‘গো’-পাচার; পর্ব-২: ভোট মিটেছে, গরু পাচার‌ও বহাল তবিয়তে হচ্ছে, চুপ বিজেপিও!

ভিড়ে গরু বোঝাই ট্রাকগুলি নজর এড়িয়ে যেতেই পারে। তাতে অন্যায়ের কিছু নেই। আর সেই নজর এড়িয়ে যাওয়ার বিনিময়ে মোটা টাকা মাসোহারা জোটে আইনের রক্ষাকর্তাদের।…..

‘গো’-পাচার; পর্ব-১: ভোট মিটেছে, গরু পাচার‌ও বহাল তবিয়তে হচ্ছে, চুপ বিজেপিও! 

দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ এখানেই থেমে যাবেন না। এখনও বিএসএফের হিসেবটা বাকি আছে। ভারত-বাংলাদেশ সীমান্ত বিস্তীর্ণ। তাই যতই সীমান্তরক্ষী পাঠানো হোক না কেন সীমান্তের প্রতিটি ইঞ্চি ২৪ ঘন্টা নজরে রাখা সম্ভব নয়। গরু পাচারের পয়েন্টগুলো প্রয়োজনের সময় নজর এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই মোটা টাকা পকেটে ঢোকে বিএসএফের! সাধারণ জ‌ওয়ান থেকে শুরু করে অফিসার, সকলেই এর ভাগ পান।

এক্ষেত্রে নিয়ম হচ্ছে বিএসএফের নতুন কমান্ডিং অফিসার এলে তাঁর সঙ্গে নতুন করে চুক্তি করে পাচারকারীরা (মানে আন্ডারস্ট্যান্ডিং)। সেই চুক্তি যতক্ষণ না পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়, সেই কটা দিন একটু কড়াকড়ি করা হয়। মূলত এই সময়টাতেই পাচারকারীদের সঙ্গে বিএসএফের বেশকিছু সংঘর্ষের ঘটনা সংবাদ মাধ্যমে উঠে আসে। তারপর আবার যেইকে সেই।

চূড়ান্ত চমক এরপর। একাংশের দাবি গরু পাচার নিয়ে যারা তদন্ত করছে সেই সিবিআইয়ের সদর দফর দিল্লির লোদি এস্টেটেও নাকি গরু পাচারের টাকার ভাগ পৌঁছে যায়! এরপর আর কিছু বলার থাকে! কিছুক্ষন চুপ করে বসে থাকাটাই ভালো। তবে আপনাদের আর‌ও কতগুলো বিষয় জানিয়ে দেওয়া যাক!

শুধু এনামুল নয়, গরু পাচারের যারা মাথা তাদের প্রায় প্রত্যেকের দুবাইয়ে বিপুল পরিমাণ স্থাবর সম্পত্তি আছে। এক একটি সুদৃশ্য বাংলো দেখলে মনে হবে তা যেন রাজপ্রাসাদ! শুধু তাই নয়, আপনি মুর্শিদাবাদ মালদহের সীমান্তবর্তী গ্রামগুলিতে গেলে হঠাৎ দেখতে পাবেন হতদরিদ্র পরিবারগুলির ভাঙাচোরা বাড়ির মাঝে একটি বিশাল রাজপ্রাসাদ গজিয়ে উঠেছে। স্থানীয় মানুষের কাছে একটু খোঁজখবর করলেই জানতে পারবেন ওই নির্দিষ্ট রাজপ্রাসাদের মালিক গরু পাচারের অন্যতম মাথা!

এই পাচারকারীরা নিজেদের জেলা ছাড়াও কলকাতা, মুম্বাই ও দিল্লিতে কর্পোরেট অফিস খুলে রেখেছে। এর কারণ কী জানেন? শোনা যায় সিবিআই সহ একেবারে শীর্ষস্তরের রাজনীতিবিদদের সঙ্গে ডিল নাকি এই কর্পোরেট অফিসগুলোর মাধ্যমেই হয়ে থাকে!

এই ডিলের অঙ্কের কিছুটা আন্দাজ দেওয়া যাক। মোটামুটি এখনকার বাজারদর বলছে প্রতি জোড়া গরু পাচার হলে হাতে আসে ৩২ থেকে ৩৫ হাজার টাকা। শুধু মুর্শিদাবাদ জেলাতেই প্রতিদিন কয়েক হাজার জোড়া গরু পাচার হয়। এরপর তো উত্তর ২৪ পরগনা, মালদহ, দুই দিনাজপুর, কোচবিহার এমনকি নদিয়ার বেশ কিছু পয়েন্ট‌ও আছে। তাহলে বুঝতেই পারছেন প্রতিদিন ঠিক কত টাকার লেনদেন হয়!

মালদহ, মুর্শিদাবাদ কোচবিহারের মতো জেলায় গরু পাচারের টাকায় একটা আস্ত সমান্তরাল অর্থনীতি চলছে। তবে এই ঘটনা ২০১১ সালে তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর শুরু হয়েছে তা কিন্তু নয়। সেই বাম জামানা থেকেই গরু পাচার চলত।

তখন‌ও বারেবারে শাসক দলের নেতাদের দিকে যেমন অভিযোগের আঙুল উঠেছে, তেমনই বিএসএফের ভূমিকাও সংশয়মুক্ত ছিল না। তবে এলাকার মানুষ‌ই বলছে তৃণমূল জামানায় পাচারের সংখ্যা অনেক অনেক বেড়ে গিয়েছে। এমনকি বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বেশকিছু জায়গায় মানুষের প্রধান জীবিকা‌ই হল গরু পাচার করা!

কানাঘুষো শোনা যায় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় গরু পাচার নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত ক্ষুব্ধ। কিন্তু পাচার আটকাতে কঠোর মনোভাব নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু যারা তাঁর নির্দেশ বাস্তবায়িত করবে তারাই নাকি এই বিপুল পরিমান টাকার ভাগ পেয়ে থাকে। কেউ কেউ তো বলে, কালীঘাটের প্রধান বাড়িতে এই টাকার ভাগ না গেলেও তার আশেপাশের ‘মজবুত’ ব্যক্তিদের বাড়িগুলোয় বেশ ভালোভাবেই এই গরু পাচারের ‘লাভের গুড়’ পৌঁছে যায়!

তবে এই টাকার ভাগ নিয়ে বেশ একটা সাম্যবস্থা আছে, কেউ কাউকে বঞ্চিত করে না। তাই সীমান্তবর্তী থানাগুলি যেমন এই টাকার ভাগ পায়, তেমনই ভবানী ভবনেও ভাগের নির্দিষ্ট অংশ পৌঁছে যায়! শুধু তাই নয়, উত্তরপ্রদেশ-হরিয়ানার রাজনীতিবিদ ও পুলিশ কর্তাদের কাছেও এই টাকার নির্দিষ্ট অংশ গিয়ে পৌঁছয় বলে জানা গিয়েছে!

তাহলে কী দাঁড়াচ্ছে? বর্তমান পরিস্থিতি বুঝিয়ে দিচ্ছে একুশের বিধানসভা ভোটের আগে রাজনৈতিক কারণেই গরু পাচার নিয়ে শোরগোল শুরু হয়েছিল। ভোট মিটেছে, প্রয়োজন ফুরিয়েছে। তাই রাজনৈতিক দলগুলোও এই নিয়ে চুপ!

বিজেপির অভিযোগ অনুযায়ী তৃণমূলের না হয় চুপ থাকার কারণ আছে। কিন্তু বিজেপি কেন হঠাৎ এই অভিযোগ নিয়ে চুপ করে গেল? কেন্দ্রে তো তারা ক্ষমতায় আছে। সেক্ষেত্রে সিবিআই কেন গরু পাচার নিয়ে চূড়ান্ত কোনও পদক্ষেপ করল না তার জবাব কে দেবে? এর দায়ভার কেন্দ্রীয় সরকার নেবে না?

ঘটনাক্রম থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার বিজেপি-র বাধ্যবাধকতা আছে, তাই ভোট মিটতেই তারা মানে মানে চুপ করে যাওয়াটাই শ্রেয় মনে করেছে। না হলে কোথায় কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে কেউটে বেরিয়ে আসবে, তার ঝুঁকি কেউ নেয়! যেখানে স্বয়ং এক কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর বিরুদ্ধে এই পাচার চক্রে জড়িত থাকার গুরুতর অভিযোগ আছে! আবার এমনও শোনা যায় তিনি নাকি ভারতের নাগরিক‌ই নন, বাংলাদেশের বাসিন্দা!

এবার বাংলার শাসক দল তৃণমূলের দিকে নজর ঘোরানো যাক। অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় সহ তৃণমূলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা নির্বাচনের সময় বারবার বলেছিলেন বিএসএফের জন্য গরু পাচার বন্ধ হচ্ছে না। তাঁরা নিজেদের কলুষমুক্ত বলে সেই সময় দাবি করেন। প্রশ্ন হচ্ছে এবার তো ভোট মিটে গিয়েছে, রাজ্য পুলিশ তো পুরোপুরি রাজ্য সরকারের নিয়ন্ত্রণে। তাহলে এখন কেন গরু পাচার আটকাতে চূড়ান্ত পদক্ষেপ করছে না সরকার?

এক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হবে কেন্দ্র বিএসএফের এলাকা সীমান্ত থেকে ১৫ কিলোমিটারের বদলে বাড়িয়ে ৫০ কিলোমিটার করেছে। যদিও সেই নিয়ম এখনও চালু হয়নি। যাই হোক, গরুবোঝাই ট্রাক মুর্শিদাবাদ, মালদহে পৌঁছনোর আগেই তো আটকে দেওয়ার কথা রাজ্য পুলিশের। কিন্তু সেটা কেন হচ্ছে না তার জবাব তৃণমূল দেবে না?

গোটা গল্পটাই আপনাদের সামনে তুলে ধরা গেল। এবার শেষ পর্যায়ে আসা যাক। একটা বিষয় স্পষ্ট বলে দেওয়া যায়, খুব গভীর কোনও পরিবর্তন না হলে এই গরু পাচার বন্ধ হওয়ার নয়। কেন জানেন? রাজনৈতিক দলগুলির শীর্ষস্থানীয় নেতারা এই পাচার বন্ধ করতে চাইলেও স্থানীয় নেতৃত্ব মোটেও তাতে রাজি হবে না। কারণ যে একবার এই কাঁচা টাকার স্বাদ পেয়েছে তাকে অন্য কিছু দিয়ে কিছুতেই আপনি সন্তুষ্ট করতে পারবেন না!

তাছাড়া সীমান্ত এলাকার বেশিরভাগ মানুষ এই গরু পাচারের সঙ্গে যুক্ত থাকায় এতে স্থানীয় স্তরে একটা গণসমর্থন‌ও আছে। তাই উচ্চ নেতৃত্ব বেশি কড়াকড়ির চেষ্টা করলেও স্থানীয় নেতারা দল ছেড়ে এলাকার মানুষকে নিয়ে পাল্টা প্রতিরোধ করবে।

সেক্ষেত্রে কোন‌ও রাজনৈতিক দল‌ই নিজের সাজানো সংসার ভেঙে নিজেই ছারখার করতে চাইবে না। আর স্থানীয় স্তরে যদি গরু পাচারের সমর্থন থাকে তবে বিএসএফকে কোনভাবেই এতে ইন্ধন জোগানো থেকে আপনি নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন না! তারা কিছু ফন্দিফিকির বের করে ফেলবেই। তাই সম্ভব নয়।

একটাই মাত্র উপায় হতে পারে, যেখানে থেকে গরুগুলো আসে অর্থাৎ সেই হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশে‌ই যদি গোটা বিষয়টা থামিয়ে দেওয়া যায়। অর্থাৎ বাংলায় গরু পাঠানো যদি আটকানো যায় তবেই গোটা বিষয়টা ঠেকানো যেতে পারে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও সমস্যা আছে।

কারণ ওই দুই রাজ্যেও অসংখ্য মানুষ এই সংশ্লিষ্ট বিষয়টির ওপর অর্থনৈতিকভাবে নির্ভরশীল। সেক্ষেত্রে তাদের বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া দায়ভার বহন করতে হবে সরকারকে!

মুখে গো-মাতা গো-মাতা করলেও বিজেপি কী আদৌ সেই দায় বহন করবে? একের পর এক উদাহরণ কিন্তু বলছে বিজেপি আসলে ভোটের রাজনীতি করার জন্যই কোনও বিষয়কে তুলে ধরে, আবার কোন‌ও বিষয় নিয়ে চুপ করে যায়। কোনটার‌ই প্রকৃত সমাধানের দিকে তাদের নজর নেই। অতএব গরু পাচার জিন্দাবাদ!

সম্পর্কিত পোস্ট