আমার ও আপনার কথা, ভাল থাকবেন নিখিল দা…
নয়ন রায়
সাংবাদিকতা করবো এটা সেরকমভাবে কোনোদিনই ভাবিনি। ভেবেছিলাম আর পাঁচটা মধ্যবিত্তের মতো সামাজিক জীবন কাটিয়ে দেবো।
৯০ দশকের কথা। উত্তাল বাংলায় বামেরা তখন মধ্যগগনে। বিরোধী আসনে কংগ্রেস। তৃণমূল কংগ্রেসের জন্ম হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন রাজনৈতিক ভূগোল সম্পর্কে আগ্রহ মাথায় ক্রমশ ঘুরপাক খাচ্ছে। নিজেকে সংযত করতে না পেরে মাথাটা গলিয়ে দিলাম।
কিন্তু কীভাবে সংবাদ লিখব, কার সঙ্গে যোগাযোগ করব, সেইসব ভাবতে ভাবতেই বুক দুরু দুরু করে উঠল। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতেই সটান বর্ধমান জেলা পরিষদের সভাধিপতির চেম্বারে ঢুকে পড়লাম। চেয়ারে বসে নিখিলানন্দ সর।
প্রথম দেখাতেই প্রেমে পড়ে গেলাম। নিজের পরিচয় দিলাম। শুনলেন সবটা। তারপর আমার মত একজন সামান্য সাংবাদিককে জিজ্ঞাসা করেই বসলেন “বলুন, আপনার জন্য কী করতে পারি?”
প্রথম আলাপেই ‘আপনি’ শুনে মনটা বেশ ফুরফুরে হয়ে গেল। নিখিল বাবু উন্নয়নের খতিয়ান দিয়ে বললেন এই স্টোরিটা করুন। তবে খবর প্রকাশিত করে সংবাদপত্র টা দিয়ে যাবেন।
খবরটি করেছিলাম। প্রকাশিত সংবাদপত্রটি দিয়েও এসেছিলাম। তখন থেকেই তাঁর সঙ্গে আলাপের সূত্রপাত।
সরকার বিরোধী সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি জেলা পরিষদের দুর্নীতি নিয়ে চূড়ান্ত লেখালেখি করেছি সেসময়। একবারও নিখিল বাবু প্রশ্ন করেননি “কেন লিখছেন?” শুধু বলতেন সংবাদ একটু যাচাই করে নেবেন।
আজ নিখিলদা নেই। সাংবাদিকতার মধ্যগগনে এসে আজ বারবার মনে পড়ছে তাঁর কথা।
পেসার তাগিদে আমার সেসময়ের সংবাদের সোর্সকে তা উহ্যই রাখলাম।
এমনভাবে বেশ কয়েক বছর কেটে যাওয়ার পর নিখিলদা একদিন বললেন “এখানে না পড়ে থেকে রাজ্যের বাইরে গিয়ে সাংবাদিকতা করুন”।
ততদিনে নিখিলদা বর্ধমান লোকসভার সাংসদ হয়ে গেছেন। হয়তো তিনি কিছু ভেবেই আমার মত সাংবাদিককে উৎসাহিত করেছিলেন। আজ স্বীকার করতে আপত্তি নেই, আমার দিল্লিতে সাংবাদিকতা করার সাহসের মূল কারিগর নিখিলানন্দ সর।
তবে আমার দিল্লি যাওয়ার পিছনে নিখিলদার প্রচ্ছন্ন মদত আবার তৎকালীন জেলা পরিষদের নেতারা মেনে নিতে পারেনি। আজ তাদের কথা এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করার সময় নয়।
চাকরির খোঁজে দিল্লিতে যাওয়া। আর পাঁচটা ছেলের মত চাকরির মানসিকতা আমার মোটেও ছিল না। সাংবাদিকতা করবো এটাই আমাকে বারবার তাড়া করে বেরিয়েছে। যা আজও ভাবায়।
যাই হোক চাকরি জুটেছিল একটা সংবাদপত্রে। তাও চুক্তিভিত্তিক সাংবাদিক হিসাবে। এক কথায় যাকে বলে কোনোমতে পেটে-ভাতে থাকা। এখনকার মতো পরিস্থিতি সেদিন ছিলনা।
পরিস্থিতি আমার পক্ষে না বিপক্ষে, কিনা সেটা প্রধান বিষয় না। আগেই বলেছিলাম চাকরী করার মানসিকতা আমার ছিল না। সাত-পাঁচ চিন্তা আমায় তাড়া করে বেড়াত।
হঠাৎ চাকরিটা চলে গেল। কি করবো, কোথায় যাব ভাবছি। আর নর্থ অ্যাভিনিউর দিক দিয়ে হাঁটছি। হঠাৎ করেই মনে পড়ল ৮২ নম্বর কোয়ার্টারের কথা। সেখানে নিখিলদা থাকতেন।
শীতকাল। ১৯৯৯ সালের ডিসেম্বর মাস। কাঁপতে কাঁপতে নিখিল দার বাংলার কলিংবেল বাজালাম। দু মিনিটের মধ্যে নিখিলদা দরজা খুলে বললেন “আপনি! ভিতরে আসুন…।”
সামনের সোফায় বসতে বললেন। নিখিলদার দেখভাল করতেন বঙ্কু। তাকে বললেন দু’কাপ চা করতে বললেন।
চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম নিখিলদা একটা বাংলা কাগজ করছি। অবাক চোখে তাকিয়ে বললেন “সে তো অনেক টাকার ব্যাপার, পারবেন কিভাবে? সেদিন দৃঢ় কন্ঠে বলেছিলাম, নিখিলদা আমি পারবো..।
উত্তর এলো “কাগজের কী নাম?” আমি বললাম ‘কালবেলা’। হাসতে হাসতে বললেন “সত্যিই আমরা কালবেলায় দাঁড়িয়ে আছি”।
আর একটা কথা আজ বারবার মনে পড়ছে। সেদিন নিখিলদা গল্পের মাঝেই হঠাৎ জিজ্ঞাসা করেছিলেন, “আপনি পূর্ববঙ্গের লোক?” আমি জানতে চাইলাম হঠাৎ কেন তিনি একথা জিজ্ঞেস করলেন। নিখিল দার সেই হাসিতে গোটা ঘর গম গম করে উঠলো। বললেন “মন দিয়ে করুন কাগজ। আমি আছি।”
নিখিলদার আশীর্বাদ মাথায় নিয়ে ঝাঁপ দিলাম দেশের রাজধানীর মিডিয়া বাজারে। কাগজ প্রকাশিত হল। ১২ পাতার কাগজে অর্ধেক ভারত সরকারের বিজ্ঞাপনেই ভর্তি।
প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হওয়ার পর একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে নিখিলদার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। খুশি ছিলেন কিনা জানিনা। তবে একরাশ ভালোবাসা ছিল। কাগজটা হাতে নিয়ে বললেন “কাল থেকে আপনি ৮২ নম্বর নর্থ অ্যাভিনিউতে থাকবেন। তল্পিতল্পা নিয়ে চলে আসবেন আমি কেয়ারটেকার হরিকে বলে দেবো।”
২০০০ থেকে ২০০৩ সাল। এই সুদীর্ঘ সময় আমার নিখিলদার সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা সাংবাদিকতার জীবনে ছিল অনেক বড় প্রাপ্তি। এতে নিখিল দাকে অবশ্য অনেক ঝক্কি ঝামেলা পোহাতে হয়েছে। তবে ওসব পাত্তা না দিয়ে নিখিল দার ভূমিকা ও সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রাসঙ্গিকতা, সংসদের কার্যপ্রণালী কাছ দেখার অভিজ্ঞতা আমাকে সাংবাদিক হতে অনুপ্রাণিত করেছে।একথা বলতে আমি আজ সত্যিই ভালোবাসি।
রাজধানী ট্রেনের প্রথম শ্রেণীতে যাতায়াত। দূর্গাপুর নেমে বর্ধমান যাওয়া। স্মৃতি আজও টাটকা। এখনও লড়াইটা করছি। ২০০৩ সালের পর আমি নিখিলদার ঘর ছেড়ে দি। তারপর ২০০৫ সালে ‘কালবেলা’ বন্ধ করে বর্ধমান চলে আসি।
একথা নিখিলদা জানতেন। তাই ২০০৫ থেকে ২০২০। ১৫ বছর আমার সঙ্গে কোন যোগাযোগ রাখেননি। নিখিলদার ভাষায় পূর্ববঙ্গের ছেলেরা হেরে যায় না। তাই আমার দিল্লি থেকে ফিরে আসা মেনে নিতে কষ্ট হয়েছিল বলে মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত কোনোভাবেই আমার সঙ্গে দেখা করার চেষ্টা করেননি।
আমার প্রতি ভালোবাসা থাকলেও ১৫ বছর নিজেকে আমার কাছে ধরা দিলেন না। তাই নিখিলদার মৃত্যু আমাকে যন্ত্রণা দিয়েছে। আমার বেড়ে ওঠার পেছনে নিখিলদা ভূমিকা ছিল প্রধান। এটা বলতে আমার গর্ব হয়। নিখিলদা আপনার মৃত্যু আমার কাছে পিতৃবিয়োগের সমান। প্রকাশ করিনি আপনাকে কতটা ভালোবাসতাম। তাই মিস করবো আপনাকে।
তবে নিখিলদা একবার শুনুন, আমি নতুন করে আবার ‘কালবেলা’ পত্রিকাটি শুরু করলাম। ১৫ অগাস্ট দ্বিতীয় ধাপে নতুন করে স্বমহিমায় আত্মপ্রকাশ করল কালবেলা।আপনি দূরে থেকেও আমার কাছে আপনি অমর। সাংবাদিক জীবনে অনেকের মৃত্যু দেখেছি। কিন্তু মেনে নিতে পারলাম না আপনার চলে যাওয়াটা।
তাই ‘কালবেলা’র দ্বিতীয় জার্নিতে প্রথম সংখ্যাটি আপনাকে উৎসর্গ করলাম। প্রণাম নেবেন। আপনার কাছে ‘আমি’ থেকে ‘আপনি’ হয়ে ওঠা নয়ন রায় এখনও সাংবাদিক। লড়াইটা জারি আছে….