সরকার পোষিত দাঙ্গা ‘দিল্লি’ হতে পারে বাংলায়, আশঙ্কা তথ্যাভিজ্ঞ মহলের একাংশের

।। দিলীপ রায় ।। 

সরকার পোষিত দাঙ্গা ‘দিল্লি’ ঘটতে পারে বাংলায়। এমনই আশঙ্কা করছেন তথ্যাভিজ্ঞ মহলের একাংশ। তাঁদের কথায়, ২০১১ সালে রাজ্যে পালাবদলের পর এ রাজ্যে রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘ (আরএসএস)-এর শাখা অনেক বেড়ে গিয়েছে।

সংঘের এই শক্তিবৃদ্ধিতেই প্রমাদ গুনছেন তাঁরা।বিগত কয়েক বছর ধরে রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে মহা সমারোহে পালিত হয়েছে রামনবমী। কিন্তু তা নিয়ে কারও কোনও আপত্তি না থাকলেও রামনবমীর মিছিলে অস্ত্র আস্ফালন দেখে, ‘হয় জয় শ্রীরাম বলতে হবে, নয় তো ভারত ছাড়তে হবে’ শ্লোগান শুনে শিহরিত হয়েছেন গ্রামবাংলার ও মফঃস্বলের মানুষ।

আর এরপরই একে একে বসিরহাট, বৈষ্ণবনগর, ধূলাগড়, জগদ্দল-কাকিনাড়া, রানিগঞ্জ, দত্তপুকু্রের মতো বেশ কিছু অঞ্চলে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে গিয়েছে।দীর্ঘদিন পাশপাশি বসবাসের পরও গড়ে উঠছে অবিশ্বাসের বাতাবরণ।

আরও পড়ুনঃ দিল্লি দাঙ্গার নিন্দা, শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার সুরক্ষায় আবেদন বিজ্ঞান গবেষক-পড়ুয়াদের

অন্যদিকে ক্রমাগত হুঙ্কার বেড়েছে বিজেপি নেতাদের। বিজেপি রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষ নানা ইস্যুতে ক্রমশই মুসলিমদের বিরোধিতায় সুর চড়িয়েছেন। তাঁদের ‘বিদেশী’ ‘অনুপ্রবেশকারী’ আখ্যা দিয়েছেন। গুলি করে মারার নিদানও দিয়েছেন।বিজেপির ছোট-বড় নেতারা বিভিন্ন সভায় অনবরত বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রেখে চলেছেন।

বিশেষত বাংলার সীমান্ত এলাকায় ছড়াচ্ছে বিদ্বেষ।কিন্তু রাজ্য সরকার বিজেপি নেতাদের আপত্তিকর এইসব বক্তব্যের বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নিচ্ছে না। বিজেপি নেতাদের বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের বিরুদ্ধে থানায় অভিযোগ জানাতে গেলে পুলিশ তা গ্রহণ করছে না বলেও অভিযোগ।

দিল্লির মুসলিম অধ্যুষিত উত্তর পূর্বাঞ্চলকে টার্গেট করে দীর্ঘদিন আগে থেকেই জমি তৈরির চেষ্টা করছিল গেরুয়া শিবির।মুসলিমদের ‘দেশবিরোধী’, ‘গদ্দার’, ‘পাকিস্তানপন্থী’ দেগে দেওয়ার কাজ চালিয়ে গিয়েছেন বিজেপি নেতারা।

দিল্লিতে নির্বাচনি প্রচারে বিজেপি নেতা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী অনুরাগ ঠাকুর ‘দেশ কি গদ্দারোকো গোলি মারো শালেকো’ শ্লোগানে নেতৃত্বও দিয়েছেন। আর দিল্লিতে দাঙ্গার সূচনা হয় বিজেপি নেতা কপিল মিশ্রের সিএএ বিরোধী বিক্ষোভ সমাবেশ তুলে দেওয়ার ‘আল্টিমেটাম’ (সময়সীমা)-এ। তিনদিনের মধ্যে প্রতিবাদীদের সরিয়ে দিয়ে রাস্তা খালি করার আল্টিমেটাম দিয়ে

পুলিশকে তিনি বলেন, এটা না হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। ট্রাম্প সফর সেরে চলে যাক, তারপর দেখা হবে।এরপরই দিল্লির ওই অংশের দীর্ঘদিনের বাসিন্দা মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর নৃশংস আক্রমণ নেমে আসে। ঘরবাড়ি, মসজিদে আগুন দেওয়া হয়। সংঘর্ষে মারা যান ৪২ জন, জখম হন ২০০-র বেশি মানুষ।

আরও পড়ুনঃ দিল্লি হাইকোর্টে সোনিয়া-রাহুল-প্রিয়াঙ্কার বিরুদ্ধে জনস্বার্থ মামলা

ভয়াবহ এই ঘটনায় বিজেপি নেতা অনুরাগ ঠাকুর, প্রবেশ বার্মা ও কপিল মিশ্রের বিদ্বেষমূলক বক্তব্যের ভিডিও ফূটেজ পেশ করে এদের বিরুদ্ধে পুলিশকে এফআইআর করার নির্দেশ দেওয়ার জন্য দিল্লি হাইকোর্টে আবেদন জানান গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা কর্মী হর্ষ মান্দার।

আদালতের বিচারপতি মুরলিধর ২৪ ঘণ্টার মধ্য ওই তিন অভিযুক্তের বিরুদ্ধে এফআইআর করার জন্য পুলিশকে নির্দেশ দেওয়ায় তাঁকে মধ্যরাতে বদলি করে দেওয়া হয়। স্পষ্ট হয়ে যায় যে, অপরাধীদের আড়াল করছে কেন্দ্রীয় সরকার।সেই সঙ্গে এটাও স্পষ্ট হয়, এই দাঙ্গা সরকারের মদতেই হয়েছে। এইরকম বাংলাতেও ঘটতা পারে বলে মনে করছেন রাজনীতিকরা।

শুক্রবার এ বিষয়ে সিপিএম নেতা মহম্মদ সেলিম বলেন, বাংলা তো টার্গেট। অবশ্যই  বাংলায় দিল্লির মতো ঘটনা ঘটতে পারে।এটা হল  গোটা দেশেই এইরকম পরিস্থিতি তৈরি করার একটা প্রস্তুতি।বাংলা তো অবশ্যই টার্গেট।

আর টার্গেটের অংশ হিসাবে পরিকল্পিত ভাবে এই ধরনের নেতৃত্ব তৈরি করা হয়, যে জনপ্রিয় হবে, অথচ যে রাজনৈতিক অবস্থান স্পষ্ট করবে না। যে নাটুকেপনা করবে, কিন্তু সংঘ পরিবারের মূল যে ভিত্তি বিভাজনের রাজনীতি্র, সেটাকে চ্যালেঞ্জ করার বদলে সেও সেই রাজনীতির কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করবে এবং পরিপূরক হিসাবে ভূমিকা পালন করবে।

মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এই কাজটা করেছেন, এজন্যই তৃণমূল কংগ্রেস হয়েছে।আর এইজন্যই অমিত শাহ সদর্ভে ঘোষণা করেছেন, এবার লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গ।তাঁর দাবি, এই কারণেই এ রাজ্যে দিলীপ ঘোষ, সায়ন্তন বসুরা যখন ঘৃণা ছড়াচ্ছিল, তখন এফআইআর পর্যন্ত নেয়নি পুলিশ, ব্যবস্থা নেয়নি রাজ্য সরকার।

আরও পড়ুনঃ দিল্লি কমিশনার পদে রদবদল, নতুন কমিশনার হলেন এসএন শ্রীবাস্তব

পাশাপাশি, সোমেন মিত্রও মনে করেন বাংলাতেও যেকোনও মূহুর্তে দিল্লির মতো ঘটনা ঘটতে পারে।কারণ, সরকার তো সাইলেন্ট। দিল্লি নিয়ে রাজ্য সরকার এখনও একটা প্রতিবাদ করল না। এ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী এত কথা বলেন, কিন্তু এনিয়ে কিছু বললেন না। এতবড় ঘটনা নিয়ে চুপ করে আছে। কোনও কথা বলছে না। দিল্লির ঘটনাকে সরকারি মদতে দাঙ্গা উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাতেও এমন ঘটনা ঘটতে পারে।

দিল্লির দাঙ্গাকে রাষ্ট্র পোষিত দাঙ্গা বলে উল্লেখ করেন নাগরিক অধিকার আন্দোলনের সংগঠক সুজাত ভদ্র। তিনি বলেন, গুজরাট মডেলে  প্রশাসনকে নিষ্ক্রিয় রেখে দাঙ্গা করা হয়েছে। বাংলাতেই শুধু নয়, দেশের যেকোনও প্রান্তে ‘দিল্লি’ ঘটতে পারে। তবে পশ্চিমবঙ্গের পরিস্থিতি ততটা সঙ্কটজনক নয় বলে জানান তিনি।

অন্যদিকে তৃণমূল নেতা, রাজ্যের মন্ত্রী রবীন্দ্রনাথ ঘোষ বলেন, আমাদের মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। বিজেপির পাতা ফাঁদে পা দেওয়া যাবে না। সতর্ক থাকতে হবে। কেউ বিদ্বেষমূলক বক্তব্য রাখলে পুলিশের কাছে গিয়ে অভিযোগ জানাতে হবে। প্রশাসন এনিয়ে সতর্ক আছে। আমাদেরও সতর্ক থাকতে হবে। থানা এফআইআর নেয় না, কংগ্রেস-সিপিএমের এই অভিযোগ মেনে নেননি তিনি।

অন্যদিকে, দিল্লির ঘটনায় বলেন, সেখানে এমন কিছু করার পরিকল্পনা বিজেপির ছিল। নির্বাচনে হারার পর সেটা করল বিজেপি।

সম্পর্কিত পোস্ট