করোনা আবহে প্রশ্নের মুখে ভবিষ্যৎ, উত্তর আছে তো সরকার বাহাদুর?
নয়ন রায়
করোনা ভাইরাস। বিশ্ব জুড়ে মহামারীর আকার নিয়েছে। প্রতিনিয়ত মৃত্যুর নতুন নতুন রেকর্ড তৈরী করছে। উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত- করোনার থাবা থেকে বাদ নেই কেউই। বিশেষজ্ঞরা বলছেন করোনা মোকাবিলায় একমাত্র পথ হল কমপ্লিট লকডাউন। সেই মতই লকডাউনের দ্বিতীয় পর্যায়ের ১১ দিনে পা রেখেছি আমরা।
প্রথম পর্যায়ে শেষ করে দ্বিতীয় পর্যায়ে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই করছি অবিরাম। ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে নিজেকে সম্পূর্ণ আইসোলেট করে রাখা।সঙ্গে অবশ্য পরিবারের সদস্যরা রয়েছেন।
কিন্তু প্রশ্ন হল সত্যিই কি আমরা ভাল আছি? লকডাউনের একটা একটা দিন যত পার করছি ততই প্রকট হচ্ছে এই রাজ্যের জরাজীর্ণ ছবিটা। যারা উচ্চবিত্ত, তারা জমানো পুঁজি ভাঙিয়ে চালিয়ে নিচ্ছেন।যারা নিম্নবিত্ত(দিন আনা, দিন খাওয়া মানুষ)তারা সরকারের তরফে রেশন পাচ্ছেন, পাশাপাশি সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ এগিয়ে আসছেন তাদের সহযোগীতায়।
মধ্যবিত্ত যারা, আত্মসম্মান অক্ষু্ণ্ণ রেখে তারাও না হয় টানাটানি করে চালিয়ে নিচ্ছেন। যাদের মাথার উপর উন্মুক্ত আকাশ, সহায় সম্বল বলতে একটা কম্বল, তাদের কী হবে? সরকার কি তাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা করেছে?
তীর্থের কাকের মত অপেক্ষমান, কে-কখন দু’মুঠো খাবার দেবে… একটা দিন কোনো মতে পার করেই তারা ভর্তি খোলা আকাশের নীচে চিটচিটে কম্বলে মাথা পেতে শুয়ে পরেরদিনের ভাবনা শুরু।
গুগলে নেই, বাস্তবে আছে, শিবদা কে করোনা মুক্ত করাই চ্যালেঞ্জ তাপস বাবুর
এবার আসি যাঁরা প্রান্তিক স্তরের চাষী, তাদের কথায়। তারা সেনসেক্স, নিফটি এসব কিছুই বোঝে না। তাদের কড়ি-ও জমানো নেই যে তা ভাঙিয়ে চলবে। তেল কমে আসা প্রদীপ যেমন জ্বলে, এখন তাদের অবস্থাও ঠিক তেমন।
প্রদীপের নীচে অন্ধকার হাতড়ে যদি আদৌ কিছু খুঁজে পান, তা দিয়ে নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাবে। তারপর কী হবে? এদের জীবন ছন্দময় করতে কোনো কবিতা-গদ্যই কাজে আসবে না। সেইসঙ্গে তাদের করুণ কাহিনী তুলে ধরতে যে সব সংবাদমাধ্যম পৌঁছবেন, তাদের প্রশ্ন হজম করবেন। বারবার সেই দুর্দশা ক্যামেরবন্দী হবে। প্রশ্ন তাতে আদৌ কী সমস্যার সমাধান হবে কিছু?
যারা একেবারে গরীব মানুষ, বেঁচে থাকার লড়াইয়ে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে গিয়ে দাঁড়াবেন রেশন লাইনে। তাঁদের কাছে কী মূল্য আছে রাজ্যের অর্থনীতি, দেশের অর্থনীতি. জিডিপি-র মত ভারী ভারী শব্দের !!
তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এই কঠিন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়েও এই রাজ্যে রেশনের রাজনীতি অব্যাহত। প্রত্যন্ত গ্রামের দিকে যারা এই রেশনের দিকেই তাকিয়ে তাদের অভিযোগ “মুখ্যমন্ত্রী যা বলছেন, রেশন থেকে কেউ তা দিচ্ছেন না। কাজ বন্ধ, কী করে সংসার চলবে আমাদের?” এর উত্তর অবশ্য আমরা জানি না…
বিরোধীদের আবার অভিযোগ শাসকদলের নেতারা চুরি করছেন গরীব মানুষের রেশন।কখনও রাতের অন্ধকারে, কখনও আবার দিনে দুপুরে হাপিস হয়ে যাচ্ছে চাল-গম।
মে মাসের ৩ তারিখ পর্যন্ত আপাতত লকডাউন। বাড়বে কিনা জানা নেই। জানা নেই পরবর্তী পরিস্থিতি কোন দিকে যাবে।যদি বাড়ে, শিল্প কৃষি শিক্ষা চাকরি সব তো লাটে উঠবেই। চূড়ান্ত শান্তিপ্রিয় মানুষটির বাড়িতেও আজ অশান্তির মেঘ। অন্যদিকে বৈশাখের শুরু থেকেই চোখ রাঙাচ্ছে সূর্য। ক্রমশ বাড়ছে তা। তবে মাঝখানে স্বস্তির কারণ কালবৈশাখীর ঝড়-বৃষ্টি।
মাঠের ফসল মাঠেই পড়ে আছে। ধান কাটা হবে কী করে? ধান কাটার বড় গাড়ি দেখা যাচ্ছে ঠিকই। কিন্তু লোক নেই। সবজির দামও ক্রমশ বাড়ছে।মাছ মাংস হাত লাগানোর জো নেই। তাতেও অবশ্য লকডাউন উপেক্ষা করে বাজারে ভিড় জমাচ্ছেন আমজনতা।
লকডাউন মানাতে, মানুষকে কিছুটা এক ঘেঁয়েমি থেকে বের করে আনতে আর কিছুটা বাধ্য হয়েও পুলিশ বিভিন্ন জায়গায় গান গাইছেন। দমকল কর্মীরা গান গাইছেন। কিন্তু তাতে তো সমস্যার সমাধান হবে না।
আমরা যারা সাধারণ মানুষ তাদের বড় সমস্যা। বিধায়ক আর সাংসদদের সমস্যা কম। তাদের জন্য লোক পয়সা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। আমার আপনার কথা নাই বা বললাম। বিনা পয়সায় কোনো কিছুই মিলবে না। এই কঠিন পরিস্থিতে বাস্তব এটাই।
এসবের মাঝেও হাসপাতাল গুলিতেও শুরু হয়েছে নতুন নাটক। করোনা ছাড়া এই মূহুর্তে পাত্তাই পাচ্ছে না কোনো রোগ। ডাক্তারবাবুদের রণচন্ডী মেজাজে নাকানিচোবানি খাওয়ার জোগাড়।
করোনা মোকাবিলায় ত্রাতা অরুপ, নিজ উদ্যোগে চলছে ত্রাণ বিলি
তবুও কুর্ণিশ জানাই তাঁদের। কারণ প্রত্যেক মূহুর্তে তারা যেভাবে লড়াই করছেন তার মূল্য কোনো ভাবেই দেওয়া যাবে না। বিশ্ববাসীর কাছে তাঁরাই ভগবান এখন। তাও কোথাও কোথাও জনরোষের স্বীকার হচ্ছেন তাঁরা।
তবে এসবেরও মাঝেও চলছে বিস্তর অশান্তি। একদিকে ময়দানে রাজ্যের সাংবিধানিক প্রধান বনাম প্রশাসনিক প্রধান। অন্যদিকে কেন্দ্র বনাম রাজ্য। এমনকী রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে তথ্য গোপন করার মত অভিযোগও উঠছে।
দুর্ভাগ্যের বিষয়, এদেশে মন্দির-মসজিদ নিয়ে দীর্ঘ আইনি লড়াই চলে। তৈরী হয় সবথেকে উচ্চতম স্ট্যাচু। বুলেট ট্রেন নিয়ে মাতামাতি হয়। কিন্তু স্কুল-কলেজ-হাসপাতাল তৈরী নিয়ে মাথাব্যাথাই নেই।
চিকিৎসা ব্যবস্থার পর্যাপ্ত পরিকাঠামোর যে কতটা অভাব, করোনা সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিল। একইসঙ্গে দাঁড় করিয়ে দিল শাসকদের একাধিক প্রশ্নের মুখে। যার উত্তর হয়ত তাঁরা নিজেরাও দিতে পারবেন না।
হাল ধরবে কে? মনে রাখবেন মানুষ প্রশ্ন করবেই….উত্তর আছে তো সরকার বাহাদুর(কেন্দ্র ও রাজ্য)?