্প্রদায় দিনের-পর-দিন সংবিধান মেনে অহিংস আন্দোলন চালিয়ে গিয়েছে, একবারের জন্যও আইন হাতে তুলে নেয়নি। বুধবার নরেন্দ্র মোদিকে ভাতিন্ডায় একেবারে সাংবিধানিক কাঠামো মেনে তারা আটকে দিয়েছে, কোনও বল প্রয়োগের চেষ্টা করেনি।
কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় দেশের আমজনতা সাংবিধানিক গণ্ডির মধ্যে থেকে প্রতিবাদ জানালেও মোদি অর্ধসত্য তুলে ধরে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের ঘৃণ্য চেষ্টায় মেতেছেন। ছিঃ নরেন্দ্র মোদি, পারলে এবার পদটা ছাড়ুন!