ফিরে আসুন বুদ্ধবাবু, লড়াইটা লড়তে হবে….
সহেলী চক্রবর্তী
শেষবার তাঁকে জনসমক্ষে দেখা গিয়েছিল ২০১৯ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী। সাদা বুলেটপ্রুফ গাড়ি। গাড়ির ডানপাশে তিনি।
পরনে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি। মাথা ভর্তি ধবধবে সাদা চুল। একমুখ দাড়ি ও চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। নাকে অক্সিজেনের নল। বাঁদিকে তাঁর সহধর্মিনী। মাঝখানে পোর্টেবেল অক্সিজেন সিলিন্ডার।
আশা করি কার কথা এই প্রতিবদেনে তুলে ধরব তা প্রথমে বুঝতে কিঞ্চিৎ সমস্যা হলেও এখন একদম স্পষ্ট। তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। এ রাজ্যের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী এবং পশ্চিমবঙ্গে জ্যোতিহীন বামেদের একমাত্র অভিভাবক।
কলকাতা বলতে যেমন বোঝায় প্রাণকেন্দ্র হাওড়া ব্রিজ। ঠিক তেমনই বামপন্থী বলতে সবার আগে যে নাম মনে আসে তিনি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
আদ্যোপান্ত বামপন্থী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শারীরিক অসুস্থতার কারণে রাজনীতির ময়দান থেকে যোজন যোজন দূরে। তা সত্ত্বেও তাঁর জনপ্রিয়তা জনমানসে এতটুকুও কমেনি। তাই এখনো এ রাজ্যের মানুষ বাম বিরোধী মন্তব্য করলেও বুদ্ধ বিরোধী মন্তব্য প্রকাশ করতে গিয়ে আটকে যান।
রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও একাধিকবার বলেছেন বামপন্থীদের সঙ্গে যতই তাঁর মতবিরোধ থাকুক না কেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের মত মানুষ রাজনীতির ময়দানে বিরল।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রামে এই বুদ্ধবাবুর সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করেই রাজ্যে ‘পরিবর্তন’ এনেছিলেন তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
তারপর তাঁর গলাতেই শোনা গেছে “বাংলায় এখন আর কেউ প্রকৃত ‘বামপন্থী’ নেই। বাংলায় যে কজন বামপন্থী আছেন, তাঁদের মধ্যে বুদ্ধবাবু ছাড়া আর কাউকে আমি বামপন্থী বলে মনে করি না!”
বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে অতিবড় নিন্দুকও বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে হয়ত বুদ্ধবাবুকে মিস করেন। যতবারই আলিমুদ্দিন গেছি বাম শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে দেখা করতে ততবারই জিজ্ঞাসা করেছি বুদ্ধবাবুর কথা।
২০১১ সালে রাজ্যে পরিবর্তন এসেছিল। ধীরে ধীরে সেই পরিবর্তনের পিঠ দেওয়ালে ঠেকে গিয়েছে।রাজনৈতিক মহলে প্রশ্ন উঠছে শাসকদলের সততার রাজনীতি নিয়ে। রাজনৈতিক মহলের একাংশের মতে বর্তমানে সততার রাজনীতির অপব্যখ্যা করা হলেও বুদ্ধ বাবু সততার রোল মডেল। রাজ্যের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রীর দিকে সততা নিয়ে আঙুল উঠলেও বুদ্ধবাবুর সাদা পোশাকে আজ অবধি কালি লাগাতে পারেননি কেউ।
বুদ্ধবাবুর বক্তৃতা স্বচ্ছন্দগতি বিশিষ্ট নয়। কিছুটা আটকে আটকে যাওয়া শব্দের মালা। যার তীরে কেঁপে উঠত ব্রিগেড। কেশপুর থেকে আমলাশোল। সিঙ্গুর থেকে নন্দীগ্রাম। নেতাই থেকে জঙ্গলমহল। এই সমস্ত ঘটনাকালে তাঁর নেওয়া সিদ্ধান্ত আজও মনে রেখেছেন বামপন্থীরা।
সিঙ্গুর-নন্দীগ্রাম পর্ব থেকেই বিতর্ক তাড়া করতে শুরু করে তাঁকে। যদিও সেই সময়ও তিনি স্পষ্টই বলেছিলেন, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি, শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ।’ তাঁর সেদিনের স্পষ্ট উক্তি আজ হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারছেন বাংলার তথাকথিত শিক্ষিত যুবসমাজ।
২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাম-কংগ্রেস জোটের কারিগর ছিলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। তিনিই ২০২১ এর নির্বাচনের আগে পাম অ্যাভিনিউর ছোট্ট ফ্ল্যাটে আবদ্ধ। কিন্তু তাঁর বপন করা জোটের বীজকে বটগাছে পরিণত করে ঘুরে দাঁড়াতে বদ্ধপরিকর বামপন্থীরা।
২০২১ এর নির্বাচনী লড়াইটা বামদের কাছে চ্যালেঞ্জ। হয়ত এবারেও পাম অ্যাভিনিউয়ের ছোট্ট ফ্ল্যাট থেকে দলের কর্মী সমর্থকদের উজ্জিবিত করতে কিছু বার্তা দেবেন তিনি। তবে বুদ্ধ বিনা সূর্য-বিমান-সুজন-সেলিম-বিকাশ-দের লড়াইটা বেশ কঠিন হবে, তার ইঙ্গিত স্পষ্ট।
রাজনৈতিক মহলের একাংশের কথায়, বঙ্গ রাজনীতি জ্যোতিহীন। এই পরিস্থিতিতে বুদ্ধদেবের অনুপস্থিতি কোথাও না কোথাও পথ হারাতে বাধ্য করছে বামপন্থীদের।
কবি সুকান্তের ভাইপো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সাম্রাজ্যবাদ বিরোধীদের প্রধান মুখ ছিলেন তা স্বীকার করেন বামপন্থীরাই। কমিউনিজম থেকে কমিউনিস্ট। দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে আজও যিনি প্রথমদিনের মতই জনপ্রিয়।
২০১০ সাল থেকে সিওপিডির সমস্যায় ভুগছেন তিনি। ২০১১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে বাম দুর্গ ভেঙে যায়। তারপর থেকে অসুস্থতা যেন আরও গ্রাস করে তাঁকে। দলীয় কাজকর্ম থেকেও নিজেকে গুটিয়ে নেন।
৭৭ বছরের অশক্ত শরীরটার কাছে লড়াকু মনটাও হার মেনেছে। যারা চরম বামপন্থী তারা এখনও বিশ্বাস করেন আজও একবার যদি পক্ককেশ মানুষটা দলের কর্মীদের উদ্দেশে হাত নাড়েন।যদি একবার বলেন “লড়াইটা চালিয়ে যেতে হবে” তাহলে এক লহমায় পশ্চিমবঙ্গের কোনায় কোনায় লুকিয়ে থাকা বামপন্থীরা আবারও মুঠো শক্ত করে ঘুরে দাঁড়াবেন। আপাদমস্তক দলের চেহারাটাই যেন বদলে যাবে।
কিন্তু বাস্তবে তা যে আর সম্ভব নয়, সেটা আমরা সকলেই জানি। বামপন্থীরা এখনও গুনগুন করে বলে ওঠেন,
এখনো আমার মনে তোমার উজ্জ্বল উপস্থিতি,
প্রত্যেক নিভৃত ক্ষণে মত্ততা ছড়ায় যথারীতি,
এখনো তোমার গানে সহসা উদ্বেল হয়ে উঠি,
নির্ভয়ে উপেক্ষা করি জঠরের নিঃশব্দ ভ্রূকুটি;
এখনো প্রাণের স্তরে স্তরে,
তোমার দানের মাটি সোনার ফসল তুলে ধরে।
এখনো স্বগত ভাবাবেগে,
মনের গভীর অন্ধকারে তোমার সৃষ্টিরা থাকে জেগে
তবুও ক্ষুধিত দিন ক্রমশ সম্রাজ্য গড়ে তোলে,
গোপনে লাঞ্ছিত হই হানাদারী মৃত্যুর কবলে;
যদিও রক্তাক্ত দিন, তবু দৃপ্ত তোমার সৃষ্টিকে
এখনো প্রতিষ্ঠা করি আমার মনের দিকে দিকে।
কিন্তু মন মানতে চায় না। ব্রিগেডের লাল সৈনিকরা এখনো বলেন ফিরে আসুন বুদ্ধবাবু। লড়াইটা লড়তে হবে।
বর্তমানে সময়ের প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে কবি সুকান্তের লেখনীতে ও বুদ্ধবাবুর গলায় এই কবিতাটি বারবার মনে পড়ছে..
আমার প্রার্থনা শোনো পঁচিশে বৈশাখ,
আর একবার তুমি জন্ম দাও রবীন্দ্রনাথের।
হাতাশায় স্তব্ধ বাক্য; ভাষা চাই আমরা নির্বাক,
পাঠাব মৈত্রীর বাণী সারা পৃথিবীকে জানি ফের।
রবীন্দ্রনাথের কণ্ঠে আমাদের ভাষা যাবে শোনা
ভেঙে যাবে রুদ্ধশ্বাস নিরুদ্যম সুদীর্ঘ মৌনতা,
আমাদের দুঃখসুখে ব্যক্ত হবে প্রত্যেক রচনা।
পীড়নের প্রতিবাদে উচ্চারিত হবে সব কথা।
সুস্থ হয়ে আবার ফিরে আসুন বুদ্ধবাবু। বঙ্গ রাজনীতির এই চাটুকারিতার শিকল ভাঙতে আপনার উপস্থিতি একান্ত কাম্য। আপনার কন্ঠেই ফের পীড়নের প্রতিবাদে উচ্চারিত হোক সব কথা……. ।অপেক্ষায় থাকলাম। আপনার দীর্ঘায়ু কামনা করি।