ইতিহাসের পাতায় নাম তোলার বাসনায় নেতাজি ও সেনাবাহিনী, উভয়কেই অপমান করলেন মোদি!

দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ ১৯৭১ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একটি সাহসী সিদ্ধান্ত ভারতীয় উপমহাদেশের রাজনীতি আমূল বদলে দেয়। বরাবরের জন্য অ্যাডভান্টেজে চলে যায় ভারত। কারণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যক্ষ সাহায্য করেছিল বলেই পাকিস্তান একঘরে হয়ে যায়।

এরপরই সংসদে দাঁড়িয়ে ইন্দিরা গান্ধীকে দেবী দুর্গার সঙ্গে তুলনা করেছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ি। যদিও তখনও ভারতীয় জনতা পার্টি গঠিত হয়নি। আরএসএসের সদস্য থাকার পাশাপাশি জনতা পার্টিতে ছিলেন বাজপেয়ি-আদবানিরা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রথম থেকেই ভারত সহায়তা করে এসেছে। কিন্তু প্রথম দিকে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেনি। সে দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়ার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় ত্রাণ-সাহায্য পাঠিয়ে যাচ্ছিল ভারত সরকার। কিন্তু তাতে যুদ্ধের গতি প্রকৃতি বিশেষ একটা বদলায়নি। বরং ক্রমশ কোণঠাসা হচ্ছিল স্বাধীনতাকামী বাঙালিরি।

এই পরিস্থিতিতে চিন ও আমেরিকার মতো দুই মহাশক্তিধরের চোখ রাঙানি উপেক্ষা করে ভারতীয় সেনাকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার নির্দেশ দেন ইন্দিরা। সেনাপ্রধান জেনারেল মানেক শ’র নিপুন রণকৌশলে দ্রুত সাফল্য পায় ভারতীয় বাহিনী। স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।

দেউচা পাচামি কী? কেন মমতা এই ‘অসম্ভব’কে সম্ভব করতে চাইছেন? পর্ব-১

শুনে লড়াইটাকে যত সহজ মনে হচ্ছে ততটা সহজ ছিল না এই লড়াই। কারণ ভারতের পূর্ব সীমান্তে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চললেও পশ্চিম সীমান্তে পাকিস্তানের হামলার ভয়ে ছিল এবং শেষপর্যন্ত সেই ভয় স্মৃতি হয়।

পাঞ্জাব, কাশ্মীর, রাজস্থানের ভেতরে। ঢুকে বোমা নিক্ষেপ করে পাকিস্তানি এয়ারফোর্স যদিও ভারতীয় বিমানবাহিনী পাল্টা মার দিলে দ্রুত তারা পিছু হটে। কিন্তু এই যুদ্ধে চূড়ান্ত সর্তকতা নেওয়া সত্ত্বেও ভারতীয় সেনাদের প্রাণহানি একেবারে আটকানো যায়নি। পূর্ব ও পশ্চিম, দুই ফ্রন্টেই আত্মবলিদান দিয়েছিল ভারতীয় সেনারা।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়ে শহিদ হওয়া ভারতীয় সেনাদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে ইন্ডিয়া গেটের কাছে অমর জওয়ান জ্যোতির অগ্নিশিখা জালানোর সিদ্ধান্ত নেয় ইন্দিরা সরকার। দেশের স্বার্থে আত্মবলিদান দেওয়া সেনা সদস্যদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে এ ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।

দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে ইন্ডিয়া গেটে অমর জওয়ান জ্যোতির শিখা নাগাড়ে জ্বলে গিয়েছে। ওই শিখা ভারতীয় সেনার পরবর্তী প্রজন্মকে দেশের জন্য আত্মবলিদান দিতে উদ্বুদ্ধ করেছে। কিন্তু ২১ জানুয়ারি মোদি সরকারের এক হঠকারী সিদ্ধান্তে মুহূর্তের মধ্যে নিভে গেল অমর জওয়ান জ্যোতির পবিত্র শিখা!

যদিও বিজেপি ও কেন্দ্রীয় সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে অমর জওয়ান জ্যোতির শিখা নেভানো হয়নি, তা ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়ালে মিশিয়ে দেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে মোদি সরকার এই ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়াল তৈরি করে। এক্ষেত্রে বিজেপির খানিক যুক্তি হল, একই বিষয়ে দুটি সেনা সৌধ রাখার মানে নেই! যেন মামারবাড়ির আব্দার! তারা ন্যাশনাল ওয়ার মেমোরিয়ালকে আরও বড় করে তুলতে চায়।

পৃথিবীর আর বাকি দেশের দিকে চোখ রাখলে দেখা যাবে জাতীয় গৌরব ও সেনাবাহিনীর আত্মত্যাগের জন্য নতুন নতুন স্মৃতি সৌধ গড়ে তোলার যথেষ্ট রেওয়াজ আছে। কিন্তু তা বলে পুরানো স্মৃতিসৌধগুলি ধ্বংস করে দেওয়া হচ্ছে এমন নজির কোথাও নেই।

এক্ষেত্রে বিজেপির বর্তমান নেতৃত্ব অটলবিহারি বাজপেয়ির অবস্থানকেও হেলায় অস্বীকার করে দিল! নিজেদের নামে ইতিহাসের পাতায় তুলতে মোদি-শাহদের এ কী প্রবল আকাঙ্ক্ষা!

বিজেপির পাল্টা যুক্তি অমর জ‌ওয়ান জ্যোতির জায়গায় ইন্ডিয়া গেটের কাছে সুভাষচন্দ্র বসুর গ্রানাইটের পূর্ণাঙ্গ মূর্তি স্থাপন করা হবে। খোদ প্রধানমন্ত্রী নিজে এই কথা ঘোষণা করেছেন। এর থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার, সুভাষচন্দ্র বসুকে মাধ্যম করে তারা যেমন জাতীয়তাবাদের ঢেউ তুলতে চাইছে দেশজুড়ে, তেমনই বাঙালির ভাবাবেগ উস্কে দেওয়ার লক্ষ্য।

কিন্তু যে সুভাষ বারবার সাধারণ সৈন্যদের আত্মত্যাগকে বড় করে দেখেছেন, সেই তাঁর মূর্তি বসাতে গিয়ে শহিদ সেনাদের স্মৃতি স্মারক সরিয়ে দেওয়াটা কি আদৌ ঠিক হল? এতে কি ঘুরিয়ে সুভাষচন্দ্র বসুকেই অপমান করা হল না? তাঁর মূর্তি অন্য কোনও ভালো জায়গাতেও তো বসানো যেত। কেন বাঙালির এই আইকনের সঙ্গে এভাবে বিতর্ক জুড়ে দেওয়া হল সেই প্রশ্ন উত্তর কে দেবে!

সেই সঙ্গে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, অতীতের স্মৃতি সৌধ এই সব মুছে দিয়ে বিজেপি বোধহয় নতুন করে ভারতের ইতিহাস লিখতে চাইছে। নেহেরু-গান্ধি পরিবার, জাতীয় কংগ্রেস, ইন্দিরা গান্ধী অতীতের সমস্ত উপাদান বাদ দিয়ে শুধু মোদি-শাহদের জয়গানের ইতিহাস হবে তা। এটাই বিজেপির লক্ষ্য।

সম্ভবত এই লক্ষ্য পূরণের জন্যই তারা ঐতিহ্যমন্ডিত দিল্লির বুকে ভিস্তা প্রকল্পের নামে একের পর এক ঐতিহাসিক নিদর্শন মুছে ফেলছে। অথচ পৃথিবীর তাবড় তাবড় দেশে উন্নয়নের জন্য প্রাচীন ঐতিহ্য ও ইতিহাসের নিদর্শনগুলি ধ্বংস হয় না, বরং তাকে সংরক্ষণ করা হয়। যদিও বিজেপির অভিভাবক সংস্থা আরএসএস বরাবরই অন্য চোখে ভারতকে দেখে এসেছে।

তারা সত্যের মুখোমুখি না হয়ে বরাবরই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতের ইতিহাস পর্যালোচনা করার পক্ষপাতি। কিন্তু ভাবাদর্শ এক জায়গায়, আর সরকার পরিচালনার ক্ষেত্রে বহুমত আরেক জায়গায়। এক্ষেত্রে বিজেপি একের পর এক কর্মকাণ্ড থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার তারা ভিন্নমত শুনতে চায় না, গায়ের জোরে চাপিয়ে দেওয়াটাই হল তাদের পন্থা।

কিন্তু অতীতের সব নজির ভেঙে যে সেনাবাহিনীকে বারবার রাজনীতির ঘুঁটি করার চেষ্টা করেছেন নরেন্দ্র মোদি, সেই সেনাদের স্মৃতিতে প্রজ্বলিত অগ্নি শিখা নিভিয়ে দেওয়ার আগে তাঁর হাত একবারও কাঁপল না! সব‌ই ভোটের রাজনীতি?

মোদির এই আচরণ সেনাবাহিনীকে সঠিক বার্তা দেবে তো? একটা কথা মাথায় রাখার, সরকারের একের পর এক অপমানজনক কাজের ফলে যদি সাধারণ সেনা সদস্যরা ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে তার পরিণাম কিন্তু ভালো হবে না। বিজেপি সরকারকে শেষে একটাই বলার, সম্মান করতে না পারেন অন্তত অপমানটা করবেন না!

সম্পর্কিত পোস্ট