বাংলা রাজনীতিতে বিজেপি ‘ওয়ান টাইম ওয়ান্ডার’ হতে চলেছে!
দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ খেলার দুনিয়ায় ওয়ান টাইম ওয়ান্ডার বলে একটা কথা আছে। জীবনের প্রথম ম্যাচেই কোনও খেলোয়াড় হয়তো দুর্ধর্ষ খেললেন। চমকে দিলেন সবাইকে। সবাই ভাবল এইতো, আমাদের হিরো এসে গিয়েছে। কিন্তু প্রথম ম্যাচের পর সেভাবে আর কোনও সাফল্য দেখাতে পারলেন না ওই ক্রীড়াবিদ।
এইরকম খেলোয়াড়দেরই সাধারণত ওয়ান টাইম ওয়ান্ডার বলা হয়। বাংলার রাজনীতিতেও বিজেপি কি সেই ওয়ান টাইম ওয়ান্ডার হওয়ার পথে পা বাড়াচ্ছে? বাংলায় বিজেপি বরাবরই ছিল এবং কখনওই ছিল না! মোটামুটি পাঁচ থেকে দশ শতাংশ ভোটের মধ্যে তারা বরাবর ঘোরাফেরা করেছে। সেই ভোটের জেরেই ২০১৬ এর বিধানসভা নির্বাচনে তারা প্রথমবারের জন্য ৩ টি আসন পায়।
তারপর কেন্দ্রে থাকার সুবিধা নিয়ে এবং রাজ্যের তৎকালীন প্রধান বিরোধী দল সিপিএমের লড়াইয়ের ব্যর্থতা তাদের উত্থানের পথ সুগম করে। ২০১৮ এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে খুব দূরের হলেও রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল হিসেবে উঠে এসেছে গেরুয়া শিবির। বিরোধী ভোটাররা বামেদের উপর আস্থা হারিয়ে বিজেপির দিকে একটু একটু করে ঢলে পড়ে।
২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপি সবাইকে চমকে দেয়। এই ঐতিহাসিক নির্বাচনে বাংলা থেকে তাদের ১৮ জন সাংসদ পাওয়ার ঘটনা সকলের জানা। তার দু’বছর পর একুশের বিধানসভা নির্বাচন চারিদিকে প্রবল রব উঠেছিল তৃণমূলকে সরিয়ে বাংলার ক্ষমতায় আসবে বিজেপি। কিন্তু তা তো হলই না, উল্টে বাংলায় বিজেপির অস্তিত্ব ধরে রাখা নিয়েই এখন একগুচ্ছ প্রশ্ন উঠছে।
বিধানসভা নির্বাচনের পর থেকেই বিজেপিতে ক্ষয় শুরু হয়েছে। এ যেন ২০১৬ পরবর্তী বাম শিবিরের দুরাবস্থার প্রতিছবি বা তার থেকেও বেশি কিছু! বাংলার বিজেপি নেতারা গোড়াতেই ভুলটা করেছিলেন। জেট গতিতে দলের উত্থান দেখে তাঁরা ভেবেছিলেন বাঙালির মনে বিজেপি মতাদর্শগত প্রভাব ফেলেছে।
CPIM Westbengal : লড়লে সুফল পাওয়া যায়, প্রমাণ পেয়েই মীনাক্ষীদের মুখ করার দাবি জোরালো সিপিএমে
নিঃসন্দেহে কিছু মানুষ মতাদর্শগত জায়গা থেকেই বিজেপির প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। কিন্তু সার্বিক ছবিটা দেখলে বোঝা যাবে মতাদর্শ নয়, বিজেপির মধ্যে শক্তিশালী বিরোধী পক্ষকে খোঁজার চেষ্টা করেছিল বাঙালি। কিন্তু পঞ্চায়েতের পর লোকসভা নির্বাচনে বিপুল সাফল্য বিজেপি নেতাদের মাথা ঘুরিয়ে দেয়।
তারা সাংগঠনিক শক্তি বাড়ানোর পরিবর্তে বেশি বেশি করে নিজেদের হিন্দুত্বের মতাদর্শ বাঙালির মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করতে থাকেন। ভেবেছিলেন এতে লাভ বেশি হবে। কিন্তু বাঙালির মধ্যে ধর্মের চর্চা থাকলেও সে কখনোই ধর্ম নিয়ে অতিরিক্ত মাতামাতি পছন্দ করে না। তার ফল যা হওয়ার সেটা একুশের বিধানসভা নির্বাচনেই দেখা গিয়েছে!
এদিকে রাজ্যের ক্ষমতা দখল করতে না পারার ব্যর্থতা সহজে মেনে নিতে পারছেন না বিজেপি নেতারা। কারণ তাঁরা মানসিকভাবে ধরেই নিয়েছিলেন সরকারে আসছেন। শোনা যায় দল সরকার গড়লে কে কোন দফতরের মন্ত্রী হবেন তা নিয়েও চর্চা শুরু হয়ে গিয়েছিল বিজেপির অন্দরে। সেখান থেকে এই ধাক্কা কি আর সহজে হজম হয়!
তাই এখন প্রবল অন্তর্কলহ শুরু হয়েছে বিজেপির মধ্যে। আর দলের ভেতর ঝামেলা শুরু হতেই প্রকট হয়ে গিয়েছে তাদের সংগঠনের ভঙ্গুর দশা। সিপিএমের সেই আগের সংগঠন নেই ঠিকই, কিন্তু আজও বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে তাদের অস্তিত্ব আছে। কিন্তু গ্রাম তো দূর অস্ত, বেশ কিছু জেলা শহরে বিজেপির সংগঠনের প্রায় অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র হাওয়ায় ভর করে বাংলার মতো বড় রাজ্যের ক্ষমতা দখল বেশ কঠিন!
২০১১ সালে দীর্ঘ সাড়ে তিন দশকের বাম সরকারের পতন ঘটাতে গিয়েও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত জননেত্রীকে দক্ষিণবঙ্গের নিজের মজবুত সংগঠন গড়ে তুলতে হয়েছিল। তবেই তিনি সাফল্য পান। কিন্তু বাংলায় বিজেপির সংগঠন গড়ে ওঠার আগেই তাতে ভেতর থেকে ক্ষয় ধরেছে। না হলে পুরভোটে দল পর্যদুস্ত হওয়ার পর একজন সাংসদ সাংগঠনিক বিষয়ের পর্যালোচনা করার বদলে নিরাপত্তারক্ষী অপসারণ নিয়ে বেশি মাথা ঘামাতে ব্যস্ত থাকেন!
পুর নির্বাচনে গোটা রাজ্যে বিজেপি ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাওয়ার পর শনিবার ছিল তাদের প্রথম রাজ্য কমিটির সাংগঠনিক বৈঠক। জাতীয় গ্রন্থাগারের একটি প্রেক্ষাগৃহে সেই বৈঠক হয়। নেতাদের কথাকাটাকাটিতে বৈঠক উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বলেই খবর। তবে তাৎপর্যপূর্ণভাবে সেই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন না রাজ্যের বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, রানাঘাটের সাংসদ জগন্নাথ সরকাররা।
এই জগন্নাথ সরকারেরই কেন্দ্রীয় নিরাপত্তা আচমকা প্রত্যাহারের নির্দেশ জারি করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। যদিও এখনও পর্যন্ত সেই সিদ্ধান্ত লাগু হয়নি। কিন্তু নিরাপত্তারক্ষী প্রত্যাহারের এই সিদ্ধান্তে জগন্নাথবাবু এতটাই বিচলিত যে আমাদের বলে বসলেন, দলের মধ্যে কেউ কেউ বিশ্বাসঘাতকতা করছে!
আবার দীর্ঘ ছয় মাস বাংলার রাজনীতিতে অনুপস্থিত থাকার পর হুগলির সাংসদ লকেট চট্টোপাধ্যায় ফিরে এসেই বর্তমান রাজ্য নেতৃত্বকে কাটগড়ায় তুলেছেন। সূত্রের খবর, শনিবারের বৈঠকে তিনি সবচেয়ে বেশি বিস্ফোরক ছিলেন।
এদিকে খড়্গপুরের বিধায়ক অভিনেতা হিরণ ক্রমাগত সংবাদমাধ্যমে দলের জাতীয় সহ সভাপতি দিলীপ ঘোষকে নিশানা করে তোপ দাগছেন! দু-একদিনের মধ্যেই তিনি নাকি সাংবাদিক বৈঠক করে দিলীপ শিবিরের ষরযন্ত্রের কথা ফাঁস করবেন! মুখে সাংগঠনিক শৃঙ্খলার বড়াই করলেও হিরণদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার ক্ষমতা নেই গেরুয়া শিবিরের।
সব মিলিয়ে যা দেখা যাচ্ছে তাতে মানুষের অনাস্থার পাশাপাশি নিজেদের বাংলার রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক করার জন্য বিজেপি নেতারাই যেন উঠে পড়ে লেগেছেন! এখন থেকেই বলা যায় ২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে বিজেপির ফলাফল বাংলায় একেবারে তলানিতে নেমে আসবে।
খুব সম্ভবত দক্ষিণবঙ্গ থেকে তারা ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যেতে পারে। তবে গেরুয়া শিবিরের ব্যর্থতা নিয়ে যেটুকু সংশয় আছে সেটুকু দায়িত্ব নিয়ে সম্পূর্ণ করার কাজ বোধহয় দলের সাংসদ-বিধায়করাই সেরে ফেলবেন। তৃণমূলের খুব একটা কিছু করার প্রয়োজন পড়বে না!