মমতার পর বৈতরণী পার করতে ভরসা রাজীব-শুভেন্দু

সহেলী চক্রবর্তী

ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছে ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচন। একটা করে দিন যতই এগিয়ে আসছে ততই রাজনৈতিক লড়াইটা কঠিন হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

কথায় আছে, ‘একে রামে রক্ষে নেই, সুগ্রীব দোসর’। অর্থাত রাজনৈতিক ময়দানে বাম-কংগ্রেস জোট ও গেরুয়াবাহিনীর তান্ডব তো ছিলই। বাড়তি হিসাবে সেখানে যুক্ত হয়েছে করোনা পরিস্থিতি। যা নিয়ে শাসকদলকে প্রত্যেক মুহুর্তে কাঠগড়ায় তুলছে বিরোধীরা।

সাঁড়াশি চাপের মাঝেই বিধানসভা নির্বাচনের প্রাক্কালে দলের শুদ্ধিকরণের কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

নবীন-প্রবীণের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে কমিটি।অপ্রত্যাশিতভাবে অনেকেই নতুন দায়িত্ব পেয়েছেন। তারপর কীভাবে তারা ওয়ার্ক স্ট্র্যাটেজি সাজাচ্ছেন তার বিশদ ব্যাখ্যা না দিলেও কিছু ইঙ্গিত দিচ্ছেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে কতটা তারা সাফল্য পাবেন?

রাজনৈতিক মহলের মতে, সম্প্রতি যে রাজ্য কমিটি ও কোর কমিটি গঠন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী সেখানে কোথাও যেন দলের একনিষ্ঠ কর্মী, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি এবং সাংগঠনিক নৈপুণ্যের দিক থেকে যোগ্যতার নিরিখে খানিকটা উপেক্ষিতই থেকে গেলেন রাজ্যের দুই দাপুটে মন্ত্রী। তাঁরা হলেন বনমন্ত্রী রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায় ও সেচমন্ত্রী শুভেন্দু অধিকারী।

১৯ এ লোকসভা নির্বাচনে আশানুরুপ ফল না হলেও খড়গপুর সদর, কালিয়াগঞ্জ ও করিমপুরে উপনির্বাচনের ফলাফলে বেশ কিছুটা চাঙা হয় ঘাসফুল শিবির। যার মধ্যে দুটি সিটের(কালিয়াগঞ্জ ও করিমপুর) কারিগর রাজীব ও একটি সিটের(খড়গপুর সদর) কারিগর শুভেন্দু অধিকারী।

রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ঃ

উপনির্বাচনে তৃণমূল নেত্রীকে টাফ ফাইটে জিতে দুটি সিট উপহার দেওয়ার পাশাপাশি দক্ষিণ দিনাজপুরে বিপ্লব মিত্র দলবদলের পর জেলায় সংগঠনকে কাদা মাটি থেকে কংক্রিটে পরিণত করেন সেই রাজীবই।

লোকসভা নির্বাচনে উত্তরবঙ্গ হাতছাড়া হয়ে যায় শাসকদলের। তারপর ফালাকাটা উপনির্বাচনে দায়িত্ব দেওয়া হয় রাজীবকে। সম্প্রতি আলিপুরদুয়ারের প্রসাশনিক বৈঠকে কড়া বার্তা দিয়েছেন দলের কর্মী সমর্থকদের। কোনোভাবেই দুর্নীতি বরদাস্ত করা হবে না। প্রয়োজনে দল থেক বহিস্কার করার বার্তাও দেন তিনি। রাজীবের এই বার্তার পরই দল পুরোনো অবস্থা কাটিয়ে ছন্দে ফিরেছে তা বলাই বাহুল্য।

এরপর আমফান পরবর্তী পরিস্থিতিতে নদীয়ার পাশাপাশি মালদহ, উত্তর ও দক্ষিণ দিনাজপুর পরিদর্শনের দায়িত্ব পড়ে সেই রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাঁধেই।

দুঁদে রাজনীতিবিদ রাজীব সেচমন্ত্রীর দায়িত্ব পাওয়ার পর বদলে দিয়েছিলেন খোলনলচে। যার দরাজ সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন নেত্রী স্বয়ং।

যখন যে দফতর সামলানোর গুরু দায়িত্ব পেয়েছেন, তখন সেখানেই নিজের দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন।

বনদফতরের দায়িত্ব পেয়ে কড়া দৃষ্টি দিয়েছেন বনজ সম্পদ লুঠের দিকে। একাধিক বার বলতে শোনা গেছে “বালি চোরদের ধরতে যেমন ছদ্মবেশ নিয়েছিলাম, বনজ সম্পদ চুরি রুখতেও সেই পন্থা অবলম্বন করব”।

বরাবরের স্পষ্ট বক্তা রাজীব কখনোই আপোশ করেননি দুর্নীতির সঙ্গে। সম্প্রতি হাওড়ায় অরুপ রায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে দেখা গিয়েছিল তাঁকে। তা নিয়ে অবশ্য বিবাদ চরমে ওঠে দলেরই অন্দরে।

তবে মুখ্যমন্ত্রীর ভূমিকা ছিল কিন্তু রাজীবেরই পক্ষে, তা তিনি রদবদল করেই বুঝিয়ে দিয়েছেন।

মন্ত্রক সামলানোর পাশাপাশি, দলের সাংগঠনিক শক্তি মজবুতের করা আবার ভারতীয় সেনা জওয়ানদের প্রতি কুর্নিশ জানাতে কখনও গান,কখনওবা আবৃত্তি। সবজায়গাতেই বিরাজমান রাজীব।

ম্যানেজমেন্টের ছাত্র রাজীব রাজনীতিতেও সিদ্ধহস্ত। জনান্তিকে কান পাতলেই শোনা যায় শ্রীরামপুরের সাংসদ কল্যান বন্দ্যোপাধ্যায় ‘সাংসদ’ হয়েছেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের ক্যারিশমায়।

করোনা ও আমফান পরিস্থিতিতে অসহায় মানুষের পাশে যেমন থেকেছেন, তেমনি নিজে হাতে খাবার তুলে দিয়েছেন অবলা প্রাণীদের মুখে।

রাজীবের রাজনীতির মূল মন্ত্র সততা ও জনসংযোগ। তাঁর মতে ১ লক্ষ টাকার চাকরী করার থেকে ১ লক্ষ মানুষের উপকারে রাজনীতি করা অনেক বেশী যুক্তিসঙ্গত। বয়সে নবীন হলেও অনায়াসেই ক্ষুরধার বুদ্ধির মাধ্যমে অনেক প্রবীন নেতাকেও গোল দেওয়ার ক্ষমতা রাখেন তিনি।

নেতৃ্ত্ব দেওয়ার দুরন্ত ক্ষমতা ও নির্ভিক সত্যের পক্ষে দাঁড়ানো রাজীবের ডাকে অনুপ্রানিত হচ্ছেন যুব সম্প্রদায়ও।

শুভেন্দু অধিকারীঃ

পরিবহন, জলসম্পদ ও সেচ দফতর- একসঙ্গে তিনটি দফতর সামলাচ্ছেন তিনি। একটু ফ্ল্যাশব্যাকে গেলেই দেখা যাবে এ রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বিরোধী নেত্রী থেকে মুখ্যমন্ত্রী হয়ে ওঠার পেছনে নন্দীগ্রাম আন্দোলনকে সংগঠিত করে তাকে রাজ্যব্যাপী বামবিরোধী আন্দোলনে পরিণত করার ক্ষেত্রে শুভেন্দু অধিকারীর ভূমিকা অনস্বীকার্য।

রাজনৈতিক মহলের মতে, নেতৃত্বের গুনেই শুভেন্দু এখন নেতা থেকে জননেতা। রাজনীতির ময়দানে তৃণমূল শিবিরের কেউই তাঁর মত মাটি থেকে লড়াই করতে করতে উঠে আসা নয়।

লক্ষণ শেঠের মত দোর্দন্ডপ্রতাপ বাম নেতাকে মাত দিয়েছিলেন শুভেন্দুই। শুভেন্দু অধিকারী যুক্তিনিষ্ট বক্তব্য রাখতে বরাবর পারদর্শী। সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম। ইতিহাস ঘাঁটলেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।

ওয়াকিবহল মহলের মতে, একটা সময়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সংগঠক হিসেবে সবচেয়ে বেশী ভরসা করতেন শুভেন্দুকেই। তাই যে কোন কঠিন কাজে তিনি শুভেন্দুকেই সামনে নিয়ে আসতেন। নেত্রীকে যোগ্য সঙ্গত দিতে

কোনো কার্পন্য করেননি শুভেন্দুও। তবে কোথাও গিয়ে যেন সেই ভরসা তাল কেটেছে। সম্প্রতি রদবদলের পর স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকেও দেখা যায়নি তাঁকে। গুঞ্জন ভেসে আসছে দলের সঙ্গে ক্রমেই দূরত্ব বাড়ছে তাঁর। এমনকি বদল করতে পারেন দলও।

শুভেন্দুর রাজনীতির একটা নিজস্ব ঘরানা আছে। লাগাতার জনসংযোগ সেই ঘরানার প্রথম কথা। শুভেন্দু বিশ্বাস করেন, প্রচলিত রাজনীতি তাদের কিছু ক্ষমতা দিয়েছে। সেই ক্ষমতাকে মানুষের স্বার্থে কিছুটা হলেও ব্যবহার করতে হবে।

শুভেন্দু নিজেকে কলকাতার নেতা নয়,বরং গর্ব অনুভব করেন গ্রামের নেতা বলতে। কিন্তু এই নয় যে, তিনি কাউকে অপমান করতে চান। এর কারণ তিনি বিস্তির্ণ গ্রামের মানুষকে এই বার্তা দিতে চান যে তিনি তাদের লোক।

অকপটে সত্য কথা বলার মুরোদ আছে বলেই অচিরেই তিনি মানুষের হৃদয়ের কাছাকাছি চলে যেতে পেরেছিলেন।

পর্যালোচনাঃ

রাজীব ও শুভেন্দু নিজস্ব ভঙ্গির রাজনীতিতে বিশ্বাসী। মাটি কামড়ে লড়াই করার অদম্য ক্ষমতাও তাঁদের মধ্য বিদ্যমান। রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা সম্পন্ন, স্বচ্ছ ভাবমূর্তি, স্পষ্ট বক্তা এই দুই দুঁদে রাজনীতিবিদ তৃণমূলের কাছে অমূল্য সম্পদ। একথা অনস্বীকার্য।

এখানেই উঠছে প্রশ্ন। দীর্ঘদিন যারা রাজনীতির মাটি চষে সোনার ফসল ফলিয়েছেন আজ তাদের কেন সাংগঠনিক ক্ষমতার দিক থেকে স্বতন্ত্রতা দেওয়া হল না?  কেন তাদের অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধীনে থাকতে হবে?

রাজনৈতিক মহলের মত,দলের এই মুহুর্তে যা পরিস্থিতি সেখান থেকে পুনরুদ্ধার করার ক্ষমতা মুখ্যমন্ত্রীর পর রাজীব ও শুভেন্দু ছাড়া আর কারোর নেই। একথা জানা সত্ত্বেও চুপচাপ ঢোঁক গিলে আছেন অনেকেই।

সঠিক সিদ্ধান্তের অভাবে তীরে এসে না তরী ডুবে যায়, আশঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।

সম্পর্কিত পোস্ট