বাংলার অর্থনীতি-রাজনীতি-সমাজনীতি, গোলকধাঁধায় আটকে ত্রয়ী!

অনন্যা ব্যানার্জি: বাংলার ভবিষ্যৎ কী? বাড়ির চৌকাঠটা পেরিয়ে পাড়া থেকে শুরু করে চায়ের টেক বা ট্রেনে-বাসে করে যাতায়াত করার সময় একটু সচেতন হয়ে কান পাতলেই এই কথাটা শোনা যাবে। না চাইলেও একটু ভাল পড়াশোনা করে যারা উপযুক্ত কেরিয়ার গড়তে চাইছে তাদের প্রায় সকলকেই রাজ্য ছেড়ে ভিন রাজ্য বা ভিন দেশে চলে যেতে হচ্ছে। শুধু তাই নয়, শ্রমিকের কাজ করার জন্য‌ও হাজারে হাজারে মানুষকে ভিন রাজ্যে পাড়ি দিতে হচ্ছে। এই ঘটনা নিঃসন্দেহে পশ্চিমবঙ্গে এক সামাজিক দদুল্যমান অবস্থা তৈরি করছে। বদলে যাচ্ছে এই রাজ্যের সামাজিক কাঠামো ও ভারসাম্য।

পশ্চিমবঙ্গে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ বেশ কম। বামফ্রন্ট জমানায় অন্তত নিয়ম করে শিক্ষক পদে নিয়োগ করা হত। কিন্তু তৃণমূল সরকারের জমানায় প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চমাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষক পদে নিয়োগ নিয়ে যেভাবে একের পর এক ভয়াবহ দুর্নীতির ঘটনা প্রকাশ্যে এসেছে তাতে আদালতের নির্দেশেই গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়া কার্যত থমকে গিয়েছে। ফলে বাড়ির কাছে থাকব ভেবে যে ছেলেমেয়েরা শিক্ষক হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন তাঁদেরও আজ স্বপ্নপূরণের জন্য ভিন রাজ্যের বেসরকারি স্কুলে চাকরি খুঁজে নিতে হচ্ছে। রাজ্যের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ভাল না হওয়ায় বিভিন্ন টেকনিক্যাল কলেজে পড়ুয়া ভর্তির সংখ্যা ক্রমশ কমছে। ফলে বেশ কিছু টেকনিক্যাল কলেজ বন্ধ হয়ে গিয়েছে বা বন্ধ হওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে। এতে ওই সমস্ত কলেজে যারা শিক্ষকতা করতেন তাঁরা নতুন করে বেকার হয়ে পড়ছেন।

সেক্টর ফাইভে ও নিউটাউন মিলিয়ে রাজ্যে কিছু আইটি সংস্থা আছে। সেখানে বেশ অনেকেই চাকরি করেন। কিন্তু যারা প্রকৃত বাস্তবটা জানেন না তাঁরা এই চাকরি নিয়েই উচ্ছ্বসিত হয়ে ওঠেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন সেক্টর ফাইভকে কেন্দ্র করে বাংলায় একটি বৃহৎ আইটি হাব গড়ে তোলার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। কিন্তু তৃণমূল সরকারের আমলে সেই প্রক্রিয়া ভয়াবহভাবে ধাক্কা খায়। পরবর্তীতে ইনফোসিস নতুন করে তাদের দ্বিতীয় ক্যাম্পাস চালু করলেও মূল পরিস্থিতি খুব একটা বদলায়নি। কারণ সার্বিকভাবে আইটি হাব এখানে গড়ে উঠতে না পারায় সেক্টর ফাইভের আইটি কোম্পানিগুলোতে একেবারে এন্ট্রি লেভেলের কাজ হয়। আইটি ক্ষেত্রে কেরিয়ার এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এখানকার সংস্থাগুলি তাদের কর্মীদের বেঙ্গালুরু, হায়দ্রাবাদের মতোঅন্যান্য জায়গার ক্যাম্পাসে বদলি করে। আর যারা কলকাতায় থেকে যেতে চায় তাদের বেশিরভাগেরই খুব একটা উন্নতি হয় না।

গত দেড় দশকে বাংলায় সেই অর্থে বড় কোনও কলকারখানা আসেনি। রাজ্য সরকার যতই পরিসংখ্যান দিয়ে নানান দাবি করুক না কেন উচ্চশিক্ষিত বা কারিগরিভাবে উচ্চ দক্ষতা সম্পন্নদের পর্যাপ্ত কাজের সন্ধান এই রাজ্যে মোটেও নেই। একটি পোস্টের জন্য যদি হাজার হাজার জনের মধ্যে লড়াই হয় তবে সেখানকার পরিস্থিতি যে মোটেও সুখকর নয় সেটা বোঝা যায়।

এদিকে বেসরকারি কল কারখানা স্থাপিত না হওয়ায় বেসরকারি ক্ষেত্রে‌ও তেমন চাকরি হচ্ছে না। অথচ এই চাকরিগুলো হলে তার হাত ধরে বাজারে চাহিদা বাড়ত। তাতে পরোক্ষভাবে আরও কয়েক লক্ষ মানুষ করে খেতে পারতেন। তাছাড়া বেসরকারি কলকারখানা গড়ে ওঠা মানে রাজ্য সরকারের তহবিলে বিপুল পরিমাণের রাজস্ব জমা হওয়া। কিন্তু শিল্পায়নের অভাব রাজ্য সরকারের সঠিক আর্থিক নীতি প্রণয়ন করতেন না পারা এই সব কিছু মিলিয়েই বাংলার সমাজ ব্যবস্থার পাশাপাশি বেহাল দশা সরকারি কোষাগারের। অর্থের অভাবে সরকারি কর্মচারীরা হকের মহার্ঘ ভাতা পান না। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন আধা সরকারি সংস্থার কর্মীদের বেতন ঠিক সময় হয় না বলেও মাঝেমধ্যেই অভিযোগ ওঠে।

বিরোধীদের অভিযোগ, তহবিলের অভাবে সরকার সহজে তাদের চাকরিতে নিয়োগ করতে চাইছে না। এই দুইয়ের অভিঘাত একটি জাতিকে মুহ্যমান করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তার সঙ্গে বিষ ফোঁড়ার মত বাংলার রাজনীতির ক্ষেত্রে এক অদ্ভুত নৈরাস্য গ্রাস করেছে। তৃণমূল সরকারের দুর্নীতি, শাসকদলের নেতাকর্মীদের দুর্ব্যবহার, দূরবিনীত আচরণ, কিছু জায়গা অত্যাচারে মানুষ অতিষ্ট। সামগ্রিক জনমত রাজ্যের শাসকদরের পুরোপুরি বিপক্ষে। কিন্তু বিরোধী পরিসরের অযোগ্যতা, ব্যর্থতা ও দিশাহীনতা আমজনতাকে ভরসা দিতে পারছে না। ফলে বেশিরভাগ মানুষ চাইলেও ফাঁকতাল দিয়ে ঠিক ক্ষমতায় থেকে যেতে পারছে তৃণমূল। শুধু ক্ষমতায় থাকছে তাই নয়, তাদের রাজনৈতিক সাফল্য উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। সেইসঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে স্বেচ্ছাচারিতা। কিছু মাস আগেও যারা ভাবছিলেন আগামী দিনে ঠিক রাজ্যের চাকাটা অন্যরকমভাবে ঘুরবে, তাঁদেরও একাংশ এখন হতাশায় নিমজ্জিত হয়ে পড়েছেন। কীভাবে এই কালচক্র থেকে রেহাই মিলবে তা বোঝা যাচ্ছে না।

একটা বিষয় পরিষ্কার, যতদিন বিজেপি পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে প্রধান বিরোধীদলের পরিসরে থাকবে ততদিন তৃণমূল কংগ্রেসের মঙ্গল। এক্ষেত্রে বামেরা সবচেয়ে সঠিক বিকল্প হতে পারে। কিন্তু তাদের যেভাবে নীতিহীনতা, সিদ্ধান্তহীনতা ও ঝিমুনি গ্রাস করেছে তাতে বিজেপিকে ঠেলে বামেদের উঠে আসার আশু সম্ভাবনা কোথাও দেখা যাচ্ছে না। ফলে বাংলা শব্দটাই এখন হতাশার প্রতিশব্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে!

সম্পর্কিত পোস্ট