সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের রাজনীতিকে প্রত্যাখ্যান দিল্লি্র, হ্যাটট্রিক কেজরির

দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে প্রত্যাশিত জয় পেল আম আদমি পার্টি (আপ)। ফের ক্ষমতায় এলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল।প্রায় সব এক্সিট পোলই এগিয়ে অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপ

।। দিলীপ রায় ।। 

দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে প্রত্যাশিত জয় পেল আম আদমি পার্টি (আপ)। ফের ক্ষমতায় এলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল।প্রায় সব এক্সিট পোলই অরবিন্দ কেজরিওয়ালের আপকে এগিয়ে রাখলেও উগ্র হিন্দুত্ববাদ দিয়ে বাজিমাত করার স্বপ্ন দেখেছিলেন বিজেপির নেতারা।

দিল্লির ৮০ শতাংশ ভোটকে নিজেদের পক্ষে টানার টার্গেট করে গেরুয়া শিবির। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ থেকে শুরু করে বিজেপি সভাপতি জেপি নাড্ডা, উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর নির্বাচনী প্রচারে সরাসরি বা ঘুরিয়ে বিভাজনের তাসই খেলেন।

এদের প্রায় প্রত্যেকেই প্রচারে সিএএ-এনআরসি বিরোধীদের পাকিস্তানের সমর্থক বলে চিহ্নিত করেন। টুকরে টুকরে গ্যাংকে শিক্ষা দেওয়ার নির্বাচন বলেন। শাহিনবাগ আন্দোলনকে কেজরিওয়াল মদত করছেন উল্লেখ করেন। এর ফলে যাতায়াতের সমস্যার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। জামিয়া থেকে জেএনইউকে দেশদ্রোহীদের আখড়া বলে উল্লেখ করেন।

এক বিজেপি নেতা গদ্দারদের গুলি করে মারার দাওয়াই দেন। প্রচারে অপর এক বিজেপি নেতা বলেন, শাহিনবাগের প্রতিবাদীরা হিন্দু এলাকায় ঢুকে মা-বোনদের ধর্ষণ করবে।

এই নির্বাচন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বলেও প্রচারে গলা ফাটান বিজেপি নেতারা। এছাড়াও দিল্লি ভোটে বিজেপি নেতাদের ইস্যু ছিল পাকিস্তান, রামমন্দির, ৩৭০ রদ।

মুসলিমদের গদ্দার, ধর্ষক বলে চিহ্নিত করে হিন্দু ভোট টানার জন্য নানা বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করেও প্রচারে ঝড় তোলে গেরুয়া শিবির।

আরও পড়ুনঃ এবার এজিএমইউটির আওতায় নিয়োজিত হবেন জম্মু-কাশ্মীরের আইপিএস, আইএফএস এবং আইএএস অফিসাররা

সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের তাস খেলে প্রচারের আসর গরম করেন একঝাক কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এবং বিভিন্ন রাজ্যের বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী। ভোট প্রচারে নামেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহও।

মোদি দুটি জনসভা করেন। অন্যদিকে, অমিত শাহ ৪৭টি জনসভা, এবং বিজেপি সভাপতি নাড্ডা ৪০টি জনসভা করেন। এছাড়াও একাধিক জনসভা করেন যোগী আদিত্যনাথ, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর, একাধিক বিজেপি মুখ্যমন্ত্রী সহ বিজেপির শীর্ষ নেতারা। হিন্দুত্বের এজেন্ডাকে সামনে রেখে এই ভোটে মেরুকরণের প্রচেষ্টা চালান তাঁরা।

কিন্তু বিজেপির এই প্রচেষ্টা সফল হল না। কেজরিওয়ালের ‘কাম পে ভোট’-এর ডাকে সাড়া দিলেন দিল্লির মানুষ। প্রত্যাখ্যান করলেন বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতি। আপ সরকারের জনমুখি পরিকল্পনাকে স্বাগত জানালেন মানুষ।

কেজরিওয়াল সরকার দিল্লির নাগরিকদের জন্য জল (পর্যাপ্ত সরবরাহ, ৭০০ লিটার পর্যন্ত বিনামূল্যে), আলো (সর্বস্তরের মানুষের জন্য ২০০ ইউনিট বিদ্যুৎ ফ্রি), শিক্ষা (সরকারি স্কুল ভবনের উন্নয়ন, সিসিটিভি, সুইমিং পুল, নিয়মিত শিক্ষক, বিনামূল্যে শিক্ষা, বইখাতা, পরীক্ষার আগে পড়ুয়ার পাশাপাশি বাবা-মায়ের কাউন্সিলিং, এক্সট্রা ক্লাস, বেসরকারি স্কুলকে ফি কমাতে বাধ্য করা), স্বাস্থ্য (সরকারি হাসপাতালে বিনামূল্যে চিকিৎসা, ওষুধ, পাড়ায় পাড়ায় মহল্লা ক্লিনিক), পরিবহণ (সরকারি বাসে মেয়েদের বিনামূল্যে যাতায়াতের ব্যবস্থা) নিশ্চিত করেছে।যার ফলে ফের আপকেই ভোট দিয়েছে দিল্লির মানুষ। যদিও আপের আসন কমেছে, শতাংশের বিচারে কমেছে ভোট।

২০১৫ সালে ৭০ আসনের দিল্লি বিধানসভায় ৬৭ আসন জিতেছিল আপ। ভোট পেয়েছিল ৫৪ শতাংশ। এবার এখনও পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী ৫৩.১৭ শতাংশ ভোট পেয়েছে আপ।

অন্যদিকে, বিজেপি ২০১৫ তে পেয়েছিল ৩২ শতাংশ। এবার এখনও পর্যন্ত পাওয়া হিসাব অনুযায়ী ৩৮.৮২ শতাংশ ভোট পেয়েছে বিজেপি। উল্লেখ্য, ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে দিল্লিতে বিজেপি পেয়েছিল ৫৪ শতাংশ ভোট।

সেই হিসাবে দেখলে উন্নয়নের পক্ষেই ভোট দিয়েছেন মানুষ। আর এভাবেই বিজেপির মেরুকরণের রাজনীতিকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে দিল্লির ফলাফল।

আরও পড়ুনঃ শাহিনবাগ ছাড়া কোনও ইস্যু নেই, তাই এই ষড়যন্ত্র করছে বিজেপিঃ কেজরিওয়াল

যদিও উত্তরপ্রদেশ ছাড়া অন্যান্য যেসব রাজ্যে গত দুবছরের মধ্যে বিধানসভা ভোট হয়, সেখানেও বিজেপির উগ্র হিন্দুত্বের এজেন্ডাকে প্রত্যাখ্যান করেন মানুষ। হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ মধ্যপ্রদেশ, রাজস্থান, ছত্তিশগড় ও ঝাড়খন্ড-এ বিজেপির এই এজেন্ডাকে প্রত্যাখ্যান করেন ভোটাররা।

ক্ষমতা ধরে রাখতে পারলেও হরিয়ানা ও গুজরাটে কমে যায় আসন। দিল্লিতে হিন্দুত্বের সেই এজেন্ডা আবারও ফেল করল।

রামমন্দির, ৩৭০, পাকিস্তান ইস্যু যে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, জল, আলো, বিদ্যুতের সমস্যার কাছে অতি তুচ্ছ, সেই বার্তা দিলেন দিল্লির ভোটাররা।

২০১৪ পর থেকে মুসলিমদের টার্গেট করে গেরুয়া শিবিরের হিংসাত্মক কার্যকলাপ, গরুর মাংস বা গরু পাচারের অভিযোগে মব লিঞ্চিং বা গণপিটুনির ঘটনা, লাভ জেহাদের অভিযোগ তুলে হত্যার ঘটনায় সাধারণ মানুষের যে সায় নেই তা প্রমাণ করল দিল্লি বিধানসভা নির্বাচন।

সম্পর্কিত পোস্ট