নারী তুমি অনন্যাঃ কলমে দেবারতি গুপ্ত
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারীদিবস। সমাজ বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলে গিয়েছে নারী দিবসের সংজ্ঞাও। আজও পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারী হেনস্থার শিকার। কোনো ক্ষেত্রে নিজের বাড়িতেও সুরক্ষিত নন তাঁরা। শুধুমাত্র বিভিন্ন রকম উদ্যোগ ও সেলিব্রেশনের মধ্যে দিয়েই বছরের পর বছর পালিত হয়ে আসছে আন্তর্জাতিক নারীদিবস।
আমরা কথা বলেছিলাম সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সঙ্গে। কীভাবে ব্যাখ্যা করছেন তাঁরা আন্তর্জাতিক নারীদিবস দিনটি, এই বিশেষ প্রতিবেদনে তুলে ধরা হল সেই সব দৃষ্টিভঙ্গি।
দেবারতি গুপ্ত , পরিচালক
বর্তমান পরিস্থিতিতে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন কতটা যুক্তি সঙ্গত ?
উ: অনেকে হয়তো বলবে একটা বিশেষ দিনকে পালন করার কি প্রয়োজন , তবে আমি ব্যক্তিগতভাবে নারীদিবস পালনকে ভীষণ যুক্তিসঙ্গত এবং প্রয়োজন বলে মনে করি ।
বর্তমানে সারাবিশ্বের বিশেষ করে দেশের যা পরিস্থিতি সেদিক থেকে দেখলে নারীদিবস পালন করা উচিত । মার্চের ৮ তারিখে নারীদিবস পালন করা মানে বাজার চলতি বিভিন্ন নামীদামী ব্র্যান্ডের তরফে মহিলাদের জন্য বিশেষ ছাড় দেওয়া নয়।
এর একটা ইতিহাস আছে । সালটা ১৯০৮ । ৮ ঘন্টা কাজ এবং মাতৃত্বকালীন ছুটির দাবীতে শ্রমজীবি নারীরা একটি আন্দোলন গড়ে তোলেন । জার্মান সমাজতান্ত্রিক নেত্রী ক্লারা জেটকিনের নেতৃত্বে তাদের আন্দোলন সফল হয় । সেই থেকে ১৯০৮ সালের ৮ মার্চ দিনটি আন্তর্জাতিক নারীদিবসের স্বীকৃতি লাভ করে ।
৮ মার্চ আসলে ছিল ‘Working Womens Day’ । সেই ৮ মার্চ আজকে কনজিউমারিজমের (ভোগবাদ )দুনিয়ায় প্যান্টালুনস, তানিস্কের ডিসকাউন্টে এসে দাঁড়িয়েছে ।
ধরুন আজ থেকে আরো ১০০ বছর পরে কোনো ভারতীয় হয়তো বলবে ১৫ই আগস্টের কোনো অস্তিত্ব নেই । আলাদা করে স্বাধীনতা দিবস পালনের কি দরকার । সেটা যেরকম হতে পারে না ,সেই রকম ৮ মার্চ নারীদিবস পালন যুক্তিসঙ্গত কি যুক্তিসঙ্গত নয় কথাটার কোনো মানে নেই । যারা এই ধরণের কথা বলে তারা ইতিহাস সম্পর্কে একেবারেই অবগত নন ।
৮ মার্চের ঐতিহাসিক গুরুত্বের বিচারে আমি ভীষণভাবে মনে করি নারীদিবস পালন করা উচিত ।
রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয় এবং মালদা সাম্প্রতিক ঘটনা দেখে সমাজের একাংশের মত, অতিরিক্ত নারী স্বাধীনতা এর কারণ, আপনার কি মত?
এতো পুরো হাস্যকর কথা । রবীন্দ্র সংগীত নিয়ে কিছু মানুষ বিকৃত মন্তব্য করে থাকলে, তাহলে সেটিকে নারী স্বাধীনতার কারণ যারা বলছে তাদের কথা পাগলের প্রলাপের সমান ।
কোনো সুস্থ মানসিকতা সম্পন্ন মানুষই এদের মন্তব্য কান দেন না । দ্বিতীয়ত বিকৃত যে সব লাইন ব্যবহার করা হয়েছে তাতে এতো রে রে করে তেড়ে যাওয়ার কোনো মানে আছে বলে আমি মনে করি না । যারা করছে তাদের মতে করো করছে , দেখুন যতদিন ভারতবর্ষ আছে ততদিন রবীন্দ্রনাথ তার মতো করে থাকবেন । ফলে তাঁর গানকে কেউ যদি অন্যভাবে সেলিব্রেট করার চেষ্টা করে থাকে , সেটা তাদের ব্যক্তিস্বাধীনতা ।
স্বাধীনতার বিভিন্ন দিক থাকবে, গণতন্ত্রে তার সঠিক ব্যবহার করতে হবে । এসবের জন্য নারী স্বাধীনতা দায়ী এটা হাস্যকর ।
ছোটবেলায় মেয়েদের অনেক বিধিনিষেধ থাকে, আপনার ক্ষেত্রেও কি অনেক বিধিনিষেধ মানতে হয়েছে ?
উ: দেখুন আমার কৈশোর কেটেছে ৯০ –এর দশকে । সেইসময় এই সব বিধিনিষেধ থাকাটা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার । তবে তার মধ্যেও আমায় একটা স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছিল । যার মধ্যে থেকে আমি যা চেয়েছি সেটা করতে পেরেছি । সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গিও বদলেছে । অনেক সময় বেশি রেগে গেলে তখন শুনতে হতো মেয়েদের এতো রাগ করতে নেই , মা কাকিমাদের এই বলার মধ্যেই একটা বিষয় তো রয়েছেই ।
নারী অগ্রগতির ক্ষেত্রে পরিবার ও সমাজের ভূমিকা কেমন হওয়া প্রয়োজন ?
উ: সমাজের একটা অংশ হল পরিবার, পরিবার থেকেই সমাজের উত্পত্তি । সময়ের সঙ্গে সঙ্গে একটি বা দুটি পরিবার তার মানসিকতা পরিবর্তন করতে পারলে সমাজ পরিবর্তন হতে বাধ্য । পাশাপাশি সামাজিক বিভিন্ন মাধ্যম যেমন- গণমাধ্যম, মেগাসিরিয়াল, সিনেমা এসবের ও একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেওয়া প্রয়োজন ।
উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে- জনপ্রিয় কোনো মেগাসিরিয়ালে কোনো কেরিয়ার সচেতন মহিলার চরিত্রকে নেতিবাচক ভাবে দেখানো হয়ে থাকে । এই সিরিয়ালের দর্শক মূলত বাড়ির মা কাকিমারা। ফলে এভাবে নারীর চরিত্রকে দেখানো হলে সমাজ কখনোই এগোতে পারবে না ।
বর্তমান সময়ে গণমাধ্যম হিসেবে সিনেমা এবং মেগাসিরিয়াল সমাজের একটা বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে । সেখানে এসব দেখানো আমার মতে বন্ধ করে দেওয়া উচিত ।
সর্বপরি পরিবার যদি সেই মেয়েটিকে সব বাধা কাটাতে সাহায্য না করে তাহলে কখনোই মানসিকতার পরিবর্তন সম্ভব নয় । এক্ষেত্রে মা বাবার মানসিকতার পরিবর্তন খুবই জরুরী ।
সামাজিক বাধা কাটিয়ে পুরুষদের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাজনীতির ময়দানে নেমেচে আজকের নারী । নেতৃত্ব থেকে আন্দোলন কোনো কিছুতেই পিছিয়ে নেই তারা, দিল্লির শাহীনবাগএবং পার্কসার্কাস তার উদাহরণ বিষয়টিকে কি ভাবে দেখছেন ?
বিষয়টিকে খুব সমর্থন করছি । এটা খুবই পজিটিভ দিক । যে এই ধরণের পরিস্থিতিতে সমাজের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলারা এগিয়ে এসে আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন । যার সুত্র পাত হয়েছিল দিল্লির জামিয়া বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, তারপর শাহীন বাগ , কলকাতার যাদবপুর, প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে পার্কসার্কাস । ছাত্রদের থেকে আন্দোলনের সুত্রপাত হলেও পরবর্তী সময়ে সমাজের মহিলারা আন্দোলনের দায়িত্ব সামলাচ্ছেন । বাড়িঘর সামলে সারারাত থাকছেন পার্কসার্কাস ময়দানে । শাহীনবাগের প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে পার্কসার্কাস । এটা গণতান্ত্রিক সমাজকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে , পরিস্থিতি এলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মহিলারাও আন্দোলনের নেতৃত্ব দিতে পারেন ।
‘ব্রহ্মা জানেন গোপন কম্ম টি’ এই ধরণের নারী বিষয়ক সিনেমার প্রেক্ষাপট কোনো দিনও বাস্তবায়িত হবে বলে আপনি মনে করেন ?
সিনেমাটি খুবই ইন্টেরেস্টিং । রিলিজ করে গিয়েছে খুব শিগগিরি দেখতে যাব । তবে একটা বিষয় মহিলা পুরোহিতের পুজো করার বিষয়টি চিরাচরিত ভাবনাকে ধাক্কা দেওয়ার মত ব্যাপার । পুজোর সঙ্গে ধর্ম ওতপ্রোত ভাবে জড়িত । আর ধর্ম নিয়েই যত গন্ডগোলের সুত্রপাত হয় । বিষয়টিকে আমি খুব বড়ো করে দেখি না ফলে পুরুষ পৌরহিত্য করুক বা মহিলা পৌরহিত্যই করুক, সেখানে সেই ব্রাহ্মন্য ধর্মের বিষয়টি এসেই যায় ।
আর মহিলা পৌরহিত্য করছেন ব্যাপারটি খবুই পজিটিভ । যদি সিস্টেমকে ভাঙতেই হয় তবে গোড়া থেকেই পাল্টাতে হবে, লাফ দিয়ে তো আর আধুনিক হওয়া যায় না ।
ফলে পুরোহিতগিরিতে কেবলমাত্র পুরুষদেরই অধিকার থাকবে এমনটা নয় সেখানেও মহিলাদেরও একটা অংশগ্রহণ থাকা দরকার ।
আমার মতো অনেকেই বিষয়টিকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখবে । তবে এখানেই শেষ নয় । ছোটবেলায় স্কুলে যখন সরস্বতী পুজো হত, তখন দেখতাম কেবলমাত্র ব্রাহ্মণ মেয়েদেরই আগ্রাধিকার থাকত । তাই বলছি কেবলমাত্র পৌরহিত্যের অধিকার দিয়েই নারীদের অধিকার শেষ কথা নয় । লড়াইটা আরো অনেক বড়ো ।