বর্ধমানে রাজনীতির রঙ বদলে বিজেপির ভরসা ‘রবিনহুড’ অঞ্জনে

দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ  হাইট প্রায় ৬ ফুট। সুঠাম চেহারা। দেখতেও বেশ সুদর্শন। এক লহমায় দেখে বোঝার উপায় নেই বয়স পেরিয়ে গেছে।

যাকে নিয়ে এই প্রতিবেদন, তাঁর নাম অঞ্জন মুখার্জী। বাম আমলে তাঁকে সবাই রবিনহুড বলে ডাকতে পছন্দ করতেন। অনেকের প্রশ্ন থাকতে পারে কেন তাকে রবিনহুড বলা হয়?

উত্তর খুব স্পষ্ট। যার যা নামে ইচ্ছা ডাকুক, নামে কী আসে যায়! যদি একবার অঞ্জন মুখার্জীর গ্রাফটা দেখা যায়, তাহলে রবিনহুডের চেহারার সঙ্গে মিল খুঁজে পাওয়া যাবে।

কে এই অঞ্জন মুখার্জী? কী তাঁর পরিচয়? কেমনই বা তাঁর রাজনৈতিক সত্ত্বা? যদি অতীতের ইতিহাস ঘাঁটা যায় তাহলেই দিনের আলোর মত স্পষ্ট হয়ে যাবে অঞ্জন মুখার্জীর জিওগ্রাফি।

তাঁর জ্যাঠামশায় প্রয়াত তুহিন মুখার্জী, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর আজাদ হিন্দ বাহিনীর সদস্য ছিলেন। ফলে খুব স্বাভাবিক ভাবেই শৈশব থেকেই অঞ্জনের ধমনীতে রাজনীতির স্রোত প্রবাহিত হয়েছিল।

৭০ দশক। এরাজ্যে যখন কংগ্রেস ক্ষমতায়, তখন অঞ্জনের মত তরুণরা নকশাল আন্দোলনের সঙ্গে জড়িয়ে পরেছিল।

চারু মজুমদার থেকে অসীম চ্যাটার্জীর হাত ধরে নকশাল আন্দোলনে ডুব দিয়েছিলেন অঞ্জন মুখার্জী। নকশাল আন্দোলনই তাঁকে অনেকটাই রাজনীতির মূল স্রোতে নিয়ে আসে। পরে অবশ্য নকশাল আন্দোলন থেকে নিজেকে সরিয়ে নেনে তিনি।

১৯৭১ সাল। কাটোয়ার শিখন্ডে তিনজন পুলিশ কর্মী খুনের অপরাধে তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। সেই জেল থেকেই পরীক্ষা দিয়ে পাশও করেন তিনি। ভর্তি হন বর্ধমান রাজ কলেজের বাণিজ্য বিভাগে। বাংলা তখন জ্বলছে।

রাজনীতির অগ্নিকুন্ডে অঞ্জন নিজেকে শক্তপোক্ত করে তোলেন। তবে কখনও ভুলে যাননি ছাত্র জীবনের বন্ধু দেবাশীষ চ্যাটার্জীর কথা। সেসময় অঞ্জন রাজনীতির দিশা খুঁজছিলেন।

প্রিয়রঞ্জন দাশমুন্সি, সুব্রত মুখোপাধ্যায়, কুমুদ ভট্টাচার্যের হাত ধরে যোগ দিলেন ছাত্র পরিষদ আন্দোলনে।

১৯৭৫ সাল। দেশজুড়ে জরুরী অবস্থা। মিশাতে আটক হলেন অঞ্জন মুখার্জী। তারপর রাজনৈতিক ভাবে নিজেকে পরিবর্তন করে ফেললেন।

বিশ্ব ভারতীর সাইটে আশ্রমিকদের কাছে মতামতের আহ্বান কর্তৃপক্ষের

তখনকার সিদ্ধান্ত ছিল বামপন্থীরাই একমাত্র বিকল্প পথ। সেই বিকল্পের খোঁজে, জ্যাঠামশায় দেবপ্রসাদ চ্যাটার্জীর হাত ধরে ১৯৭৬-১৯৭৭ সালে বাম রাজনীতিতে যোগ দিলেন অঞ্জন। চলে এলেন আরএসপি পার্টিতে।

তারপর তাকে আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। তখন ক্ষমতায় বামফ্রন্ট। প্রয়াত দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায়, যতীন চক্রবর্তী, গণেশ মন্ডল, মতিশ রায়, ক্ষিতি গোস্বামী, বিশ্বনাথ চৌধুরী, মনোজ ভট্টাচার্য ও অবনী রায়ের সংস্পর্শ রাজনীতির ময়দানে ক্রমশ তাঁর অভিজ্ঞতা মজবুত করে তোলে।

দীর্ঘ ২২ বছর। বর্ধমান জেলায় আরএসপির জেলা সম্পাদক ছিলেন তিনি। পাশাপাশি রাজ্য কমিটির সদস্যও ছিলেন। অচিরেই জ্যোতি বসু থেকে সুভাষ চক্রবর্তীর খুব ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন অঞ্জন।

তাঁর ক্ষুরধার রাজনৈতিক বক্তব্য এবং রাজনৈতিক কর্মপদ্ধতিতে এই জেলার বহু বামপন্থীদের কাছে তিনি আইকন হয়ে উঠেছিলেন।

নিজে আরএসপির জেলা সম্পাদক হলেও বর্ধমান জেলার বহু সিপিএম নেতার সঙ্গে তাঁর সুসম্পর্ক ছিল। প্রয়াত নিখিলানন্দ সর, প্রয়াত নিরুপম সেন এবং বর্তমানে মদন ঘোষের সঙ্গে তাঁর সখ্যতা সর্বজনবিদিত।

আরএসপি পার্টি করার সুবাদে পৃথিবীর অর্ধেক দেশ তিনি ঘুরে ফেলেছেন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন এতটাই বর্ণময় যে দলত্যাগের পর তা অনেককেই ভাবিয়েছে।

২০১১ সালে বামেদের সরিয়ে ক্ষমতায় আসে তৃণমূল।তার ঠিক ২ বছর পর ২০১৩ সালে তিনি তৎকালীন বিজেপির বর্ধমান জেলা সভাপতি দেবীপ্রসাদ মুথার্জীর হাত ধরে বিজেপিতে যোগ দেন।

২০১৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারী রাহুল সিনহার ডাকে সরাসরি গেরুয়া বাহিনীতে চলে এলেন সেদিনের রবিনহুড। বর্তমানে রাজ্যকমিটির সদস্য ও বিজেপির শ্রমিক সংগঠনের কার্যকারী সভাপতি।

তাঁর এই গেরুয়া শিবিরে চলে যাওয়াটা বহু বামপন্থী মন থেকে মেনে নিতে পারেননি। কারণ যাকে ঘিরে রাজনীতির যুব সম্প্রদায় রাজনৈতিক জীবন শুরু করার ভাবনায় ছিলেন তারা অনেকটা হতাশ হয়েছিলেন।

এই হতাশা তার মধ্যেও কাজ করেছিল। অতীতের স্মৃতি ঘাঁটতে ঘাঁটতে অঞ্জনের একটাই বক্তব্য আর যাই করি তৃণমূল করা যায় না। তাই সর্বভারতীয় পার্টিতে যোগ দিলাম।

বর্তমানে বিজেপিতে তিনি থাকলেও রাজনৈতিক মতাদর্শ দূরে সরিয়ে সকলেরই অবাধ প্রবেশ তাঁর ঘরে।

সামনে বিধানসভা ভোট। বিজেপি তাঁকে যদি ব্যবহার করতে পারে তাহলে অনেকটা হাওয়া বদল হয়ে যেতে পারে বর্ধমান জেলায়। অন্তত এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক মহলের একাংশ।

তাই রাজনীতির পড়ন্ত বেলায় এখনো গোধূলীর আলো তিনি খুঁজছেন। কারণ নাম টা অঞ্জন মুখার্জী।

এই শহরের বহু মানুষ এখনো তাঁকে ঘিরে স্বপ্ন দেখে। তাঁর কথায়, রাজনীতি আমার পেশা নয়। প্যাশন। ভাল লাগা। রাজনীতিতে থেকে মানুষের কাজ যদি করতে পারি তাহলেই আমি যথার্থ অঞ্জন মুখার্জী।

সম্পর্কিত পোস্ট