দাদাদের কথা…
অমিতাভ চক্রবর্তী
আমি মহাত্মা গান্ধীর মতো ‘The Story of My Experiments With Truth’ লিখতে পারব না। একে তো আমি মহাত্মা গান্ধীর পায়ের নখের এক কণাও হতে পারব না, আর জীবনের সব সত্যি লেখার সাহস আমার নেই।
তবে আজ যা লিখব, সেটা একদম সত্যি। তাতে দলের কিছু অভ্যন্তরীণ দুর্বলতা আমায় লিখতে হবে, তবে সেটা না লিখলে এই লেখাটাই মূল্যহীন হয়ে যাবে।
প্রায় চার দশক আগে বহরমপুর থেকে কলকাতায় এসে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বালিগঞ্জ বিজ্ঞান কলেজের হোস্টেলে এসে উঠি। ক্যাম্পাসে ছাত্র পরিষদের কর্মী আর বাইরে কংগ্রেসের সব চাইতে দুর্বল জায়গা ‘গোষ্ঠী রাজনীতি’তে প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সির অনুগামী।
দল ভাঙার আগে পর্যন্ত আমরা প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি এবং মমতা ব্যানার্জির শিবিরেই ছিলাম। সুব্রতদা (সুব্রত মুখার্জী) কংগ্রেসে যোগদানের পরে সুব্রতদা’র অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ হয়েছিলাম।
প্রিয়দা অসুস্থ হয়ে যাওয়ার পরে সুব্রতদা’ই আমার সব কিছু হয়ে গিয়েছিলেন। আমার জ্বর হলেও আমাকে দেখতে বাড়িতে চলে আসতেন। তিনিও দল ছেড়ে দেওয়ায় একেবারে একা হয়ে গিয়েছিলাম। সেই সব কথা পরে এক দিন বলব।
আমি আগে সোমেনদা’র সঙ্গে রাজনীতি করিনি শুধু তা-ই নয়, তাঁর বিরুদ্ধেই কাজ করেছি। তাতে সোমেন মিত্র নামক মহীরুহের কিছু যেত আসত না কিন্তু তাঁর অনুগামীদের নিশ্চয়ই বিড়ম্বনা হত। সারা জীবন আমি যা কাজ করার চেষ্টা করেছি, সেটা ১০০ ভাগ করেছি। যুব কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি হয়েও(যে পদে এক সময় সোমেনদা’ও ছিলেন) সেটাই করেছি।
তখন সোমেন মিত্রের দাপট সারা বাংলায়। সেটা অতিক্রম করে বাংলার এক মফঃস্বল থেকে আসা যুবকের পক্ষে সংগঠন তৈরি করা যে কতটা কষ্টকর, সেটা আমি হাড়ে-হাড়ে টের পেয়েছি। যুব কংগ্রেস করলে পৌরসভা, পঞ্চায়েতের টিকিট পাওয়া যাবে না, এক রকম অলিখিত নির্দেশ জারি ছিল প্রদেশ কংগ্রেস দফতরের। তা সত্ত্বেও হাজার-হাজার ছেলেমেয়ে যুব কংগ্রেস করত।
সোমেনদা’র তথাকথিত বিরোধী হয়ে বিধান ভবনে বসে রাজনীতি করবে, সেটা কেউ ভাবতে পারত না। আমরা কিন্তু বিধান ভবনেই বসতাম, ওখান থেকেই যুব কংগ্রেসের কাজ করতাম। তবে সোমেনদা’র অনুগামীদের কল্যাণে প্রদেশ কংগ্রেস দফতরে একটা ফটোকপি করারও আমাদের অনুমতি ছিল না। এই সব কারণে আরও সোমেনদার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হত।
প্রিয়দা তখন দিল্লিতে খুবই ব্যস্ত নেতা, লোকসভায় দলের চিফ হুইপ, লোকসভায় সব দায়িত্বই তাঁর উপরে, তার পরে কলকাতা থেকে অনেক দূরে রায়গঞ্জে লোকসভা কেন্দ্র। সেই জন্য তিনি রাজ্যের দৈনন্দিন রাজনীতিতে থাকতেই পারতেন না।
অন্য দিকে সোমেনদা’কে সব সময় পাওয়া যায়। এই অসম লড়াইয়ে আমাদের অস্ত্র ছিল প্রিয়দা’র ছবি আর আমাদের পরিশ্রম। তবে প্রিয়দার রাজনৈতিক কৌশল এতটাই ক্ষুরধার ছিল যে, সেখান থেকেই আমি অনেক কিছু শিখে গেলাম আর এই প্রতিকূলতার মধ্যেও লড়াই চালিয়ে যেতে পারলাম।
সীমিত শক্তি নিয়ে, প্রদেশ কংগ্রেসের বিরোধিতা সত্ত্বেও অনেক বড়-বড় সভা আমরা করেছি। এমনকি, আমরা শহীদ মিনারেও সভা করেছি। কিন্তু কোনও সভাতেই সোমেনদা আসতেন না। আমি ৪৫ নং আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে প্রায়ই যেতাম সোমেনদা’কে আমাদের কর্মসূচিতে আনার জন্য কিন্তু তিনি আসতেন না তাঁর অনুগামীদের চাপে।
এর মধ্যে আমি যখন খুব অসুস্থ হলাম, মুম্বইয়ে টাটা ক্যান্সার হাসপাতালে ভর্তি, তখন প্রিয়দা’কে বলেছিলাম আমাকে যুব কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে অব্যাহতি দিতে কিন্তু প্রিয়দা শোনেননি সোমেনদা’র অনুগামীরা যথারীতি সক্রিয় হয়ে উঠল আমাকে সরিয়ে যুব কংগ্রেসের সভাপতি হওয়ার জন্য, সব চাইতে যেটা কষ্টের প্রিয়দা’র ঘরেও অনেকে আমার জায়গা নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হয়ে গেল (সেটা প্রিয়দাই আমাকে বলেছিলেন)।
কিন্তু আমি শুনেছিলাম, সোমেনদা তখন বলেছিলেন, কাল্টু অসুস্থ আমি ওকে সরানোর জন্য দিল্লিকে বলতে পারব না। তার পর থেকেই সোমেনদা’র সম্পর্কে আমার চিন্তা বদলাতে থাকে। তাঁর অনুগামীদের হতাশ করে ২০০৪ সালে সোমেনদা সটান চলে এলেন মেয়ো রোডের ২১শে জুলাই এর যুব কংগ্রেসের সমাবেশে।
তখন আমরা প্রতি বছর ২১শে জুলাই পালন করতাম রাস্তায় নেমে। সে দিন প্রিয়দা আর সোমেনদা হাত ধরে মঞ্চে দাঁড়ালেন, কর্মীদের কী যে উচ্ছ্বাস ছিল এখনও চোখে ভাসে। তদানীন্তন আনন্দবাজার পত্রিকার সাংবাদিক, সদ্যপ্রয়াত সঞ্জয় সিংহ অসাধারণ কপি লিখেছিলেন। তার পর থেকে সোমেনদা’র ৪৫ নং আমহার্স্ট স্ট্রিটের বাড়িতে যেতাম, সোমেনদা স্নেহ করতেন বুঝতাম।
যখন বলতাম, আপনি আর প্রিয়দা একসঙ্গে হাঁটলে দলের চেহারাটাই বদলে যাবে, শুনে মুচকি হাসতেন। কিন্তু তার পরেও দলের কুখ্যাত গোষ্ঠী রাজনীতির জন্য সোমেনদার সঙ্গে রাজনীতি করা হয়ে ওঠেনি!
প্রিয়দা প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি হওয়ার পরে সোমেনদা’র অতি ঘনিষ্ঠ লোকেরা যাদের জন্য সোমেনদা অনেক কিছু করেছিলেন, তাঁরা অনেকে প্রিয়দা’র দিকে চলে আসেন(তাঁদের মধ্যে অনেকেই সোমেনদা’র মরদেহে ফুল দিতেও আসেননি)। তার পরে সোমেনদাই কংগ্রেস ছেড়ে দেন।
আমি তখন দেখতাম প্রিয়দার গোষ্ঠীর মধ্যে কী উল্লাস, কিন্তু প্রিয়দা নিজে খুবই মর্মাহত হয়েছিলেন। একটা খুব গোপন কথা বলতে আজ কোনও দ্বিধা নেই, কারণ আজ প্রিয়দা সোমেনদা দু’জনেই নেই।
প্রিয়দার গোষ্ঠীর গোপন সভা হত মায়াদির(মায়া ঘোষ)বাড়িতে। সেখানে সবাই গোষ্ঠী রাজনীতির স্বার্থে সোমেনদা’র গোষ্ঠীকে কোনঠাসা করতেই চাইবে, এটাই রাজনীতি। কিন্তু প্রিয়দা আমাকে আগেই শিখিয়ে দিত সোমেনদা’র পক্ষে কী ভাবে এই বৈঠকগুলোতে কথা বলতে হবে, আর আমাকেই প্রথম বলার সুযোগ দিতেন। আমার বক্ত্যবের বিশ্বাসযোগ্যতা এই জন্যই ছিল যে, আমি প্রতিদিন সোমেনদা’র গোষ্ঠীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়েছি। তাই আমাকে দিয়েই সোমেনদার পক্ষে বলাতেন, কী অপূর্ব রাজনৈতিক শৈলী ছিল প্রিয়দার!
প্রিয়দা অসুস্থ হয়ে গেলেন, তার পরে সুব্রতদাও দল ছেড়ে দিলেন। রাজনীতির আকর্ষণটাই ধীরে ধীরে কমে যাচ্ছিল।
সোমেনদা’র কাছে যাওয়া-আসা শুরু হল, যখন তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর দূরত্ব তৈরি হচ্ছে। সন্তোষ পাঠক আমাকে নিয়ে গিয়েছিল সোমেনদার এ কে পয়েন্টের বাড়িতে।
তার পর থেকেই সোমেনদাকে নিয়ে অনেক সামাজিক কর্মসূচি পালন করেছি। তার পরে উনি যখন আবার কংগ্রেসে ফিরে এলেন, তখন আমি খুব খুশি হয়েছিলাম।
২০১৪-র লোকসভা নির্বাচনে কলকাতা উত্তর কেন্দ্র থেকে কংগ্রেসের প্রার্থী হলেন। নির্বাচনে সন্তোষের উৎসাহে আমরা পুরো টিম খুব পরিশ্রম করলাম।
নির্বাচনে সফল হলাম না ঠিকই তবে সোমেনদা’র ঘনিষ্ঠ হয়ে গেলাম। এটা সোমেনদা’র অনেক লোক ভাল ভাবে নিতে পারেননি। সম্পূর্ণ একটা মিথ্যা বদনাম দিয়ে সোমেনদা’র সঙ্গে আমার ভুল বোঝাবুঝি করে দেওয়া হল।
আমি আর সোমেনদা’র কাছে তার পর থেকে যেতাম না। তবে আমার শান্তি এটাই যে, সোমেনদা পরে তাঁর ভুল বুঝতে পেরে বিষয়টা আমাকে ভুলে যেতে বলেছিলেন।
এআইসিসি ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সোমেন মিত্রকে প্রদেশ কংগ্রেসের সভাপতি নিযুক্ত করে। একই সঙ্গে আমাকে প্রদেশ কংগ্রেসের মিডিয়া প্রধানের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আমি আগেই বলেছি, আজ সব সত্যি কথা লিখব। তাই বলছি, আমি অত্যন্ত অখুশি হয়েছিলাম। সোমেনদা সভাপতি হয়েছেন মানতেই পারছিলাম না। ঘোষণার সাত দিন পর্যন্ত প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির সঙ্গে দেখাই করিনি।
এখনও মনে আছে, আমি আর সন্তোষ পাঠক বিধান ভবনের পাঁচ তলায় গিয়ে এক দিন দেখা করলাম। দেখা হতেই সোমেনদা বললেন মিডিয়ার ব্যাপারটা তুমি দেখবে, অন্য কেউ নাক গলাবে না।
আমি তখনও ভাবছি, উনি নিশ্চয়ই কোনও একটা প্ল্যান করছেন। কয়েক দিন পরে আমি ওঁকে বললাম, বিধান ভবনে মিডিয়ার অফিস না হলে আমি কাজ করতে পারছি না। সোমেনদা তখনই অনুমতি দিয়ে দিলেন। আমি কমিউনিকেশন ডিপার্টমেন্টের অফিস বানিয়ে নিলাম সোমেনদা’র ঘরের সামনেই। অফিস তৈরির টাকাও দিতে গিয়েছিলেন যদিও আমি নিইনি। তখনও আমি সম্পর্ক সহজ করতে পারিনি। কারণ, তখন মড়ার উপর খাঁড়ার ঘায়ের মত যুব কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। যেখানে তাঁর পুত্র রোহন প্রার্থী, আর আমি সমর্থন করছি ওর বিপক্ষের প্রার্থী শাদাব খানকে। অর্থাৎ রোহনকে হারাবার চেষ্টা করছি।
প্রসঙ্গত, যুব কংগ্রেসের তিন বার অভ্যন্তরীণ নির্বাচন হয়েছে, তিন বারই আমি যে প্রার্থীকে সমর্থন করেছি, সে-ই জিতেছে। সারা দিন সোমেনদার সঙ্গে কাজ করছি আর উনি জানতেনও যে, যুব কংগ্রেসের নির্বাচনে আমি রোহনের বিরুদ্ধের প্রার্থীকে সমর্থন করছি কিন্তু কোনও দিন যুব কংগ্রেস নির্বাচন নিয়ে আমাকে একটাও কথা বলেননি। বললে ধর্ম সঙ্কটে পড়তাম।
এক দিকে আমি যাঁকে এক বার কথা দিয়ে ফেলি, সেখান থেকে পিছিয়ে যাই না। অন্য দিকে, প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির আদেশ। আমি কী করতাম, জানি না! তবে সভাপতি আমাকে ধর্ম সঙ্কট থেকে রক্ষা করেছিলেন।
আমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছিলাম যে, রোহন কিছুতেই জিততে পারবে না। কারণ, ওর যাঁরা মেন্টর, তাঁরা যুব কংগ্রেসের নির্বাচনের পদ্ধতিটাই জানেন না। রোহন খুব ভাল ছেলে। শিক্ষিত, মার্জিত এবং চার্মিং। ওর জন্য খারাপ লাগত। ঈশ্বরকে ডাকতাম, ও যেন নাম প্রত্যাহার করে নেয়। আমার স্পষ্ট মনে আছে, যে দিন ও হেরে গেল, সে দিন সন্ধ্যায় সোমেনদা আমাকে ফোন করেছিলেন। ফোনটা ধরতে ইতস্ততঃ করছিলাম কিন্তু ধরার পরে কয়েকটা কাজের কথা বলে ফোনটা ছেড়ে দিলেন। যুব কংগ্রেস নিয়ে একটা কথাও বললেন না। সে দিনই আমার তাঁর সঙ্গে যাবতীয় দূরত্ব ঘুচে গেল। আর তার পর তো বিধান ভবনের সবাই জানে, মিডিয়া ছাড়াও অন্য বিষয়েও আমাকে দায়িত্ব দিতে শুরু করলেন। আর রোহন তো এখন আমার ছেলের মতোই।
সোমেনদা বলেই দিয়েছিলেন, ওঁর মিডিয়ার স্টেটমেন্ট আমিই করব। ১০০ ভাগ স্বাধীনতা দিয়েছিলেন আমাকে। আমিও তাঁকে উজাড় করে আমার শ্রম, বুদ্ধি দিয়েছি। মিডিয়া ছাড়াও সব আন্দোলন এবং কর্মসূচির সিদ্ধান্ত, পোস্টার কী হবে, স্টেজ কী হবে, সব আমার উপরে ছেড়ে দিতেন। এমনকী, বামফ্রন্টের সঙ্গে মিটিংয়ের মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজের কাগজও আমাকে তৈরি করতে বলতেন। বাদলদা আর পঙ্কজকে বলাই থাকত, এআইসিসি-র কোনও সার্কুলার এলে যেন আমাকে পাঠানো হয়।
বয়স হয়েছিল, শরীরটাও ভাল ছিল না তাই অনেক সময় সাংবাদিক সম্মেলনে পয়েন্ট মিস করে যেতেন। আমি সংবাদমাধ্যমের কাছে গিয়ে নেতার পাশে বসে পড়া কোনও দিনই পছন্দ করি না। কিন্তু আমার উপরে নির্দেশ থাকত তাঁর পাশে বসার জন্য, আমি তার টেলি-প্রম্পটারের মতো কাজ করতাম।
দেকোনও পয়েন্ট মিস করলে অভিজ্ঞতা দিয়ে ম্যানেজ করে নিতেন। আমিও শ্লাঘা বোধ করতাম যে, সোমেন মিত্রের মতো নেতার খুঁটিনাটি কাজ আমি করছি। পরের দিকে আমাকে একলা পেলে অনেক ব্যক্তিগত কথাও বলতেন, সে কথাগুলো কোনও দিনও কেউ জানতে পারবে না, আমার পরিবারেরও কেউ না। আমি কলেজ স্ট্রিট অঞ্চলে থাকি, এই সব পাড়ায় সোমেনদা প্রায় প্রতিটি বাড়িতে চাকরি দিয়েছেন, কত মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন, কত লোককে নেতা বানিয়েছেন কিন্তু তাঁরাই সোমেনদাকে পেছন থেকে ছুরি মেরেছে, সোমেনদা’কে ভোট দেয়নি। কিন্তু সোমেনদা’র মৃতদেহ নিয়েও যা আবেগ দেখলাম, সে জন্যই সোমেনদা’র মত মানুষরা সাধারণের থেকে অন্য উচ্চতায় থেকে যাবেন।
আমার মনে পড়ে, প্রিয়দা দেশে থাকুন অথবা বিদেশে আমার কাছে প্রতিদিন তাঁর একটা ফোন আসতই। সোমেনদা’ও প্রায় প্রতি দিনই ফোন করতেন। যদি কোনও দিন ফোন না আসত, তা হলেই চিন্তা হত শরীরটা খারাপ হয়নি তো? খুব কম সময়ের মধ্যেই তাঁর সঙ্গে মানসিক ভাবে একাত্ম হয়ে গিয়েছিলাম। এখন মনে হয়, আগের মতো ঝগড়া থাকলেই ভাল হত! তা হলে তো এই কষ্টটা আমাকে পেতে হত না!
সোমেনদা’র পুরোনো অনুগামীদের অনেকেই আমার প্রতি তাঁর নির্ভরশীলতা মেনে নিতে পারতেন না। আগের বারের মতোই চেষ্টা করেছিলেন আমাকে দাদার থেকে দূরে সরাতে। সোমেনদা এ বার খুবই সতর্ক ছিলেন, বিধান ভবনে তাঁর ঘরে আমাকে ডেকে পাঠিয়ে মজা করে বলতেন আজ তোমার বিরুদ্ধে ডেপুটেশন হল। ডেপুটেশনকারীদের বললাম, আমাকে আর একটা কাল্টু এনে দে অথবা কাল্টু যে দক্ষতায় কাজ করে, সেই কাজটা করে দে। তখন আমি এই কাল্টুকে বলব, আমার কাজ না করতে! আবার হেসে বলতেন, আমার কথা শুনে সবাই পালিয়ে গেল!
বিধান ভবনে আপনার প্রাণহীন দেহ কী ভাবে থাকবে, তার পরিকল্পনা আমিই করেছি। ফ্লেক্সে কী লেখা হবে, কোথায় টাঙানো হবে সেটাও।
ভোরবেলায় বেলভিউ নার্সিং হোম থেকে প্রেস রিলিজ আমিই করেছি কিন্তু যার জন্য করছি, সেই তো নেই! সোমেনদা আপনি জানেন, আমার কত কষ্ট হচ্ছিল। চ্যানেলের বুমগুলো যখন ওরা আমার সামনে আনছিল, তখন আপনি জানেন আমার কথাগুলো গলার কাছে দলা পাকিয়ে যাচ্ছিল! বিধান ভবনে আপনার প্রাণহীন দেহটার সামনে থেকে পালিয়ে যেতে ইচ্ছে করছিল কিন্তু অনেক অতিথি আপনাকে শেষ দেখা দেখতে এসেছিলেন, সেই কর্ত্যবের জন্যই চোখের জল চেপে দাঁড়িয়ে থাকা কত কষ্টের আপনি জানেন, সোমেনদা।
প্রিয়দা চলে গেলেন, সোমেনদাও চলে গেলেন। সুব্রতদা বিধান ভবনে এসেছিলেন সোমেনদাকে শেষ দেখা দেখতে। আমি নেতা হতে পারিনি ঠিকই, অন্য দলের খাতায় নাম লিখিয়ে এমএলএ-এমপি হইনি কিন্তু বাংলার কংগ্রেসের খুব চেনা শব্দবন্ধ ‘প্রিয়-সুব্রত-সোমেনের’ বিশ্বাস অর্জন করতে পেরেছি। কটা কংগ্রেস কর্মীর এই সৌভাগ্য হয়?
সোমেনদা অনেক লোককে রাস্তা থেকে তুলে নেতা বানিয়েছেন, অনেককে বহু কিছু করে দিয়েছেন। আমি জানতাম এখন দাদার সেই দিন নেই, তাঁর কাছে আমার চাওয়ার কিছু ছিলও না।
এখন ভাবি, আমার মতো তাঁর সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে থাকা এক জন মানুষকে কী ভাবে নিজের কাছে নিয়ে এলেন! কত বড় নেতা আর কত বড় মনের মানুষ হলে এই কাজটা করা সম্ভব। দাদা যে দিন থেকে আমার মাথায় আপনি হাত দিয়েছেন, সে দিন থেকে আমি জ্ঞানত কোনও কাজ করিনি, যাতে আপনার ক্ষতি হয়। অজান্তে কোনও ভুল করে থাকলে আমায় ক্ষমা করে দেবেন।
যেখানে এখন আপনি আছেন, আপনার পুরনো বন্ধু প্রিয়কে খুঁজে নেবেন। বলবেন, আমরা ভাল নেই। আপনারা এত কষ্ট কেন দেন আমাদের?