‘গো’-পাচার; পর্ব-১: ভোট মিটেছে, গরু পাচার‌ও বহাল তবিয়তে হচ্ছে, চুপ বিজেপিও! 

দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্ক: বিধানসভা ভোট চলে যাওয়ার পর প্রায় বছর ঘুরতে চলল, বাংলার গরু পাচার কী বন্ধ হয়ে গিয়েছে? সামনেই পুরসভা নির্বাচন। মুর্শিদাবাদ, মালদহ, দুই দিনাজপুর, কোচবিহার, উত্তর ২৪ পরগনা, নদিয়া জেলার গুচ্ছ পুরসভাতেও ভোট হবে। তার আগে গরু পাচার বন্ধ হল কিনা সে দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।

একুশের বিধানসভা ভোটে অন্যতম ইস্যু ছিল এই গরু পাচার। তা নিয়ে রাজ্য রাজনীতি রীতিমতো সরগরম হয়ে ওঠে। কয়লা ও গরু পাচার নিয়ে বিজেপি শোরগোল শুরু করার পর বাকি বিরোধীরাও তৃণমূলের মিডিয়া ট্রায়াল সেরে ফেলে।

তাদের স্পষ্ট অভিযোগ ছিল তৃণমূলের এক্কেবারে শীর্ষস্তরের নেতৃত্বেই রমরম করে গরু পাচার হচ্ছে বাংলায়। এই পাচারের অর্থের একটা বড় অংশ নাকি খোদ শাসকদলের শীর্ষ নেতাদের কাছে পৌঁছে যায়!

এই নিয়ে সিবিআই তদন্ত শুরু হয়েছিল। অবশ্য খাতায়-কলমে সেই তদন্ত এখনও চলছে। এরই মধ্যে ধরা পড়ে গরু পাচারের অন্যতম কিংপিন এনামুল হক। সেই সময় এমন ভাব দেখান‌ও হয়েছিল যেন এনামুলকে আটক করার ফলে গরু পাচার এবার পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে। তা সত্যিই কী গরু পাচার বন্ধ হয়েছে?

একের পর এক ঘটনা, বাস্তব পরিস্থিতি এবং গ্রাউন্ড জিরোর রিপোর্ট বলছে এনামুলের গ্রেফতারি গরু পাচারের এতোটুকু আঁচড় কাটতে পারেনি। আগে যেমন রমরম করে চলত এখনও তাই চলছে। পাচারকারীদের ‘নেটওয়ার্ক’ বহাল তবিয়তেই কাজ করছে। এলাকায় কান পাতলেই শোনা যাবে মুর্শিদাবাদ, মালদহ, কোচবিহারে এইরকম অসংখ্য এনামুল আছে!

পাচারকারীদের ‘নেটওয়ার্ক’ বিষয়টাই এক্ষেত্রে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ। এর মধ্যেই সব রহস্য লুকিয়ে আছে। এই নেটওয়ার্কের জাল নাকি তদন্তকারী সংস্থা সিবিআইয়ের ভিতরেও বিস্তৃত বলে বিভিন্ন সূত্রের দাবি! কেন্দ্র-রাজ্য শাসক দলের একাংশ‌ও পাচারকারীদের এই নেটওয়ার্কের মধ্যে আছেন। এই গোলমেলে বিষয়টা বরং গোড়া থেকেই বুঝে নেওয়া যাক।

গরু পাচার নিয়ে বিধানসভা ভোটের আগে বিজেপি পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও তৃণমূলকে ব্যাপক কোণঠাসা করার চেষ্টা করেছিল। তাতে অবশ্যই আমজনতার সমর্থন পাওয়ার একটা প্রবল সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এই গরুগুলো কোথা থেকে বাংলায় আসে সেটা জানলে চমকে উঠবেন।

বিজেপি শাসিত হরিয়ানা, উত্তরপ্রদেশ থেকেই মূলত প্রতিদিন ট্রাকের পর ট্রাক বোঝাই করে গরু পশ্চিমবঙ্গে এসে পৌঁছয়। উত্তর ভারতের বাকি রাজ্য, যেমন রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ থেকেও বেশকিছু গরু আসে। এর মধ্যে মধ্যপ্রদেশে বিজেপি ক্ষমতায় থাকলেও রাজস্থানে আবার ক্ষমতায় আছে কংগ্রেস।

উত্তর ভারত থেকে ট্রাক বোঝাই হয়ে গরুগুলো বিহার, ঝাড়খণ্ডের উপর দিয়ে পশ্চিম বর্ধমানের আসানসোল, নয় বীরভূমের দুবরাজপুরের দিকে ঢোকে। তারপর কোন‌ও ট্রাক মুর্শিদাবাদ, কোনটা মালদহ, আবার কোনোটা দুই দিনাজপুর, কোচবিহারের দিকে চলে যায়। বাংলার এই জেলাগুলি হল গরু পাচারের ‘বেস ক্যাম্প’।

এখানেই গরুর ঝাড়াই-বাছাইয়ের মূল কাজটা হয়। এক্ষেত্রে পাচারের গরুগুলিকে আপনারাও হয়তো কখনও সখন‌ও রাস্তায় দেখে থাকবেন। দেখবেন রাস্তা দিয়ে এক পাল গরু চলেছে, তাদের কানে নির্দিষ্ট রঙের ছাপ মারা আছে! এটার মাধ্যমে আসলে কোনটা কোন কোম্পানির গরু সেইটা চিহ্নিত করা হয়! এগুলো আসলে পাচারের জন্যই যাচ্ছে। প্রকাশ্য দিবালোকেই এই কাজটা ঘটে।

ঝাড়াই-বাছাইয়ের পর গরুর দাম একটু বাড়ে বা একটু কমে। কোনটা কোন কোম্পানির গরু সেটা চিহ্নিতকরণের কাজ মুর্শিদাবাদের জলঙ্গি, লালগোলা, সুতি, ভগবানপুর বা মালদহের চাঁচলের মতো যায়গায় হয়। এক্ষেত্রে মাথায় রাখতে হবে গরু পাচারের পুরো কাজটা যে শুধু উত্তরবঙ্গ দিয়ে হয় তা নয়, দক্ষিণবঙ্গে উত্তর ২৪ পরগনার স্বরূপনগর, বসিরহাট, বনগাঁর বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী এলাকাগুলি দিয়েও চলে।

নদিয়াও আছে এই তালিকায়। তাই কখন‌ও-সখন‌ও দক্ষিণবঙ্গেও ঝাড়াই-বাছাইয়ের কাজ চলে। বজবজ, মহেশতলা, মধ্যমগ্রাম, রাণাঘাটের রাস্তায় কানে নির্দিষ্ট কোম্পানির ছাপ মারা গরুর পালকে চলে যেতে দেখা যায়। এই একটা বিষয়ে বাংলার উত্তর-দক্ষিণে বেশ ভালো মিল আছে!

তাহলে কী দেখা গেল, যত গরু আসে তার বেশির ভাগটাই উত্তর ভারতের বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলো থেকে বাংলায় এসে পৌঁছছে। এমনকি যে রাস্তার উপর দিয়ে গরু বোঝাই ট্রাকগুলি আসে সেগুলোর একাংশ‌ও বিজেপি শাসিত। তবে বিরোধী দলের হাতে থাকা রাজ্য ঝাড়খন্ড‌ও এই তালিকায় আছে।

সত্যি যদি গরু পাচার আটকানোর জন্য কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি আন্তরিক হতো তবে তো তাদের হাতে থাকা রাজ্যগুলো থেকে বাংলায় গরু পাঠানো সবার আগে বন্ধ করত। আর সেটা হলে এই গরু পাচারের একেবারে গোড়ায় কুঠারাঘাত করা যেত। সেক্ষেত্রে বিজেপির ‘গো-মাতা’কে আর কেউ বাংলাদেশে পাঠাতেই পার‌ত না!

এখানেই হচ্ছে আসল টুইস্ট। এবার সরাসরি পশ্চিমবঙ্গের দিকে নজর দেওয়া যাক। রাজ্যের এক জেলা থেকে আরেক জেলায় সারি সারি ট্রাকবোঝাই গরু প্রতিদিন চলে যাচ্ছে, আর প্রশাসন ও পুলিশের কেউ কিচ্ছু জানে না এটা কখনই বিশ্বাস করা সম্ভব নয়। আচ্ছা ধরে নেওয়া গেল না হয় রাজ্য পুলিশ গরু পাচারকারীদের সঙ্গে যুক্ত। সেক্ষেত্রে বিএসএফের ভূমিকা কী? তারা কেন গরু পাচার ঠেকাতে পারে না?

এক্ষেত্রে যুক্তি দেওয়া হয় বাংলাদেশ সীমান্তবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া নেই। সেই সুযোগটাকেই কাজে লাগাচ্ছে পাচারকারীরা। বিএসএফের ক্ষেত্রে প্রতি ইঞ্চি জমিতে নজর রাখা সম্ভব নয়। এই যুক্তিটা একদমই ঠিক।

কিন্তু কোন কোন পয়েন্ট দিয়ে গরু পাচার হয় সেটা তো বিএসএফের এতদিনে অজানা থাকার কথা নয়। তাছাড়া শুধু মুর্শিদাবাদ জেলা দিয়েই প্রতিদিন প্রায় কয়েক হাজার গরু বাংলাদেশে পাচার হয়ে যায়। কিন্তু গরু পাচারকারীদের সঙ্গে বিএসএফের প্রতিদিন সংঘর্ষের কথা কী আপনি শোনেন? না, শোনেন না। কারণ সেটা ঘটে না!

অথচ প্রতিদিন যেখানে একটা জেলা দিয়ে কয়েক হাজার গরু পাচার হচ্ছে সেখানে কয়েকজন করে অন্তত গরু পাচারকারীর প্রতিদিন বিএসএফের হাতে ধরা পড়ার কথা। কিন্তু তা হয় না।

উল্টে স্থানীয় বাসিন্দাদের থেকে জানা যায় বিএসএফের সঙ্গে ভাগবাঁটোয়ারা নিয়ে গণ্ডগোল হলে তবেই তখন পাচারের সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন চুনোপুঁটি কে আটক হয়! এ যে সর্ষের মধ্যেই ভূত, থুড়ি আস্ত ব্রহ্মদত্বি!

সিবিআইয়ের তদন্ত থেকে যেটুকু সাধারন মানুষ জানতে পেরেছে এবং গ্রাউন্ড রিপোর্ট বলছে এনামুলের মতো লোকজনের সঙ্গে সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের বিশেষ ‘ডিল’ থাকে। অবশ্যই যখন যারা ক্ষমতায় থাকে তাদের প্রাপ্যের ভাগ বাকিদের থেকে অনেকটা বেশি হয়।

তাবলে ভাববেন না এসইউসি (সি)-এর মতো দলগুলোও এই টাকার ভাগ পায়! কারণ, এদের সঙ্গে ডিল করলেও যা, না করলেও তাই, ফলাফলে কোনও পার্থক্য নেই! তাই এরাও গরু পাচারের কাঞ্চন যোগ থেকে বঞ্চিত থাকে।

রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে এই ডিলের কারণ ‘সেফ প্যাসেজ’ তৈরি করা। অর্থাৎ, আমি যাই করি না কেন তুমি তাতে বাধা দেবে না। তোমার রাজনৈতিক কর্তৃত্ব কাজে লাগিয়ে পুলিশ-প্রশাসনকে আমার প্রতি পক্ষপাত মূলক আচরণ করতে সাহায্য করবে। একেবারে সহজ ব্যাপার!

আর পুলিশ পুলিশের ব্যাপারটা আর‌ও সহজ। রাস্তা দিয়ে শুধু তো আর গরু বোঝাই ট্রাক যায় না, আরও হাজার হাজার গাড়ি যায়। তাই তার ভিড়ে গরু বোঝাই ট্রাকগুলি নজর এড়িয়ে যেতেই পারে। তাতে অন্যায়ের কিছু নেই। আর সেই নজর এড়িয়ে যাওয়ার বিনিময়ে মোটা টাকা মাসোহারা জোটে আইনের রক্ষাকর্তাদের।

(চলবে…আজ রাত ৮ টায় পরবর্তী অংশ)

সম্পর্কিত পোস্ট