আমি অনাম্নী সাথে আমেরিকা… পর্ব-২

অনন্যা তেওয়ারি

আমেরিকাতে সব থেকে corrupted কোনো ব্যবসা যদি থেকে থাকে তাহলে সেটা হলো মুভার্স এন্ড প্যাকার্স এর ব্যবসা। অত্যন্ত ব্যক্তিগত মতামত। কিন্তু অভিজ্ঞতা থেকে বলছি।

খোলসা করি। কিছুদিন আগে নিজের দেশে গেছিলাম।প্রায় দীর্ঘ এক বছর পর। নিজের মাটি, নিজের বাড়ি, মা বাবা, ভাই বোন সব মিলিয়ে একদম একটা হৈ হৈ করে আনন্দে আছি।

এরই মধ্যে ওখানে থাকাকালীন বেটার হাফ এর বদলির খবর এলো। গত একবছর বাসের রাজ্য আরিজোনা ছেড়ে পাততাড়ি গুটিয়ে ছুটতে হবে ইলিনয়তে।

আমেরিকা ফেরা জানুয়ারীর ২০ তারিখ এবং নতুন জায়গায় বেটার হাফ এর কাজের শুরু ২৭ তারিখ। সেসবে দুজনেরই অনেকদিনের পর বাড়ি ফেরার আনন্দটায় কেমন যেন একটা কি করে এত কম সময়ে সব হবে এর একটা চিন্তার ছায়া কোপ বসাল।

এসব হিজিবিজি চিন্তার মাঝেই আমরা দেশে বসেই নতুন জায়গার বাড়ি খুঁজলাম। সর্বোপরি জিনিস পত্র নিয়ে যাবার জন্যে মুভার্স এন্ড প্যাকার্স বুক  করলাম।

তারপর আমেরিকাতে ফিরে শুরু হলো পুরোনো আস্তানা থেকে সংসার গোটানোর পালা। যেখানে থাকতাম সেই জায়গাটা ছিল রাজ্য আরিজোনার রাজধানী ফিনিক্স এর উপশহর টেম্পে। আরিজোনা বললে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সঙ্গে যেটা মাথায় আসে সেটা হলো গরম।

আরও পড়ুনঃআমি অনাম্নী সাথে আমেরিকা… পর্ব-১

এবার সেই গরম ছেড়ে পাড়ি দিচ্ছি ঠান্ডার জায়গায়। শুধু ঠান্ডা না বলে বরং বলা ভালো বরফের জায়গায়। তাই সবার আগে যেটা দরকার সেটা হলো গাড়ির টায়ার পাল্টানো। সেটা সবার আগে করতে হবে। সেই কাজটা সবার আগে সেরে আমরা মন দিলাম ঘরকন্যে গুটোতে। মুভার্স এন্ড প্যাকার্স এখানে জিনিস পত্র মুভ করবে কিন্তু প্যাক করবেনা। তাই নিজেদেরকেই জিনিসপত্র প্যাক করতে হবে।

সেসব করছি এমন সময় মুভার্স এন্ড প্যাকার্স থেকে ফোন আসে।

প্রথমেই বলি এই কোম্পানিটির নাম নেবোনা। ধরা যাক কোম্পানির নাম হিজিবিজির আড্ডা। তা এই হিজিবিজির আড্ডা কোম্পানি থেকে যখন মুভিং এর প্রথম কোড দেয় তাতে ২৮০ বর্গফুট জায়গার জন্যে ১৯২০$ লাগে।

এখানে নতুন সংসার তাই জিনিসপত্র বিশেষ নেই। ওই ২৮০ বর্গফুট এ ৩০ টি বড়ো সাইজ এর প্যাকিং বাক্স, খাট, ডাইনিং টেবিল, সোফা , টিভি টেবিল ইত্যাদি সবই ঠিক ছিল। পুরো টাকাটাই বেটার হাফ এর employer কোম্পানি reimburse করবে।

হিসেবে মতন ওদের ২৪ তারিখ জিনিসপত্র নেবার কথা। আমরা সেই হিসেবে বাড়িওয়ালাকে নোটিশও দিয়ে দিয়েছি যে ২৫ তারিখ ছেড়ে দেব বাড়ি। সেই মতন ইলেকট্রিকও surrender করে দিয়েছি। ২৬ তারিখ সকালের ফ্লাইটের টিকিট ও হয়ে গেছে। প্ল্যান মতন মুভার্স এন্ড প্যাকার্স জিনিস পত্র নিয়ে চলে যাবার পর বন্ধুর বাড়িতে রাতে থেকে সেখান থেকেই ভোরে এয়ারপোর্টে বেরিয়ে যাবো।

কিন্তু এই সমস্ত পরিকল্পনার যে সবটাই আমাদের কল্পনাতেই গড়াগড়ি খেয়ে লাট হবে সেটা কে জানতো। ২২ তারিখ ফোন করে হিজিবিজির আড্ডা জানায় যে ওদেরকে জিনিসপত্রের সাইজ এর এস্টিমেট দিতে হবে।

সেই এস্টিমেশন তারা ফোনেই করলেন। কোন সূত্রে করলেন সেটা ওনারাই জানেন। কিন্তু যেই সূত্রে করলেন তাতে বর্গফুট দাঁড়ালো ৪৫০। এবং সেই পরিমানে আমাদের খরচের বহর বেড়ে কয়েক পার্সেন্ট ছাড় দিয়ে দাঁড়ালো ৩৩০০$ . সেটা তখনই মেনে ডিজিটাল দস্তখত করতে হবে, নয়তো বাড়তি কয়েক পার্সেন্ট এর ছাড় নাকি পাবনা।

অথচ বেটার হাফের এমপ্লয়ার কোম্পানি ম্যাক্সিমাম লিমিট হলো ৩০০০$ .যাই হোক এত কম সময়ে আর অন্য কিছু পাওয়া যাবেনা তাই তাড়াহুড়োতে  নিজের পকেট থেকে ৩০০০$ এর এক্সট্রা গচ্চা দিয়েই রাজি হলাম। এবং এই সংক্রান্ত লেখা পড়ি ফোন ফোনেই হয়ে গেলো। তাতে আবার করে নতুন কন্ট্রাক্ট অনুযায়ী এক্সট্রা লাগলো। কিন্তু সন্দেহ থাকায় নিজেরা সমস্ত কিছুর মাপ নিয়ে জায়গার হিসেবে করে দেখলাম ব্যবহৃত স্পেস ২০০ বর্গফুট এর বেশি হবার না।

আমরা কল করে জানাতে তারা পরিষ্কার বলে দিলো যে কোনো রকম পয়সা ফেরত হয়না। আর এটা পরিবর্তন সাপেক্ষ নয়। আমার আমেরিকা বাসে এরকম অভিজ্ঞতা প্রথম। যাবতীয় দোকান পাঠ সবের ক্ষেত্রে এদের এত সহজ পন্থা অথচ এখানে এরকম গেঁড়াকল।

ওদের কে চেপে ধরতে আরো যেটা জানা গেলো সেটা হলো ওরা আদপে কোনো মুভিং কোম্পানিই নয়। এরা হলো থার্ড পার্টি। মুভার্স এন্ড প্যাকিং কোম্পানিকে এপয়েন্ট করে চালায়।

বুঝলাম স্ক্যামে পড়েছি। যে কথা বললো কাস্টমার কেয়ারে সে বললো  রিফান্ড দিলে মুভিং কোম্পানি দেবে। মুভিং কোম্পানি এর কাস্টমার কেয়ার এ নম্বর নিয়ে জানলাম সেরকম কোনো ব্যাপার

ই নেই।  অর্থাৎ পুরোটাই ঢপের কাহিনী। তারপর শুরু হলো গুগল আর USA  বিখ্যাত YELP রিভিউ দেখা। থার্ড পার্টি এবং মুভিং কোম্পানি দুটোরই রিভিউ এক কোথায় অতীব জঘন্য।

গড্ডালিকায় টাকা ঢেলে বসে আছি বুঝতে পারি। কিন্তু আসল ঘটনা হলো এরপরের দিন ২৩ তারিখ। ২৩ তারিখে হিজিবিজির আড্ডা কোম্পানি ফোন করে জানায় ওদের ট্রাক কম পড়েছে। তাই ওরা ২৪ তারিখে জিনিস ওঠাতে পারবেনা। জিনিস তুলবে ২৫ তারিখ। এবার মাথায় হাত।

কারণ ২৫ এর ভোরে আমাদের যেতে হবে।  এবং যেতে হবেই কারণ ২৬ তারিখে রবিবারের কোনো ফ্লাইট নেই। আর ২৭ তারিখ এ বেটার হাফ এর নতুন জায়গায় প্রথম দিন।  অতএব শেষ সহায় হলাম আমি।  অর্থাৎ আমাকে থেকে যেতে হবে এবং বেটার হাফ আপাতত একাই পাড়ি  দেবেন।

রয়ে তো গেলাম কিন্তু ২৫ তারিখেও গাড়ি আসেনা। সারাদিন একা ফ্ল্যাট এ বসে দিন কাটাচ্ছি। আর কয়েক ঘন্টার বিরতিতে বার বার কল করছি মুভিং কোম্পানি এর কাস্টমার কেয়ার এ।  শেষমেশ যখন ট্রাক এলো তখন ঘড়িতে রাত ৮:২০।  সব কিছু তুলে যখন গাড়ি ছেড়ে গেলো তখন রাত ১১ টা।

নিজেদের গাড়ি খানা আগেই পাঠিয়ে দিয়েছিলাম কার মুভিং কোম্পানি কে দিয়ে।

সব মিলিয়ে এ যাত্রা মুক্তি হলেও রিভিউ এর দৌলতে আমরা জিনিস পত্র না পাওয়া অব্দি যারপর নাই চিন্তায় কাটিয়েছি।

ব্লুমিংটন এ এসে অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদেরও অভিজ্ঞতা শুনলাম। তাতে জানলাম সমস্ত মুভিং কোম্পানিই কম বেশি এরকম জালিয়াতি করে। আমার প্রতিবেশী মিনেসোটা থেকে যখন এসেছিলো তখন তার পেল্লাই টিভি দু’খন্ড হয়ে ইন্সুরেন্স এ ওজন দরে ৬০$ ক্ষতিপূরণ পেয়েছিলো। আরেক বন্ধুর সোফা যত্র তত্র চোকলা উঠে গেছিলো। আরেকজনের কাঁচের বাসন এর কোনো টাই গোটা ছিলোনা।

এসব গুলো শুনে নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে অনাম্নী আমি ফেলে আসা দেশটার কথা ভাবলাম। যেটা আমার বাড়ি। যেখানে আমি বড়ো হলাম সেই জায়গায় জীবন যাত্রা কঠিন ঠিকই।

কিন্তু কিছুদিকে আমরা হয়তো সত্যি এতটাও খারাপ না। যতবার কোনো কারণে মুভ করেছি বা বন্ধুদের অভিজ্ঞতা শুনেছি কোনো টাই সেরূপ খারাপ কিছু উল্লেখ পাইনি। সৌজন্যে a -z এর আওতায় যতগুলো মুভিং কোম্পানি আছে। জিনিস পত্র প্যাক করে মুভ করে আনপ্যাক করে সাজিয়ে দিয়ে চলে গেছে প্রতিবার।

কিন্তু কথায় বলে না যে দাঁত থাকতে দাঁতের  মর্ম বোঝেনা। তাই বিদেশে এসে দেশের এই গুন্ টার নতুন উপলব্ধি হলো।

সম্পর্কিত পোস্ট