উত্তরবঙ্গ নিয়ে সংসদে যেতে চায় বিজেপি

নয়ন রায় ও শুভজিৎ চক্রবর্তী 

উত্তরবঙ্গকে কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল করার দাবীতে সংসদে হাজির হবেন। দ্য কোয়ারিকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে এমনটাই জানিয়েছেন আলিপুরদুয়ারের বিজেপি সাংসদ জন বার্লা৷ এমনকি বিষয়টি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দ্বারস্থ হবেন বলেও জানিয়েছেন জন বার্লা৷

তিনি আরও বলেন, উত্তরবঙ্গের সাতটি রাজ্যের আলাদা আলাদা দাবী রয়েছে। কেউ গ্রেটার কোচবিহার চাইছে। কেউ আবার গোর্খাল্যান্ডের দাবী জানাচ্ছে৷ সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে কারোর যাতে না আঘাত লাগে সেই কথা ভেবেই কেন্দ্র সিদ্ধান্ত নেবে। কারণ, মানুষের আর্শীবাদ নিয়ে আমরা সংসদে গিয়েছি। মানুষের দাবীর কথাই আমাদেরকে বলতে হবে৷

নতুন করে রাজ্য তৈরি হলে সমস্যা হতে পারে। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা হাতের বাইরে যেতে পারে। এবিষয়ে সাংসদের মন্তব্য, জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা তুলে নেওয়ার সময়েও অনেকে বলেছিলেন রক্ত গঙ্গা বইতে পারে৷ কিন্তু আদতে তো তা হয়নি। তাহলে এখন কেন হবে?

উত্তরবঙ্গকে আলাদা কেন্দ্রশাসিত অঞ্চলের বিরোধিতা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর সাফ বক্তব্য, কোনওমতেই উত্তরবঙ্গকে আলাদা বাংলা থেকে করতে দেবো না। বিজেপি যদি মনে করে আলিপুরদুয়ার, দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি বেচে দেবো, এত সস্তা নয়। যদিও এবিষয়ে সাংসদের মন্তব্য, বিষয়টি নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার ভাববে। মুখ্যমন্ত্রীর এবিষয়ে মাথাব্যাথার কোনও প্রয়োজন নেই।

উত্তরবঙ্গ নিয়ে রাজ্য রাজনীতিতে অস্থিরতা নতুন কিছু নয়৷ গোর্খাল্যান্ড ইস্যুতে উত্তপ্ত পাহাড়ের ছবি দেখেছে গোটা রাজ্য। ১৯০৯ থেকে চলে আসা এই আন্দোলন এখনও ধামা চাপা পড়েনি। আশির দশকে সুভাষ ঘিসিংয়ের নেতৃত্বে এই আন্দোলন জাতীয় রাজনীতিতে উঠে এসেছিল বারবার।

১৯৮৬ সালে গোর্খা ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্টের নেতৃত্বে আন্দোলনে শামিল হয় পাহাড়বাসী। এরপর ১৯৮৮ সালে দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিল নামে একটি সেমিঅটোনোমাস বডি তৈরি করা হয়৷

ষষ্ঠ তফসিলি উপজাতি পরিষদের অনুযায়ী সুভাষ ঘিসিংয়ের হাতে ছিল ডিজিএইচসির দায়িত্ব। ২০০৪ সালে জিএনএলএফ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন বিমল গুরুং৷ ইন্ডিয়ান আইডল গায়ক প্রশান্ত তামাংয়ের উপস্থিতিতে প্রচুর জনসমর্থন পান তিনি। ২০০৭ সালে গঠিত হয় গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা।

২০১০ সালের মে মাসে অখিল ভারতীয় গোর্খা লিগের সদস্য মদন তামাংয়ের হত্যাকে কেন্দ্র করে পাহাড়ের রাজনৈতিক উত্তাপ বাড়তে শুরু করে৷ অভিযোগ ওঠে গজমম সমর্থকদের দিকে৷ ২০১১ সালে আবার উত্তপ্ত হয় পাহাড়৷ গোরুবাথান থেকে জয়গাঁওয়ের এক মিছিলে ৩ জন গজমম সমর্থকের মৃত্যুকে ঘিরে পাহাড়ে একটানা দীর্ঘ সময় ধরে বনধ চলতে থাকে।

২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনে ৪ টি আসন পায় গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা এবং তাঁর সমর্থকরা৷ ২০১৩ সালের অগাস্ট মাসে একটানা পাহাড়ে বনধ। হাইকোর্টের নির্দেশে পাহাড়ে ১০ কোম্পানি কেন্দ্রীয় বাহিনী পাঠানো হয়। দুই দিন ধরে গজমম নেতাদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হয়।

২০১৭ সালে আরও একবার উত্তপ্ত হয়ে ওঠে পাহাড়। গোর্খাল্যান্ডের দাবীতে পাহাড়ে দীর্ঘ আন্দোলনের ডাক দেয় গজমম৷ সেবার পুলিশ অফিসার অমিতাভ মালিকের মৃত্যুর ঘটনায় পাহাড়ে আগুন জ্বলতে শুরু করে। জায়গায় চলে বিক্ষোভ। দীর্ঘ সময় ধরে স্তব্ধ হয়ে যায় পাহাড়ের জনজীবন। মাথায় ইউএপিএ এর মামলা নিয়ে বেপাত্তা হন বিমল গুরুং।

সাড়ে তিন বছর পর ফিরে আসা গুরুংয়ের মুখে মমতা বন্দোপাধ্যায়ের অভয়বাণী৷ শিবির বদল করে পাহাড়ে ফিরলেন বিমল। জনসভাও করলেন৷ পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবীতে সরব হওয়া এই বিমল গুরুং একসময় বলেছিলেন মমতা বিভাজনের রাজনীতি করছেন। আর এখন তাঁর দলেরই শরীক দলের অন্যতম সদস্য তিনি। তাহলে গুরুং নিয়ে কী মমতার অবস্থান বদলে গেল?

এবিষয়ে দ্য কোয়ারিকে বিমল শিবিরের অন্যতম নেতা রোশন গিরি বলেন, আমরা পাহাড়, তরাই, ডুয়ার্স নিয়ে ভারছি। কে কী বলল তা নিয়ে আমাদের কোনও মাথাব্যাথা নেই।

হড়কা বাহাদূর ছেত্রী দ্য কোয়ারিকে বলেন, প্রথমেই সাংবাদিক বৈঠক দেখে মনে হয়েছিল এটা বিজেপি করবে না। কারণ, বিজেপির যদি করার হতো তাহলে এভাবে সাংবাদিক বৈঠক করে বলত না। ওরা যেটা করে চুপচাপ দেয়। এর আগে যখন ওরা জম্মু-কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা তুলে নেয় তখন ওরা বলে করেনি। আর এবিষয়ে তো রাজু বিস্ত কিছুই বলেলনি। জন বার্লা বললে কী হবে? জন বার্লা তো আর নরেন্দ্র মোদী নয়৷ যদি এবিষয়ে আলোচনাও হয়, তাহলে ভালো। কারণ, ভারতের মতো গণতান্ত্রিক দেশে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়োজন বলে আমিও মনে করি। তবে বিজেপি কী সিদ্ধান্ত নেবে সেটা অবশ্যই দেখার রয়েছে।

জন বার্লার এই মন্তব্য নিয়ে বাম নেতা অশোক ভট্টাচার্য দ্য কোয়ারিকে বলেন, বিজেপির এই দাবী নতুন কিছু নয়৷ এর আগে ষাটের দশকে কান্তাপুর, তারপর গ্রেটার কোচবিহার এখন আবার উত্তরবঙ্গ আলাদা করার কথা বলছে। আসলে উত্তরবঙ্গে সমস্ত জাতি, উপজাতি এবং জনজাতির মানুষ ঐক্যবদ্ধভাবে বসবাস করে। সেটাকে বিঘ্নিত করার চেষ্টা করছে বিজেপি। বিজেপি আসলে বাংলা বিরোধী দল। সেটাই প্রমাণিত হচ্ছে বারবার।

সম্পর্কিত পোস্ট