অতৃপ্ত আত্মাদের দিকে ওত পেতে বসে, বিজেপি যেন ভারতীয় রাজনীতির ‘রক্তপিশাচ’!

দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ দল ভাঙা-গড়া ভারতীয় রাজনীতির পুরনো বৈশিষ্ট্য। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগে থেকে এই ধারা চলে আসছে। কংগ্রেসে বাধা পেলে সুভাষচন্দ্র বসু দল ছেড়ে গড়ে তোলেন অনেকটাই বিপরীত মতাদর্শের ফরওয়ার্ড ব্লক বা মতাদর্শ প্রায় একই থাকলেও কংগ্রেসের বাধা পেয়ে চিত্তরঞ্জন দাশ-মতিলাল নেহেরু তৈরি করেন স্বরাজ্য দল। তবে স্বাধীনতার পর একদল ভেঙে একই মতাদর্শের অন্য দল গড়ে তোলার প্রবণতা বহুগুণ বৃদ্ধি পায়।

দলের ভাঙন খুব অল্প ক্ষেত্রেই মতাদর্শগত হয়েছে। ষাটের দশকে সিপিআই ভেঙে সিপিআই(এম) তৈরি ছিল মতাদর্শগত পৃথকীকরণ। পরবর্তীকালে সিপিআই(এম) ভেঙে সিপিআই-এমএল (লিবারেশন) তৈরিও মতাদর্শগত ভাঙনের আরেক দিক।

কিন্তু এই বাংলায় ফরওয়ার্ড ব্লক ভেঙে মার্কসবাদী ফরওয়ার্ড ব্লক তৈরি বা ডিএমকে ভেঙে এআইএডিএমকে তৈরি, কংগ্রেস ভেঙে তামিল মানালি কংগ্রেস, বাংলা কংগ্রেস, হরিয়ানা জনহিতকর কংগ্রেস, এনসিপি, ওয়াইএস‌আর কংগ্রেস গঠন, বা জনতা দল ভেঙে সমাজবাদী পার্টি, জেডি(ইউ), জেডি (এস), বিজেডি, আইএন‌এলডি’র মতো দল গঠন ছিল পুরোপুরি ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে ভাঙন।

কংগ্রেস ভেঙে তৃণমূল কংগ্রেস তৈরিকে অনেকে এই গোত্রেই ফেলেন। আবার কেউ কেউ দাবি করেন, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল নির্দিষ্ট সিপিএম বিরোধিতার অবস্থান নিয়ে তৈরি হয়েছিল, তাই একে ঠিক ক্ষমতা দখলের উদ্দেশ্যে আলাদা হয়ে যাওয়া বলা চলে না।

এটা ঠিক রাজনীতিতে গণতান্ত্রিক পরিসর থাকলে দল গঠন ও ভাঙন চলবে। কিন্তু গত আট বছর ধরে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ‘অতৃপ্ত আত্মা’দের ব্যবহার করে বিজেপি যেভাবে নির্বাচিত সরকার ফেলে দেওয়ার খেলায় মেতেছে এটা অতীতে ভারতীয় রাজনীতিতে দেখা যায়নি।

গেরুয়া শিবিরের পক্ষ থেকে এই ‘অতৃপ্ত আত্মা’র সন্ধান অভিযানের আবার গালভরা নাম দেওয়া হয়েছে ‘অপারেশন লোটাস’! কখনও কর্নাটকের দুই জোট শরিক কংগ্রেস ও জেডি(এস)-র বিধায়কদের তারা ভাঙিয়ে নেয়, আবার কখনও মধ্যপ্রদেশের জ্যোতিরাদিত্য সিন্ধিয়ার মতো হেভিওয়েট ‘অতৃপ্ত আত্মা’ বিজেপির অন্যতম ভরসা হয়ে ওঠেন।

রাজস্থানের শচীন পাইলটকে তারা অতৃপ্ত আত্মার পূর্ণরূপ দিতে চেয়েছিল। যদিও তিনি মতাদর্শগত অবস্থানে শেষ পর্যন্ত অটুট থাকায় সিন্ধিয়ার এই বন্ধুকে এখনও পর্যন্ত সুবিধা করতে পারেনি গেরুয়া শিবির। শুধু যে ক্ষমতায় থাকার সময় কংগ্রেস বা অন্য বিরোধীদলদের তারা ভাঙাচ্ছে তা নয়। গোয়ায় পিছনের রাস্তা দিয়ে ক্ষমতা দখলের পর এর আগের বিধানসভায় বিরোধী কংগ্রেসকে প্রয়োজনমতো তারা ভাঙিয়ে নিয়েছিল।

দেখা যাচ্ছে ক্ষমতা দখলের জন্য বিজেপি আদর্শকে শিকেয় তুলতে মুহূর্তের জন্য ভাবে না।

সম্প্রতি বিজেপির অন্যতম পছন্দের অতৃপ্ত আত্মা হয়ে উঠেছেন মহারাষ্ট্রের থানে-কল্যাণগড় এলাকার দাপুটে শিবসেনা নেতা তথা সে রাজ্যে নগর উন্নয়নমন্ত্রী একনাথ শিন্ডে। দলে দাপট ক্রমশ কমতে থাকায় শিন্ডে বেশ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠছিলেন কিছুদিন ধরেই। সেই সুযোগটা ভালোমতোই কাজে লাগিয়েছে বিজেপি।

এক্ষেত্রে কেন্দ্রের শাসক দলের ভূমিকা হল ধরি মাছ না ছুঁই পানি। তারা সরাসরি শাসকদলের বিধায়কদের নিজের দিকে টেনে আনে না। প্রথমে শাসক দলে ভাঙন ধরিয়ে সরকারকে সংখ্যালঘু করে দেয়, তারপর বিক্ষুব্ধদের নিজেদের দলে যোগদান করায়। যদিও কর্নাটকের ক্ষেত্রে ঘটনাক্রম অন্য ছিল। সেখানে অতৃপ্ত কংগ্রেস ও জেডি(এস) বিধায়কদের সরাসরি নিজেদের দলে যোগদান করিয়েছিল।

দুজনের সঙ্গেই বিজেপি যোগ, রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে ভোট নাও দিতে পারেন ‘বাম’ বন্ধু নৌশাদ

মহারাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বিদ্রোহে বিজেপি বলার চেষ্টা করছে এর পিছনে তাদের কোনও হাত নেই। প্রকাশ্যে বিষয়টি কিছুটা সেরকম মনে হলেও আসল ঘটনা সম্পূর্ণ আলাদা। চল্লিশ জনেরও বেশি বিধায়ককে নিয়ে প্রথমে গুজরাট ও পরে সেখান থেকে অসম উড়ে গেলেন শিন্ডে, আর এটা বিজেপির সাহায্য ছাড়াই হল তা কেউ বিশ্বাস করবে না। শিবসেনা, কংগ্রেস ও এনসিপি’র অভিযোগ এর পিছনে মোটা অঙ্কের লেনদেন জড়িয়ে আছে।

যা পরিস্থিতি তাতে মহারাষ্ট্রের মহাজোট সরকারের পতন প্রায় অবশ্যম্ভাবী। শোনা যাচ্ছে এরপর বিজেপির টার্গেট ঝাড়খণ্ড। সে রাজ্যে কংগ্রেস ও ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চার জোট সরকার ক্ষমতায় আছে। এমনিতেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দুই শরিকের মধ্যে দূরত্ব স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ঝাড়খণ্ড মুক্তি মোর্চা এনডিএ শিবিরের প্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মুর আদিবাসী পরিচয়কে সামনে রেখে তাঁকে সমর্থনের কথা ঘোষণা করেছে।

ঝাড়খণ্ডে অপারেশন লোটাস সফল হলে রাজস্থানের দিকে নজর দিতে পারে গেরুয়া শিবির। সব মিলিয়ে বিজেপির এই অতৃপ্ত আত্মা খুঁজে বেড়ানোর প্রবণতাকে কটাক্ষ করে বিরোধী শিবিরের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, ভারতীয় রাজনীতিতে ‘রক্তপিশাচ’ হয়ে উঠেছে কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন দলটি। বিরোধী দেখলেই তার রক্ত চুষে শেষ করে দিতে চাইছে! এ কিন্তু গণতন্ত্রের পক্ষে অতি বিপজ্জনক প্রবণতা।

সম্পর্কিত পোস্ট