“মহারাজা তোমারে সেলাম….”
শুভজিৎ চক্রবর্তী
“চারিদিকে ধু ধু করছে বালি, মাঝে মাঝে শুকনো ঘাস আর কাঁটা ঝোপ। এরই মধ্যে দিয়ে চলে গিয়েছে মিটার গেজের রেলের লাইন। দেখলে মনে হয় যার শুরুও নেই শেষও নেই। এই রেল লাইনের পাশ দিয়ে চলে গিয়েছে জয়সলমীর যাওয়ার মোটরের রাস্তা। লাইন যদি রাস্তা থেকে বেশী দুরে হত তাহলে শুটিং সম্ভব হত না।কারণ জয়সলমীরে আমাদের ডেরা। সেখান থেকে মালপত্র নিয়ে আসতে হবে শুটিংয়ের জায়গায়। উট যখন ট্রেনের দিকে ছুটে যাবে, তখন ক্যামেরাকেও ছুটতে হবে তার সাথে সাথে। ক্যামেরা চাপবে হুডখোলা জীপের ওপর। যোধপুর থেকে জয়সলমীর অবধি একশো মাইল রাস্তা চষে একটিমাত্র জায়গা পাওয়া গিয়েছিল যেখানে সব কিছু রয়েছে।”
সোনার কেল্লা ছবির বিখ্যাত দৃশ্য যেখানে উটকে নিয়ে একটি মজাদার ঘটনা রয়েছে। ফেলুদা এবং তপসে তড়াক তড়াক করে উটের পিঠে চড়ে বসল। কিন্তু রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাসের নির্মাতা তথা প্রখর রৌদ্রের শ্রষ্ঠা লালমোহন গাঙ্গুলি কুঁজোসমেত জীবটির পিঠে ওঠার আগেই ঘাম ঝড়িয়ে ফেললেন। তারপরেই ফেলু মিত্তির চেঁচিয়ে বললেন- “চলো রামদেওড়া”৷ যতবার সোনার কেল্লার ছবিটি দেখি ততবারই ওই মুহুর্ত এলেই হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যায়।
কিন্তু ওই উটের দৃশ্যের জন্য পরিচালক সত্যজিত রায়কে যে পরিমাণ কাটখড় পোড়াতে হয়েছিল তা আমাদের কারোর জানা নেই। তবে সিনেমা যে অনেক মানুষের মিলিত প্রোডাক্ট তা তিনি আদতে স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন।
গল্পকে কিভাবে চিত্রনাট্যে রূপান্তরিত করা যায়। আর সেই চিত্রনাট্যের কত রূপ হয় তা তিনি তাঁর লেখা এবং চিত্রনাট্যের চিত্রাঙ্কনের মাধ্যমে বুঝিয়ে দিয়েছেন।
“গল্প এবং উপন্যাস বইয়ে যেভাবে লেখা থাকে, সিনেমায় হুবহু সেভাবে তোলা কখনই সম্ভব নয়। অনেক বড় উপন্যাস আছে, যার পুরোটা ছবিতে রাখতে গেলে সেটা এত বড় হয়ে যাবে সে ছবি আর কেউ ধৈর্য্য ধরে বসে দেখবে না। পথের পাঁচালি বইয়ের সবটা ছবিতে রাখতে গেলে সেটা অন্তত দশ ঘন্টার ছবি হত।”
দুই বিশ্বযুদ্ধের পর মানুষের সৃষ্টি চেতনা যখন একেবারে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে গিয়েছে, তখন গ্রিফিথ, ষ্ট্রোহাইমদের মত বাস্তবের গল্প বলতে শুরু করল চলচ্চিত্র। সেই সময়ই “পথের পাঁচালি” হয়ে উঠল ভারতীয় এবং বাংলা ছবির ইতিহাসে এক অনবদ্য সৃষ্টি।
লকডাউনে তরুণ মন মজেছে স্বল্পদৈর্ঘ্যের ছবি তৈরীতে
গত বছরের শেষ দিকের কথা। গ্রন্থভারতীর প্রকাশকের সঙ্গে গল্প করতে করতেই উঠে এল সত্যজিৎ রায়ের কথা। শিশু সাহিত্যের জন্য মাণিকবাবু যা দিয়ে গিয়েছেন তা সত্যিই অনস্বীকার্য। মজার ছলে ছবি এঁকে ভুল ধরার কাজ দিয়ে বসতেন। ছবি আঁকা এবং লেখায় মাণিকবাবুর যে নিপুণ হাত রয়েছে সেটা আমাদের জানা।
আধাখ্যাঁচড়া মার্কা ত্রিলোকেশ্বর শঙ্কুকে কেমন দেখতে হবে আমরা থোড়াই জানতাম! ভাগ্যিস বিধুশেখরের শরীরটা তিনি আবিষ্কার করেছিলেন। নাহলে এর যে কত রূপ হত আর তার কত মহিমা হত তা আমাদের কল্পনার বাইরে।নিজে হাতে সন্দেশ পত্রিকার কভারবুক নির্মাণ করতেন। লেখায় লেখায় কাটাকুটিতে গড়ে তুলতেন নতুন ছবি। গুপি গাইনের ভুত বা সিংহাসনে বসে থাকা হীরকের রাজা, সবটাই তাঁর কল্পনায় তৈরি।
শুধুমাত্র বাংলা সিনেমার ইতিহাসে নয়, তৎকালীন বিশ্ব ইতিহাসেও এক নক্ষত্র হিসাবে রয়ে গিয়েছেন সত্যজিত রায়। জীবনের শেষ বয়সে এসে পেলেন বিখ্যাত অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড। সেটা শুধুমাত্র সত্যজিত রায়ের প্রাপ্তি নয়, সেটা ভারতীয় সিনেমার বিরাট প্রাপ্তি।
তাঁকে নিয়ে গল্প বলতে বলতে ৯৯ বছর কেটে গেল। তবুও গল্প শেষ হল না। যতদিন যাবে ততই আমাদের কাছে সত্যজিত রায় আরও বড় অধ্যায় হয়ে দাঁড়াবে। তাঁর কাজ আরও প্রাধান্য পাবে। নতুন শিল্পীর জন্ম নেবে তাঁকে দেখেই৷ যেখানেই থাকুন ভালো থাকুন এটুকু আশা রাখি।