‘আমরা-ওরার দেওয়াল ভাঙার গল্প’…

বর্তমানে গোটা দেশ জুড়ে এক অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজমান। ধর্মকে হাতিয়ার করেই শাসক বনাম বিরোধী ঠান্ডা লড়াই চলছেই। সেই টানাপোড়েনের মাঝেই রাজনীতির ছক ভাঙা গল্প আমরা তুলে ধরব আপনাদের কাছে। লিখছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক অনুপম কাঞ্জিলাল। চোখ রাখুন #TheQuiry এর ওয়েবসাইটে।  প্রতি মঙ্গলবার রাত ৮ টা। 

||অনুপম কাঞ্জিলাল, সাংবাদিক||

গোটা দেশ জুড়ে এই মুহূর্তে এমন এক আবহ তৈরির চেষ্টা চলছে যেন মনে হয় এদেশে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষ পাশাপাশি থাকলেও কাছাকাছি ছিল না কোন দিন। যেন এই দুই সম্প্রদায় নিজেদের সম্পর্কের মাঝে আমরা -ওরার দেওয়াল দিয়েই রেখেছিল বরাবর।

সেই দেওয়ালের ভরসাতেই তো এদেশের বর্তমান শাসক দল এভাবে গোটা দেশ জুড়ে এক উগ্র হিন্দুত্বের জিগির তুলে তাদের ক্ষমতাকে নিশ্চিদ্র করে তোলার প্রক্রিয়া চালাতে পারে।

সেই ভরসাতেই তো খোদ রাজধানীর বুকে পুলিশ প্রশাসনকে পুতুলের মত দাঁড় করিয়ে রেখে সন্ত্রাসের বিস্তার এমন ভয়াবহ-ভয়ানক হয়ে ওঠার অবকাশ পায়।

গোটা কাশ্মীরের মানুষকে অবরুদ্ধ করে রেখে তাদের নাগরিকত্বের সব অধিকার ছিনিয়ে নিয়ে এই যে এক দেশ এক আইনের সোচ্চার ঘোষণা তার ভরসার কেন্দ্র স্থলও তো সেই আমরা-ওরার প্রচীরটাই।

আরও পড়ুনঃ মোদীর শাসনে সত্যিই ‘হিন্দুত্ব খাতরেমে’

দুই সম্প্রদায়ের মানুষের ব্যবধান তৈরি না করতে পারলে কী করেই বা হিন্দুত্ব আর জাতীয়তাবাদকে একাকার করে দেওয়া যাবে!তাই বুঝতে অসুবিধা নেই এদেশের বর্তমান শাসক দল অনেক ভাবনা চিন্তা করেই মাঠে নেমেছে।

তারা জানেন হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে যে ব্যবধান, তাকে কাজে লাগাতে পারলে এদেশের আম জনতা আর খেতে চাইবে না, চাকরি চাইবে না, স্বাস্থ্য পরিষেবা নিয়ে ভাববে না, শিক্ষা নিয়েও প্রশ্ন করতে ভুলে যাবে। সবার মগজে তখন একটাই কথা ধ্বণিত হবে,”মন্দির উঁহোই বনেঙ্গে”।

সব পরিকল্পনা করেই এগোচ্ছেন মোদী-অমিত শাহরা তাতে কোন সন্দেহ নেই। সন্দেহ থাকার কথাও না।কিন্তু প্রশ্ন হল যারা বিরোধীতা করতে চান তারা যথেষ্ট ভাবনা চিন্তা করে পথে নামছেন তো?

আমাদের মনে রাখা দরকার বিপদ কিন্তু একেবারে ঘাড়ের কাছে এসে পড়েছে তাই ভাল করে পর্যবেক্ষন ও ইতিহাস সচেতন হয়ে লডাইতে নামা দরকার।

দেশের শাসক দল যখন ব্যবধানকে উসকে দিতে চাইছে তখন তো ইতিহাসের পাতা থেকে আমরাও কিছু দৃষ্টান্ত তুলে ধরতে পারি, যেখানে হিন্দু-মুসলমানের আমরা-ওরার দেওয়াল ভেঙে শুধুই আমরা হয়ে ওঠার গল্প আছে। সেই সব গল্পের একটু প্রসার ও প্রচারই তো পারতো এই কঠিন সময়ে লডাইয়ের শক্ত হাতিয়ার হয়ে উঠতে।অনেকটা সময় চলে গেছে তবু সেই সব পুরনো গল্প আবার পড়তে বসলে মন্দ হয় না।

হিন্দু-মুসলমানের লড়াইয়ের গল্প যারা বলেন তারা ইতিহাসের অনেক তথ্য জানেন না। তারা জানেন না এদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে হিন্দু মুসলমান এক সঙ্গেও শহিদ হয়েছে। এরা ভুলে গেছে বিসমিল রামপ্রসাদ ও আসরাফউল্লা খানের বন্ধুত্বের কথা।

১৯২৭ সলের ১৯ ডিসেম্বর বিসমিল ও আসরাফউল্লার ফাঁসি হয়। কাকুড়ি ষড়যন্ত্র মামলায় এরা অভিযুক্ত ছিলেন। দুজনে ছিলেন অভিন্ন হৃদয়ের বন্ধু।একজন গোড়া হিন্দু অন্যজন নিয়ম মেনে নামাজ পড়া মুসলিম। তবে ধর্মীয় মতভেদ এঁদের বন্ধুত্বের পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়নি।

ইংরেজ সরকার অবশ্য এদের বন্ধুত্বের মধ্যেও সাম্প্রদায়িকতার বিষ ঢালতে চেষ্টার কসুর করেনি।

আসরাফউল্লাকে বলা হয়েছিল হিন্দু রামপ্রসাদের প্ররোচনাতেই সে ইংরেজবিরোধী ষড়যন্ত্রে জড়িয়ে পড়েছিলেন,এই মর্মে বিবৃতি দিলে তার শাস্তি মকুব করার কথা ভাবা যেতে পারে।

আসরাফউল্লা সেই প্রস্তাব খারিজ করে জানিয়ে দেয় বন্ধুর সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে বেঁচে থাকার চেয়ে রামপ্রসাদের বন্ধুত্বের স্বীকৃতি নিয়ে মরে যাওয়াকে তিনি অনেক বেশী সম্মানের বলে মনে করেন।

আরও পড়ুনঃ দেশ গড়তে ভোট দিন শিক্ষিত সজ্জন প্রার্থীকে

তারপর একইদিনে,একই সময়ে এই দুজন ফাঁসি কাঠে ঝুলে ভ্রাতৃত্বের জয় তিলক কপালে এঁকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যান। আজ যারা মুসলিমদের কটাক্ষ করে বলছেন ওরা পাকিস্তান বা বাংলাদেশে চলে যাক তারা শুধু আসরাফউল্লাকে নয় অপমান করছেন বিসমিল রামপ্রসাদকে।

শিবাজিকে যারা হিন্দুত্বের প্রতীক বলে চিহ্নিত করে তার বীরত্বের কাহিনি হিসেবে মুসলিম আফজল খানকে বাঘের নখ দিয়ে হত্যা করার গল্প শোনায় তারা জানেন না শিবাজিকে ওরকম রণসাজে সাজিয়ে পাঠিয়ে ছিলেন যিনি তিনি শিবাজির দেহরক্ষী।

আফজল খানের ষড়যন্ত্র অমুমান করে তিনি শিবাজিকে বাঘের নখ দিয়ে কীভাবে আক্রমন করতে হবে সে বিষয় প্রশিক্ষণও দিয়ে পাঠান।শিবাজির সেই দেহরক্ষীর নাম ছিল ইব্রাহিম সিদ্দিকি- হ্যাঁ তিনিও মুসলিম ছিলেন।

লড়াইটা তাই মোটেই হিন্দু বনাম মুলসিমের নয়। মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার সঙ্গে যারা মুসলিম ধর্মের অনুসঙ্গ মিশিয়ে দিতে চান তারা মনে রাখেন না মিরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার বলি হয়েছিলেন যিনি তিনিও মুসলিম ছিলেন। তাঁর নাম সিরাজউদুল্লাহ ।

আর সিরাজের সঙ্গে আজীবন যিনি জুরে ছিলেন তার নাম মোহনলাল, তিনি ধর্মে হিন্দু ছিলেন। হিন্দু মুসলমানের এই বেঁধে বেঁধে থাকার গল্প গুলো মনে রাখলে এতটা উগ্র সাম্পদায়িকতার জন্ম হত না।

এতটা বিপন্ন হতে হত না আমাদের ভারতীয় সংস্কৃতিকে। আমরা ওরার দেওয়াল ভাঙার এই গল্প শুধু ইতিহাসের পাতায় নয়, ছড়িয়ে আছে আমাদের প্রাত্যহিক জীবন যাপনের আনাচে কানাচেও।

আমাদের চারপাশের সেই সাম্প্রদায়িকতার দেওয়াল পেরনোর গল্প শোনাব আগামী সপ্তাহে।

এই প্রতিবেদনের সমস্ত দায় লেখকের নিজের। #TheQuiry কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই এর জন্য দায়ী না। 

সম্পর্কিত পোস্ট