ফ্যাসিবাদের চোখরাঙানির মাঝেই ক্ষমতা বৃদ্ধির সুবর্ণ সুযোগ বামশক্তির কাছে
দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ বিজেপি ক্রমশ বাড়ছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের অনেকেরই ধারণা ২৪ এর লোকসভাতেও যদি নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা জিতে যান, তবে দেশের সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক কাঠামোয় বড় পরিবর্তন আসবে।
একদিকে যখন এই বিপদের পদধ্বনি আতঙ্ক বাড়াচ্ছে, তখন আশার আলোও কিছু অবশিষ্ট আছে। এখনও অব্দি দেশের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ বিজেপি তথা সংঘ পরিবার বিরোধী। কিন্তু ক্ষমতায় থাকা গেরুয়া শিবিরের পথরোধের মূল অনুঘটকের ভূমিকা পালন করবে কে? এ ক্ষেত্রে কংগ্রেসকে দিয়ে খুব কিছু যে সম্ভব নয়, তা যত দিন যাচ্ছে ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
এখানেই সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা লুকিয়ে আছে। কে তবে বিজেপি বিরোধী প্রধান শক্তি হবে? বিষয়টা মুখের নয়। কারণ দেবগৌড়ার মতো অতো কম শক্তি, সাংসদ নিয়ে আর কোনদিন কেউ বোধহয় প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন না। এক্ষেত্রে দলীয় শক্তিই প্রধান বিচার্য হবে।
এই হিসেবটা বেশ সহজ। যুক্তির খাতিরে ধরে নিচ্ছি ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে কংগ্রেস একাই ২০০ এর আশেপাশে আসন জিতল এবং বিজেপি ক্ষমতা হারাল। সেক্ষেত্রে কংগ্রেস যদি রাহুল গান্ধিকে প্রধানমন্ত্রী করতে চায় তখন কেউ আটকাতে পারবে? পারবে না। তা বলে কী নেতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেই? আলবাত আছে।
বড়জোর বাকি বিরোধী দলগুলি কংগ্রেসকে বলতে পারে, রাহুলের বদলে সোনিয়া বা প্রিয়াঙ্কাকে প্রধানমন্ত্রী করুন। সেই নিয়ে আলাপ আলোচনাও হতে পারে। কিন্তু এক্ষেত্রে শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের সিদ্ধান্তই যে চূড়ান্ত বলে বাকি সবাই মেনে নিতে বাধ্য হবে তা এখন থেকেই হলফ করে বলা যায়।
কিন্তু এতক্ষণ যে বিষয়টি ধরে নিয়ে কথা বললাম, সেই ধরে নেওয়ার গোড়াতেই যে গলদ আছে। উদাহরণ স্বরূপ আমরা রাহুল ও কংগ্রেসের কথা বললাম বটে। কিন্তু কংগ্রেসের দলীয় সংগঠনের যা অবস্থা, আমজনতার কাছে তাদের ভাবমূর্তি যেভাবে তলানিতে গিয়ে পৌঁছেছে, যেভাবে ‘কংগ্রেসের দ্বারা আর কিছু হবে না’, এই বিষয়টি বাজারে এক প্রকার প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছে, সেখানে তাদের পক্ষে আদৌ কী কিছু করা সম্ভব?
একটা জিনিস খেয়াল করলে দেখবেন, প্রধান বিরোধী দল হিসেবে নিজের গুরুত্ব ধরে রাখায় ব্যর্থ কংগ্রেসের বিকল্প হিসেবে দল নয়, কতগুলো মুখ সামনে ভেসে আসছে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, অরবিন্দ কেজরিওয়াল, শরদ পাওয়ার, নীতীশ কুমার, কে চন্দ্রশেখর রাও।
তৃণমূল ছাড়ছেন তাপস রায়, দ্রুত জানাবেন দিন
বিরোধী শিবিরের প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে এই নেতাদের নাম নিয়ে বেশ কিছুদিন ধরে রাজনৈতিক মহলে আলোচনা চলছে। এঁরা কেউই কংগ্রেস নেতা নন। তবে অরবিন্দ কেজরিওয়াল ও নীতীশ কুমার বাদে বাকিরা একসময় কংগ্রেসেই ছিলেন। তবে কংগ্রেসের সঙ্গে সকলেই বিভিন্ন সময়ে ঘর করেছেন বা ঘর করছেন।
এবার নাম ধরে ধরে আলোচনায় আসা যাক। প্রথমেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। দেশের বিরোধী শাসিত রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তাঁর সমান অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এখন আর কেউ নেই। তাঁর মতো লড়াকু নেত্রী বা নেতা বিরোধী শিবিরে আর একটাও আছেন কিনা সন্দেহ আছে। তদুপরি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সর্বভারতীয় স্তরে গ্রহণযোগ্যতা ভালোই। কিন্তু তিনি যে প্রধানমন্ত্রী হবেন, তাঁর দল তৃণমূল কংগ্রেস কটা আসন জিতবে?
যতই ত্রিপুরা, মেঘালয়, গোয়ার কথা বলা হোক না কেন, তৃণমূলের প্রভাব যে প্রকৃতপক্ষেই বাংলার মধ্যে সীমাবদ্ধ তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। এবার বাংলায় ৪২ টা লোকসভা আসন আছে। তৃণমূল ২০১৯ এর লোকসভা ভোটের থেকে যত ভালই ফল করুক না কেন রাজ্যের সবকটি আসনই তারা জিতবে এমন আশা প্রতি বড় সমর্থকও করেন না।
তর্কের খাতিরে ধরে নেওয়া গেল তৃণমূল কংগ্রেস ত্রিশের আশেপাশে আসন জিতল বাংলা থেকে। তা এই কজন সাংসদ নিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়া সম্ভব? অন্য রাজ্যে প্রভাবহীন একটি দলের প্রধানকে কেন বাকি বিরোধীরা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নেবে?
এবার আসা যাক কে চন্দ্রশেখর রাওয়ের কথায়। কেসিআরের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার শখ যে অনেকদিনের তা তাঁর বিভিন্ন কথাবার্তা থেকেই পরিষ্কার। কিন্তু মাঝারি আয়তনের রাজ্য তেলেঙ্গানার মুখ্যমন্ত্রী ও একটি রাজ্যের সীমাবদ্ধ আঞ্চলিক দলের প্রধান হয়ে কোন অঙ্কে তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চান তা সত্যিই বোধগম্য নয়।
সবচেয়ে বড় কথা লোকসভা ভোটের সময়ই তেলেঙ্গানার বিধানসভা নির্বাচন হবে। যা রাজনৈতিক পরিস্থিতি তাতে কেসিআরের দল আর তেলেঙ্গানায় সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় আছে। সেই তিনি কিনা দেশের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন!
শরদ পাওয়ার আদপে কংগ্রেসের ঘরের ছেলে। সোনিয়া গান্ধির বিরোধিতা করে তিনি কংগ্রেস ছেড়ে নিজের দল গঠন করলেও কংগ্রেসের হাত ধরেই চলছেন। মহারাষ্ট্র ছাড়াও আরও বেশ কিছু জায়গায় তাঁর দল এনসিপির অল্পবিস্তর প্রভাব আছে। তবে তা আহামরি কিছু নয়। যদিও ‘মারাঠা স্ট্রংম্যান’ নিজেই জানিয়ে দিয়েছেন, এই বয়সে এসে তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে চান না।
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার একটা সুপ্ত বাসনা বিভিন্ন সময়ে দেখা গিয়েছে। কিন্তু নিজের সরকার ধরে রাখার স্বার্থে নীতীশ এই নিয়ে খুব বেশি হাঁকডাক করবেন বলে আর মনে হয় না। কারণ বিহারে তাঁর সরকার এখন কংগ্রেসের সমর্থনেই চলছে।
এবার আসা যাক অরবিন্দ কেজরিওয়ালের কথায়। আপ প্রধানের বিষয়টি বাকিদের থেকে অনেকটাই আলাদা। তাঁর দল এখন শুধু দিল্লি নয় পাঞ্জাবেও ক্ষমতায় আছে। হিমাচল, গুজরাট, গোয়া, উত্তরাখণ্ডের মতো রাজ্যেও বেশ কিছুটা অস্তিত্ব আছে আপের।
সত্যি বলতে কংগ্রেস ছাড়া বাকি বিরোধীদের মধ্যে একমাত্র আপের একটা সর্বভারতীয় স্পষ্ট উপস্থিতি আছে। ফলে কেজরিওয়ালকে বিরোধীদের প্রধানমন্ত্রী মুখ করার দাবি খুব একটা অযৌক্তিক নয়। তবে এখনও পর্যন্ত তাঁর হাতে খুব একটা সাংসদ নেই, যার জেরে প্রধান বিরোধী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে আপ। ফলে কেজরিওয়ালকেও আরও কিছুটা অপেক্ষা করতেই হবে।
এতক্ষণ আমরা বামেদের নিয়ে কোনও আলোচনা করিনি। যদিও এই প্রতিবেদনের মূল উদ্দেশ্যই হল বামেদের ভবিষ্যতের দিকে আলো ফেলা।
২০০৯ এর লোকসভা থেকে দেশে ক্রমশ ক্ষীয়মান শক্তিতে পরিণত হয়েছে বামেরা। যদিও ২০১৯ এর পর থেকে তাদের আবার ঘুরে দাঁড়ানোর কিছু নমুনা দেখা যাচ্ছে। তবু বামেরা সরকার গড়বে এ ভাবনা সুদূরপরাহত। কিন্তু সর্বভারতীয় শক্তি হিসেবে বিজেপি ও কংগ্রেসের পর বামেদের নাম আসবেই।
পশ্চিমবঙ্গে কোণঠাসা অবস্থা থেকে বামেরা কিছুটা হলেও ঘুরে দাঁড়াবে বলে মনে হচ্ছে। কেরলে ক্ষমতায় আছে। ছোট রাজ্য হলেও ত্রিপুরায় তারাই প্রধান বিরোধী দল। এই পরিসংখ্যানগুলো জানা। কিন্তু বামশক্তির আশার আলো লুকিয়ে আছে বিহার, তামিলনাড়ু, তেলেঙ্গানা, মহারাষ্ট্র, রাজস্থান, হিমাচল প্রদেশর মতো রাজ্যগুলোয়। অতীতের জড়তা ঝেড়ে ব্যাপকহারে এই রাজ্যগুলোতে সিপিএম সহ বাম দলগুলো সংগঠনের ব্যাপক বিস্তার ঘটিয়েছে। তা জনমতে প্রতিফলিতও হচ্ছে।
কংগ্রেসের ব্যর্থতা এই সময়ে বামেদের সামনে সর্বভারতীয় স্তরে নিজেদের সাংগঠনিক অভ্যুথানের মস্ত বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। কারণ, বেশিরভাগ আঞ্চলিক দল আদর্শগতভাবে কতটা বিজেপি বিরোধী তা নিয়ে সংশয় আছে।
অপরদিকে বিজেপি তথা সংঘ পরিবারের বিরোধীতার প্রশ্নে বামেদের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে কারোর মনেই সন্দেহ নেই। এই পরিস্থিতিতে বামদলগুলো একজোট হয়ে ঝাঁপিয়ে পড়লে স্বাধীনতার ৭৫ বছর পর সত্যিই নতুন সূর্যের উদয় হতে পারে দেশে।
২০২৪ এর লোকসভা ভোটে না হলেও দেশের মানুষের স্বার্থে বাম নেতাদের ঝাঁপিয়ে পড়ে চেষ্টা করা উচিৎ। কৃষক আন্দোলন, যাতে বামেদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অনস্বীকার্য , তার সফল উদাহরণ এক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা দিতে পারে।
সেক্ষেত্রে ২০২৯ সাধারণ নির্বাচনে ম্যাজিক ঘটবে না কে বলতে পারে। কমিউনিজম তো হাল না ছাড়ার কথাই বলে কমরেড। এ শুধু আপনাদের ক্ষমতা বৃদ্ধির বিষয় নয়, দেশের কোটি কোটি মানুষের স্বার্থ জড়িয়ে আছে। আর দুর্বার আন্দোলনই পারে এই অসম্ভবকে সম্ভব করতে। তাতেও তো কমিউনিস্টরা সিদ্ধহস্ত। তাহলে আর আটকাচ্ছে কোথায়!