শান্তনু ঠাকুররা বুঝিয়ে দিচ্ছেন বিজেপি মানেই সার্কাস!
দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ এই দেশের রাজনীতিতে একটা লব্জ খুব চালু আছে। কমিউনিস্ট দলগুলি বাদে একমাত্র বিজেপির সাংগঠনিক কাঠামো সুশৃঙ্খল। বাকিদের নাকি সংগঠন বলে আদপে কিছু নেই! সহজ করে বললে বিজেপির ক্যাডার বাহিনী অতি সুশৃঙ্খলিত। এই দলে নাকি নিজেদের কথা প্রকাশ্যে বলা যায় না।
যা বলতে হয় দলীয় অনুশাসন মেনে সংগঠনের ভিতরেই বলতে হয়। না হলে অবধারিতভাবে সেই নেতা বা কর্মীর উপর শাস্তির খাঁড়া নেমে আসে। কিন্তু বঙ্গ বিজেপির সাম্প্রতিক হালচাল দেখে মনে হচ্ছে তাঁরা দীর্ঘদিন ধরে চালু এই লব্জটি ভুল প্রমাণ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন!
বিজেপির অভ্যন্তরের যে সাংগঠনিক শৃঙ্খলার কথা বলা হয় তা আসলে অটল-আদবানি যুগে চালু ছিল। সত্যিই সেই সময় প্রকাশ্যে আলটপকা মন্তব্য করলে দলের নেতাদের রেওয়াত করত না পদ্ম শিবির। তাইতো লালকৃষ্ণ আদবানিকেও সময় ফুরানোর আগে দলের সভাপতি পদ থেকে সরে যেতে হয়েছিল।
শুধু কী তাই, সেই যুগের বিজেপি কোনরকম ব্ল্যাকমেলের ফাঁদে পা দিত না। তাই উমা ভারতীর মতো তৎকালীন দাপুটে নেত্রীকে দল থেকে বের করে দেওয়ার আগে এক মুহুর্তও ভাবেনি তারা। আসলে ক্ষমতা যায় যাক, আদর্শই সব এই ছিল সেই সময়ের বিজেপির নীতি।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহদের আমলে গোটা বিষয়টি বদলে গিয়েছে। দলীয় অনুশাসন বা আদর্শ নয়, বিজেপি এখন ক্ষমতাকেন্দ্রিক একটি দল। এই বিষয়ে তাদের সঙ্গে কংগ্রেসের বিশেষ কোনও পার্থক্য নেই। আর দল ক্ষমতা কেন্দ্রিক হয়ে উঠলে ব্ল্যাকমেলের রাজনীতি যে হবে তা তো জানা কথা।
কারণ দলের নেতাকর্মীরাও বুঝে যান তাঁরা ব্ল্যাকমেল করলেও ক্ষমতালোভী শীর্ষ নেতারা সহজে কিছু বলার সাহস দেখাবেন না। উল্টে ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য তাদের সঙ্গে আপসে আসতে বাধ্য হবে। তাইতো কেন্দ্রীয় মন্ত্রী হয়েও শান্তনু ঠাকুর প্রকাশ্যে সমান্তরাল রাজ্য কমিটি তৈরীর হুঙ্কার ছাড়তে পারেন!
বিজেপির সাংগঠনিক কাঠামো বলছে যে কোনও প্রদেশে রাজ্য সভাপতির থেকেও গুরুত্বপূর্ণ পদ হল সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক। বস্তুত রাজ্য সভাপতি সেই প্রদেশে দলের মুখ হলে সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হলেন সেই মুখের চালিকাশক্তি। মূলত তাঁর নির্দেশেই রাজ্যে দলীয় সংগঠন পরিচালিত হয়। তাই একসময় বিজেপির অন্দরে কেউ ভাবতেই পারতেন না সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকদের বিরুদ্ধে মুখ খুলবেন!
সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নিযুক্তিতে আরএসএস শুরু থেকেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। আজও সরাসরি আরএসএসের কোনও সাংগঠনিক নেতাকেই সর্বভারতীয় স্তরেই হোক আর রাজ্য স্তরে, সংগঠনের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হিসেবে নিযুক্ত করা হয়। রাজ্য বিজেপির বর্তমান সাংগঠনিক সাধারণ সম্পাদক অমিতাভ চক্রবর্তী সেরকমই একজন।
শান্তনু ঠাকুরের নেতৃত্বাধীন বঙ্গ বিজেপির বিক্ষুব্ধ নেতারা প্রায় কেউই আরএসএস ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসেননি। সেই তাঁরাই অমিতাভ চক্রবর্তীকে নিশানা করছেন। পিছনে যথেষ্ট যুক্তিও আছে। নতুন রাজ্য কমিটি বা সংগঠনের নতুন পদাধিকারীদের নিয়ে যে ক্ষোভ আছে তা এই অমিতাভ চক্রবর্তীর দ্বারাই তৈরি। কারণ তিনি চেয়েছেন বলেই নতুন ব্যক্তিরা কমিটিতে জায়গা পেয়েছেন এবং পুরনোরা বাদ পড়েছেন।
তবে এই ক্ষোভ থেকে শনিবার সাংবাদিক সম্মেলন করে শান্তনু ঠাকুর যে কাণ্ডটা ঘটালেন তা বিজেপির দলীয় ইতিহাসে রীতিমতন নজিরবিহীন! এমনকি যেসব রাজ্যে দল ক্ষমতায় আছে সেখানেও বিক্ষুব্ধরা জোট বেঁধে কখনও এমন কাণ্ড করেছেন বলে সহজে স্মরণে আসছে না।
এই বিষয়টি শুধুমাত্র দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গ নয়, তা ব্ল্যাকমেলের রাজনীতিও বটে। এই ব্ল্যাকমেলের রাজনীতির ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় জাহাজ প্রতিমন্ত্রী তথা মতুয়া ঠাকুরবাড়ির সদস্য শান্তনু ঠাকুর অবশ্য ডিস্টিংশন নিয়েই পাশ করবেন। কারণ তিনি শুরু থেকেই এই কাজটা করে আসছেন। কিন্তু বিজেপির অন্দরে এই মুহূর্তে যেভাবে ক্ষমতার রাজনীতি ছড়িয়ে পড়েছে তাতে দলের ক্ষমতালোভী শীর্ষ নেতারা সত্যিই অসহায়!
সামনেই উত্তরপ্রদেশ সহ পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচন। তার আগে কঠোর পদক্ষেপ নিয়ে শান্তনু ঠাকুর সহ বাকি বিক্ষুব্ধদের বহিষ্কার বা সাসপেন্ড করবে বিজেপি, তেমন সম্ভাবনা প্রায় নেই। কারণ সেই ক্ষমতার মোহ!
ফিল্ম এডিটরের ফেসবুক পোস্ট দেখেই শিশুর প্রাণ বাঁচাল অভিষেকের টিম
এর পরিণতিতে বিজেপির মতো একটি উগ্র দক্ষিণপন্থী দলে বিরল ঘটনার সাক্ষী থাকতে পারে কর্মীসমর্থকরা। সাধারণত কমিউনিস্ট পার্টিতে সমান্তরাল সাংগঠনিক কমিটি তৈরীর নজির আছে। সারা বিশ্বের কমিউনিস্ট পার্টিগুলিতেই বিভিন্ন সময়ে এই ঘটনা দেখা গিয়েছে। কিন্তু উগ্র দক্ষিণপন্থী দলে এইরকম সমান্তরাল কমিটির আলাদা করে বিশেষ কোনও তাৎপর্য থাকে না।
সত্যি বলতে বাংলায় বিজেপির রাজ্য কমিটির সদস্যদের মত নিয়ে দল কবে কী করেছে সেই প্রশ্ন করলে কেউ সঠিক উত্তর দিতে পারবেন না। তাই এখানে সমান্তরাল আরেকটি রাজ্য কমিটি তৈরীর অর্থই হল ভাঙনকে নিশ্চিত করা!
সব মিলিয়ে বলা যায় পশ্চিমবঙ্গে ৩ থেকে ৭৭ হওয়ার (যদিও এখন সংখ্যাটা ৭০ এর আশেপাশে) আপাত সাফল্যে বিজেপির রাজ্য নেতাদের বদহজম হয়েছে। তাই তাঁরা নিজেরাই চেষ্টা করছেন রাজ্যে আবার নিজেদেরকে তৃতীয় স্থানে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে সেই বদহজমের দোষ থেকে মুক্তি পেতে!
এক্ষেত্রে রাজ্যের প্রধান বিরোধী পক্ষ হয়ে ওঠার জন্য বামেদের সামনে ফাঁকা মাঠ আছে। তবে তারা সেই সুযোগ কাজে লাগাতে পারবে কিনা সেটা তাদের ব্যাপার। আপাতত বাংলার মানুষ বেশ কিছুদিন বিজেপি নামক সার্কাসটা উপভোগ করতে পারবেন বলেই মনে হচ্ছে