দিল্লি হিংসা : বিহার ও বাংলায় ভোটে ধাক্কা খাবে বিজেপি
।। দিলীপ রায় ।।
উত্তরপূর্ব দিল্লির সাম্প্রতিক ভয়াবহ হিংসার ঘটনার বিরূপ প্রভাব পড়বে বিহার ও বাংলার নির্বাচনে। জোর ধাক্কা খাবে বিজেপি। এনআরসি, এনপিআর ও সিএএ-র মাধ্যমে কৌশলে ধর্মীয় মেরুকরণ করে ফায়দা তোলার চেষ্টাও ব্যর্থ হবে গেরুয়া শিবিরের।
এমনই মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ। তাঁদের মতে, ঝাড়খন্ড ও দিল্লি বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপির বিপর্যয় প্রমাণ করেছে যে, প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়েছে কিনা তা দেখে ভোট দেয় জনগণ, ‘হিন্দুত্ব’, ‘জাতীয়তাবাদ’ এবং নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বাজনা শুনে ভোট দেয় না।
কিন্তু বিজেপি তার দলীয় এজেন্ডা নিয়েই ভোট করছে। দেশ দেশ বলে চিৎকার করলেও দেশের নয়, দলীয় এজেন্ডা ‘হিন্দুত্ব’ তাসই খেলছে বিজেপি। কৌশলে ধর্মীয় মেরুকরণের লক্ষ্যে দেশ জুড়ে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএ এ), জাতীয় নাগরিক পঞ্জী (এনআরসি) এবং জাতীয় জনসংখ্যা পঞ্জী (এনপিআর) লাগু করার চেষ্টা করছে।
আরও পড়ুনঃদিল্লি হিংসা : এখনই বিতর্ক এড়ালো সরকার, বুধবার পর্যন্ত মুলতুবি সংসদ
আর এর বিরুদ্ধে দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে তীব্র আন্দোলন। এই আন্দোলনের জেরে এবং দিল্লির ভয়াবহ হিংসার ঘটনায় বিজেপির জনভিত্তি দ্রুত হ্রাস পেতে শুরু করেছে। যার ফলে বিহার ও বাংলার ভোটে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়তে চলেছে কেন্দ্রের শাসকদল। বাংলা দখল অমিত শাহদের টার্গেট হলেও সেটা সহজ হবে না বলেই মত রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশের।
কারণ, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিএএ, এনআরসি, এনপিআর-এর বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে আন্দোলন করছেন। এ রাজ্যে এনআরসি লাগু করতে দেবেন না ঘোষণা করেছেন। অন্যদিকে, ধর্মীয় পরিচয়ের ভিত্তিতে নাগরিকত্ব দেওয়ার অসাংবিধানিক বা সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষ নীতি বিরোধী আইনের প্রতিবাদে সারা দেশের লাগাতার আন্দোলনের প্রভাবও পড়বে বাংলার ভোটেও মনে করছেন তাঁরা।
রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে, দিল্লির শাহিনবাগে মুসলিম মহিলা সহ অন্যান্যদের দুমাসের বেশি সময় ধরে চলমান ধরনা অবস্থান, শাহিনবাগের প্রেরণায় কলকাতার পার্কসার্কাস সহ দেশের নানান প্রান্তে সিএএ-এর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ অবস্থান, দলিত, আদিবাসী ও অন্যান্য অনগ্রসর সম্প্রদায়ের মানুষের দেশব্যাপী আন্দোলন ভোটে চ্যালেঞ্জ জানাবে বিজেপিকে।
আরও পড়ুনঃ দেশের অর্থনীতিতে ভয়ঙ্কর প্রভাব ফেলতে চলেছে করোনাঃ মনমোহন সিং
এছাড়াও, মোদি সরকারের সেকেন্ড ইনিংস-এ জম্মু-কাশ্মীরের বিশেষ সুবিধা বিলোপ, রামমন্দির, নাগরিকত্ব আইন দিয়ে বিভাজনের রাজনীতির পাশাপাশি দেশের আর্থিক সঙ্কটের ছবি নিয়েও প্রশ্ন উঠবে ভোটারদের মনে। জিএসটির ফলে কর্মচ্যুত বিপুল পরিমাণ মানুষ, বন্ধ হয়ে যাওয়া ছোট ছোট সংস্থার মালিক, কেন্দ্রীয় সরকারের ‘উজ্জ্বলা যোজনা’র মতো প্রকল্পে গ্যাস নিয়ে তা ধারাবাহিক ভাবে চালু রাখতে অক্ষম গৃহবধূদের ভোট স্বাভাবিক ভাবেই হারাবে বিজেপি।
সচেতন মানুষ জানেন, বিজেপি সরকারের দ্বিতীয় ইনিংস-এ বেকারত্বের হার রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে, ব্যাঙ্কের অবস্থা সঙ্কটজনক, দেশের ঋণের বোঝা বাড়ছে। কিন্তু প্রতিশ্রুতি মতো কালো টাকা দেশে ফিরে আসেনি। অথচ, দিল্লিতে সাম্প্রদায়িক হিংসায় ৫৩ জনের মৃত্যু হয়েছে। জখম হয়েছেন কয়েকশো মানুষ। ফলে বাংলার সচেতন মানুষ এদিকে লক্ষ্য রেখে বিজেপিকে সমর্থন করবেন না বলেই মত তাঁদের।
অন্যদিকে, বিহারে এনডিএ শরিক জেডিইউ প্রধান, মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারও ঘোষণা করেছেন যে, বিহারে এনআরসি কার্যকর করা হবে না। এনিয়ে রাজ্য বিধানসভায় প্রস্তাব পাসও করেছেন তিনি। সরকারি চাকরিতে পদোন্নতির ক্ষেত্রে তফসিলি জাতির সংরক্ষণ কোনও অধিকার হতে পারে না বলে সম্প্রতি সুপ্রিম কোর্ট যে রায় দিয়েছে, সেনিয়ে দলিতদের আশ্বস্ত করার জন্য বিজেপির কাছে দাবিও করেছেন নীতিশ।
সংসদে বিষয়টি উত্থাপিত করার দাবিও করেছেন তিনি। কিন্তু নীতিশকে বেশ খানিকটা চিন্তায় ফেলেছে জনপ্রিয় তরুণ বাম নেতা কানহাইয়া কুমার। সিএএ, এনআরসি, এনপিআর-এর বিরুদ্ধে বিহার জুড়ে কানহাইয়া প্রচার কিছুটা হলেও বিজেপির জনভিত্তি হ্রাস করেছে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞদের একাংশ।
কানহাইয়ার প্রায় প্রতিটি জনসভায় লক্ষাধিক মানুষের উপস্থিতি বিজেপি নেতাদের কপালেও ভাজ ফেলেছে। যার ফলে ফের কানহাইয়ার বিরুদ্ধে ‘রাষ্ট্রদ্রোহিতা’র মামলা টেনেটুনে বের করা হয়েছে বলে মনে করছেন অনেকেই। যদিও তাতে গেরুয়া শিবিরের খুব একটা লাভ হবে না।
কারণ, জনসংখ্যার সুবিপুল অংশ দলিত, আদিবাসী, সংখ্যালঘু এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির মানুষ বিজেপির থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করেছে। ফলে বিহারেও কঠিন চ্যালঞ্জের মুখে পড়তে চলেছে বিজেপি তথা এনডিএ।