বাজেটে কিছু নেই, তাই ঝুঁকিও নেই

দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ সাধারণ বাজেট মানেই তা গ্রাম ঘেঁষা না শহুরে জনতার, গরিবের নাকি পুঁজিপতিদের তা নিয়ে বিতর্ক দীর্ঘদিন ধরে দেখে আসছে মানুষ। কিন্তু মঙ্গলবার নির্মলা সীতারামন সংসদে যে বাজেট পেশ করলেন তাতে এমন কোনও বিশেষণ দেওয়ার বিশেষ জায়গা নেই।

তবে কি সর্বস্তরের কথা মাথায় রেখে অন্যান্য সুন্দর বাজেট পেশ করেছেন অর্থমন্ত্রী? তাও নয়। আসলে এক কথায় বলতে গেলে এবারের বাজেটে কিছুই নেই। এ এক ‘না’ বাজেটের গল্প!

নোট বন্দি এবং তার পরবর্তীকালে জিএসটি চালু হওয়ার ধাক্কায় দেশের ক্ষুদ্র শিল্পপতি থেকে শুরু করে ছোট ছোট ব্যবসায়ী সকলের অবস্থাই বেহাল হয়ে পড়েছিল। তার মধ্যে ২০২০ সালের বাজেট পেশের পর‌ই দেশে আছড়ে পড়ে করোনার ঢেউ। যার জেরে সরকারি কর্মীরা বাদে মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সকলের অবস্থাই অত্যন্ত খারাপ।

রোজগারের অভাবে দরিদ্রদের অবস্থা আরও শোচনীয়। নগদের অভাবে তাঁরা প্রয়োজনীয় খরচটুকুই মেটাতে পারছে না। তবে মহামারীর সুযোগে দেশের উচ্চবিত্তদের সম্পদ যুগপত বেড়েছে।

এইরকম অবস্থায় বিভিন্ন শ্রেণীর বাজেট নিয়ে প্রত্যাশা বিভিন্নরকমের ছিল। বিশেষ করে গত দু’বছরে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ায় অর্থনীতিবিদদের বেশিরভাগই দাবি তুলেছিলেন নগদের যোগান বাড়ানো নিয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা থাকুক বাজেটে।

দরিদ্রসীমার নিচে থাকা মানুষদের হাতে সরাসরি অর্থ দেওয়া যায় কিনা সেই প্রস্তাব‌ও ভেবে দেখার পরামর্শ দিয়েছিলেন তাঁরা। কারণ তাতে গরিবদের ক্রয় ক্ষমতা যেমন বাড়বে, তেমনই স্বাভাবিক নিয়মেই চাহিদা বেড়ে দেশের অর্থনীতিকে টেনে তোলার কাজ করবে। কারণ ভারতীয় অর্থনীতি এখনও মন্দাভাব পুরোপুরি কাটিয়ে উঠতে পারেনি।

সেইসঙ্গে নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণীর কথা মাথায় রেখে আয়করে ছাড়ের সীমা আড়াই লক্ষ টাকা থেকে বাড়িয়ে অন্ততপক্ষে তিন লক্ষ করার আশা করেছিলেন অনেকে। পরিস্থিতি এমন জায়গায় দাঁড়িয়েছিল যে কর ছাড়ের সীমা বাড়ছেই বলে ধরে নিয়েছিলেন বেশিরভাগই।

সেই সঙ্গে দেশের সম্পদ ও আয় বণ্টনের বৈষম্য চূড়ান্ত জায়গায় গিয়ে পৌঁছনোয় অর্থনীতিবিদদের একটা বড় অংশ অতি ধনীদের উপর উচ্চহারে কর চাপানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন সরকারকে। তাতে আয় বৈষম্য যেমন কমবে, তেমনই সরকারের ভাঁড়ার ভরে উঠবে।

কিন্তু বাজেটে দেখা গেল এসবের কিছুই হয়নি। অতি ধনীদের উপর বিজেপি সরকার যে অতিরিক্ত হারে কর চাপাবে না তা একরকম জানাই ছিল। কারণ সেটা বিজেপির নীতিগত অবস্থানের বিপক্ষে যেত। এমনিতেই অতি ধনী শিল্পপতিদের মদতপুষ্ট হয়েই ২০১৪ সালে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি।

কিন্তু অতিদরিদ্রদের জন্য বিশেষ কোনও প্রকল্পের কথা ঘোষণা না করে উল্টে ১০০ দিনের কাজে বরাদ্দ অর্থের পরিমাণ কমিয়ে দেওয়া হয়েছে। এতে কীভাবে অর্থনীতিকে টেনে তোলা হবে তার উত্তর বোধহয় একমাত্র নির্মলা সীতারামন‌ই দিতে পারবেন!

এই বাজেট থেকে একটা কথা পরিস্কার বলা যায়, মহামারীর ধাক্কায় বিধ্বস্ত নিচু তলার মানুষগুলোর কথা সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে যাওয়া হয়েছে। তাদের জন্য কিছুই নেই। এক্ষেত্রে সরকারের স্পষ্ট বার্তা- তোমরা নিজেরটা বুঝে নাও!

এদিকে ভারতে নিম্নমধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হারে বাড়ছে। অর্থনীতির মেরুদণ্ড এই মানুষগুলো। তাঁদের জন্য যেমন করছাড়ের সীমা বাড়েনি, তেমনই ঘুরপথেও আয়কর ছাড়ের সিমা বাড়ানোর ব্যবস্থা নেই।

ফলে স্পেন্ডিং অর্থাৎ খরচ কমিয়ে সেভিংস অর্থাৎ সঞ্চয়ের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা ষোলো আনা। তাতে চাহিদা কমতে পারে। সেক্ষেত্রে দেশের মন্দাভাব প্রকট আকার ধারণ করার সম্ভাবনা আছে।

এদিকে দেশের বেশিরভাগ মানুষ আজও গ্রামে বসবাস করেন। কিন্তু জিএসটির পর মহামারীর ধাক্কায় গ্রামীণ অর্থনীতি প্রায় তছনছ হয়ে গিয়েছে। সেখানকার বড় সংখ্যক মানুষ পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করেন। কিন্তু মহামারীর জন্য তাঁরা পরিবারের কাছে ফিরে আসার পর অনেকেই আর কর্মস্থলে ফিরে যাননি।

অথচ গ্রামীণ অর্থনীতির বেহাল অবস্থার কারণে তাঁদের অনেকের হাতেই কোন‌ও কাজ নেই। বর্তমানে গ্রামীণ ভারতে নগদের অভাব মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। কিন্তু সেদিকে নজর দিয়ে আলাদা কোনও পদক্ষেপ করেননি অর্থমন্ত্রী।

এক্ষেত্রে বিজেপির হাতিয়ার হতে পারে এমএসপিতে বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয়টি। বাজেট বক্তৃতায় এম‌এসপিতে বরাদ্দ বৃদ্ধির বিষয়টি। বাজেটে এমএসপিতে বরাদ্দ বাড়িয়ে ২.৩৭ লক্ষ কোটি টাকা করা হয়েছে। কৃষক আন্দোলনের পর এই বরাদ্দ বৃদ্ধি স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু সেক্ষেত্রেও যতটা বরাদ্দ বৃদ্ধির আশা করা হয়েছিল ঘোষিত সংখ্যাটা তার থেকে বেশ কিছুটা কম।

এই পরিস্থিতিতে প্রশ্ন উঠতে পারে তবে কি সরকার রক্ষণশীল নীতি নিয়ে বাজেট পেশ করেছে? উত্তর না। কারণ ২৫ হাজার কিলোমিটার রাস্তা তৈরির ঘোষণার মধ্য দিয়ে পরিকাঠামো উন্নয়নের একটা বার্তা অবশ্যই দেওয়া হয়েছে। এতে পরিকাঠামো শিল্পের সঙ্গে যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলি খুশিই হয়েছে।

সহজ করে বললে এই বাজেটে যেমন কিছু দেওয়া হয়নি তেমন নতুন করে কিছু কেড়ে নেওয়াও হয়নি। যদিও অর্থমন্ত্রী দাবি করেছেন এই বাজেট নাকি ২৫ বছরের রোডম্যাপ! সত্যিই এই বাজেট ২৫ বছরের রোডম্যাপ কিনা তা বুঝতে গেলে একটা বড় সময় লাগবে। কিন্তু এই বাজেট থেকে যে এক্ষুনি কিছু পাওয়ার নেই তা স্পষ্ট।

ডিজিটাল মুদ্রা প্রচলন, ই-পাসপোর্ট, প্রতি শ্রেণীর জন্য আঞ্চলিক ভাষায় একটি করে টিউটোরিয়াল টিভি চ্যানেলের ঘোষণা নিঃসন্দেহে আগামীর দিকে লক্ষ্য রেখে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। কিন্তু এতে চটজলদি অর্থনীতি চাঙ্গা হওয়ার কোনও ব্যাপার নেই। আর দ্রুত দেশের অর্থনৈতিক হল না ফেরাতে পাড়লে ভয়াবহ বিপদ বিপর্যয় ঘটতে পারে।

খুব সংগতভাবেই বিরোধীরা এই বাজেটের সমালোচনা করেছে। কংগ্রেসের প্রাক্তন সভাপতি রাহুল গান্ধী এই বাজেটকে দিশাহীন বলেছেন। তবে তিনিও পুরোপুরি ঠিক বলেননি। আসলে দিশা তৈরি করতে গিয়ে ব্যর্থ হলে তাকে দিশাহীন বলা যায়। কিন্তু এই বাজেট দেখে মনে হয়েছে মোদির পরামর্শে নির্মলা সীতারামন সচেতনভাবেই বাজেটে কোন‌ও দিশাই দিতে চাননি!

আসলে মহামারীর ধাক্কা কাটিয়ে খুব ধীরগতিতে হলেও ঘুরে দাঁড়াচ্ছে দেশের অর্থনীতি। এর পিছনে মোদি সরকারের আলাদা কোনও কৃতিত্ব নেই। বরং অতীতে অর্থনীতি নিয়ে ‘খোদার উপর খোদকারী’ করতে গিয়ে বারবার ব্যর্থ হয়েছে মোদি সরকার। এই পরিস্থিতিতে নতুন কিছু করার ঝুঁকি নিতে চাননি কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী। বরং কোন‌ও কিছু না করেই স্বাভাবিক গতিতে অর্থনীতিকে চলতে দিতে চেয়েছেন।

তাতে ভালো ফল হলে তার কৃতিত্ব দাবি করবে মোদি সরকার। আর যদি ফল ভালো না হয় তবে ২০২৪ এর লোকসভা ভোটের আগে তাদের হাতে আর‌ও দুটো বাজেট তো আছেই। তখন সাময়িক কিছু উপঢৌকন দিয়ে আবার মানুষের মন জিতে নেওয়ার সুযোগ তাদের কাছে থেকেই যাচ্ছে! এককথায় মঙ্গলবার দেশবাসী এক বিরল ‘না’ বাজেট দেখল!

সম্পর্কিত পোস্ট