ভারতভাগ্যবিধাতা..

শুভজিৎ চক্রবর্তী

“অহরহ তব আহ্বান প্রচারিত, শুনি তব উদার বাণী

হিন্দু বৌদ্ধ শিখ জৈন পারসিক মুসলমান খৃস্টানী

পূরব পশ্চিম আসে তব সিংহাসন-পাশে

প্রেমহার হয় গাঁথা।

জনগণ-ঐক্য-বিধায়ক জয় হে ভারতভাগ্যবিধাতা!

জয় হে, জয় হে, জয় হে, জয় জয় জয়, জয় হে ॥”

সভ্যতা মানেই মুক্ত চেতনার খোলা আকাশ। যেখানে কোনও লড়াই নেই। কোনও হিংসা নেই। নেই কোনও দ্বন্দ্ব। বিচিত্রতার মধ্যে ঐক্যের সেই ছবি দেখেই রবি ঠাকুর রচনা করেছিলেন জাতীয় সঙ্গীত।

স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরেও রবি ঠাকুরের দেশপ্রেম এবং রাষ্ট্রবাদের সঙ্গে বিস্তর ফারাক পাই। এখনকার দিনে মানুষের মধ্যে রাষ্ট্রবাদের আগুন জ্বালিয়ে রাখতে ব্যবহারকারী জিনিসগুলো যেন বড়ই অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছে।

স্বাধীনতার এতদিন পরেও ‘কী পেলাম আর কী পেলাম না’ এই জিনিস খুঁজে বেড়াচ্ছি আমরা। সেখানে গিয়ে দেখতে পাই রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর আমাদের মধ্যে যে নজাগরণের বীজ বপন করে গিয়েছিলেন তা আমরা নিজেরাই উপড়ে ফেলে দিয়েছি৷ এখন সেটাকে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের ক্ষতি ধরেই আফশোস করি। বরং হাতের কাছে পাওয়া বোটানিক্যাল গার্ডেনের বড় বটগাছকে অ্যান্টিক পেটেন্ট দিয়ে দায় ঝেড়ে নিই।

যে কোনও সম্পর্ক এবং সম্প্রীতির মিলন প্রকৃতির কাছ থেকেই শেখা। আমরা তো সেটা ভুলতেই বসেছি। সেটা চোখ দিয়ে দেখার জন্য জোর গলায় “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি” বলার প্রয়োজন হওয়ার দরকার ছিল না।

কিন্তু তবুও যেন বিবিধের মাঝে প্রকৃতির মিলনের কথা জীবনানন্দ দাশ যদি না চোখ দিয়ে দেখিয়ে দিতেন তাহলে আমরা জানতেই পারতাম না। হয়তো এখানেই একজন লেখকের স্বার্থকতা। কিন্তু মানুষের মনে সেই চেতনার অভাব যদি হয় তাহলে আর লাভ কী?

স্বাধীনতার স্বার্থকতা সেখানেই, যখন জীবন হবে পবিত্র গঙ্গার মতো। কিন্তু এই কয়েক মাসে লকডাউনের কারণে তাতে অনেকটা ভাটা পড়েছে। একটা গোটা সভ্যতা, সমাজের অগ্রগতি স্থগিত হয়ে পড়েছে।

বরং এই মহামারিতেও ক্ষমতার বলে বলীয়ান হয়ে কিছু মানুষ অযাচিত কিছু তথ্য সামনে এনে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করছে। তাদের থেকে গণতান্ত্রিক ক্ষমতা কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা চলছে। অন্ন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানহারা হয়েছে বহু মানুষ। বলা হচ্ছে ‘নয়া ভারতের সূচনা’ হয়েছে।

এই ‘নয়া ভারতের সূচনা’ কোথায় হয়েছে তা খুঁজতে বেরিয়েছিলাম। কেউ বলল রাস্তায় আটকে পড়েছে। কেউ বলছে রাস্তায় দাঁড়িয়ে রয়েছে। অথচ এই নতুন ভারত নামক মহাযানের যারা চাকা তারাই বলে তাঁদের সঙ্গে দেখা হয়নি।

দেখা হয়নি সেই ক্ষমতাবান মানুষগুলোর সঙ্গে। যাদের টুইটারে ট্রেন্ডিং হতে হয়। যাদেরকে বলতে হয় তারা কতটা পপুলার। তবে সেখানে কী পবিত্র গঙ্গা বয়ে যায় না? না, সেখানে তো সুবর্ণরেখার আসা যাওয়া। সেখানে শালপাতার শিল্পে জিআই ট্যাগ নেই। আর মেলেনা পটশিল্পীদের গানও।

গঙ্গোত্রী হিমবাহের গোমুখ গুহা থেকে যখন উৎপত্তি হয়েছিল, তখন গঙ্গা ছিল সরু। ক্রমাগত ক্ষনন কার্য চালিয়ে যখন অববাহিকায় এল তখন সে বিরাট আকার ধারণ করল।

তখন তার ক্ষমতা কমে গিয়েছে। গোটা যাত্রাপথে সে যা তান্ডব চালিয়েছে সেই সমস্ত কিছু তাকেই বহন করে নিয়ে আসতে হয়েছে। সেটাই তার কাছে ইতিহাস।

আমাদের কাছেও এরকমই আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিকভাবে প্রতিনিয়ত যা ঘটে চলে সেসবই আমাদের জীবনের ইতিহাস।

ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাস ঠিক নদীর প্রবাহের মত। কতবার উত্থান পতনের মধ্য দিয়ে আজও সে বয়ে চলেছে। শুরু থেকে আলোচনা আজও হয়য কিন্তু তার গভীরতা পাওয়া যায় না।

স্পষ্ট করে বললে যা হয়, জওহরলাল নেহেরু থেকে শুরু করে ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী হয়ে ভিপি সিং, নরশিমা রাও। পরবর্তীকালে অটলবিহারী বাজপেয়ী এবং মনমোহন সিং এবং হালিতে নরেন্দ্র মোদি। ভারতবর্ষের আপাতত রাজনৈতিক যাত্রাপথে কে কতটা সফল তা বলা ভীষণ কঠিন।

এর বিস্তৃতি পুরানো বটগাছের মত। এটাকে শুধুমাত্র পুরাতনের পেটেন্ট দিলেই চলবে না। একে সমান্তরাল ভাবে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। তবে পূর্বে যে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনৈতিক ছবি ভারতের মানুষ দেখেছে, তা এখন অতীত।

নেহেরু জমানায় কঠিন ছিল অখন্ড ভারত নির্মাণ করা। পরবর্তীকালে ইন্দিরা গান্ধীর আমল থেকে সেই অখন্ড ভারতকে বিশ্বের কাছে প্রতিষ্ঠিত করা ছিল আরও চ্যালেঞ্জিং। পরবর্তীকালে ভারতের অন্তর্নিহিত সমস্যা সমাধানের দিকে অবশ্য বেশী করে নজর দেওয়া হয়।

যেখানে উঠে আসে কৃষকের কথা, ক্ষেত মজুরের কথা, দিন মজুরের কথা। লোহা পেটানো মানুষগুলোর কথা। রাজনীতি এখন কর্পোরেট হতে শুরু করেছে।

ঝাঁ চকচকে ইমারতের মত পার্টি অফিসে অবিরাম লোকজনের আনাগোনা। হ্যাশট্যাগ-ট্রেন্ডিংয়ের লড়াই। ঠিক এরই মাঝে আবার আমাদের পিছিয়ে দেয় করোনা নামের এই ভয়াবহ রোগ।

শুরুতে অনেকে বলেছিলেন করোনা গরিবের রোগ না। এ এমন এক ভাইরাস যারা ১৪ দিন আরামে মাংসের ঝোল সাঁটিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে পছন্দ করে তাদের ঘরে বাসা বাঁধে।

এরা গরিবের এঁদো গলি, পচা গন্ধের বস্তিতে আসতে নারাজ। কিন্তু করোনার তো কান নেই। তাই সে মানুষকে ভাতে মারতে থাকে। বাসস্থান হারানো মানুষগুলো পিপড়ের মত পিল পিল করে নিজের ভিটে ভূমির দিকে ছুটে চলে। কেউ হেঁটে, কেউ সাইকেলে, কেউ রিক্সায় চলেছে বিকাশকে মাথায় নিয়ে।

কোনও মা তার ছেলেকে সুটকেসের ওপর শুইয়ে নিয়ে চলেছেন। যাতে মায়ের কষ্ট ছেলে না বুঝতে পারে। আবার কোথাও সেই মাকেই ছেলে স্টেশনে বসিয়ে দিয়ে আসে। কোথায় যাবে সে কিছুই জানে না।

আবার কোথাও খেতে না পেয়ে মা মারা গিয়েছে এটাও তাঁর শিশু জানে না। কাপড় ধরে টানতে থাকে। মনে করে তার মা এখনও বেঁচে রয়েছে। কিন্তু মা তো মাই-ই হয়। লড়াই করে আঁচলে বাঁধা খাবারের টুকরো নিয়ে আসে তার সন্তানের জন্য।

গত কয়েকমাস ধরে লকডাউনের জেরে তার ছেলে যে অপুষ্টিতে ভুগছে। এই ছবি বিহার, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ এমনকি রাজধানী দিল্লিতে আকছার দেখা গেছে। যার মর্মান্তিক বর্ণনা করার মতো ক্ষমতা আমার নেই।

তবে এটা বলতে পারি এরপরেও হাজারের বেশী সময় ধরে চলা সংস্কৃতির ঐতিহ্য আমরা লোককে ডেকে এনে বহর করে দেখাতে ভালোবাসি। তার জন্য কোটি কোটি টাকা খরচ করতেও রাজি আমরা।

আগে বলা হত ‘গরিবি হটাও’। এখন বলা পরোক্ষভাবে বলা হয় ‘গরিবি মেটাও’। কিন্ত মেটানো বা হটানোতে সমস্যায় ফের আম জনতা। লাভের গুড় পিঁপড়েতে খেলো কি না খেলো লাইনে দাঁড়িয়ে পড়ল সবাই। বলা হল কালো ধন ফিরিয়ে আনা হবে। আমের লোভে সবাই তাই দাঁড়ালো। কিন্তু সেই গুড ফর নাথিং।

বঙ্কিমচন্দ্রের থেকে ধার করা ‘বন্দেমাতরম’ স্লোগান ধার করা যে ক্ষমতাধারী দলের টনক নড়েনা এতেও। বরং ট্রেন্ডিং হওয়া রিপোর্ট রাজনীতিতে বিশ্বাসী সকলেই।

সংকীর্ণ রাজনীতির চাপে পড়ে রয়েছে কৃষকরা। ভারতের জিডিপির যারা ২৭ শতাংশ নিয়ে বসে রয়েছে, তারাই এখন তিন অধ্যাদেশের কারণে ধর্না দিতে শুরু করেছে। এই ছবি পাঞ্জাবের।

স্বাধীনতার ৭৩ বছর পর ফসলের ন্যায্য মূল্যের দাবীতে তাঁদেরকেই পথে নামতে হয়। আবার সীমান্ত রক্ষায় এগিয়ে আসে সেই কৃষকের পরিবার। ঠিক আগেও যেমন বলছিলাম ভাইজ্যাগ শহর থেকে বেশ কিছু দূরে এমনও কিছু মানুষের অবস্থান করছে যাদের কাছে রাফায়েল কোনও মানে রাখে না। মাথায় ওপর সাঁই সাঁই করে বয়ে যাওয়া যুদ্ধবিমানের তুলনায় তারা নিজেদের সুরক্ষা চায়। স্বাস্থ্য, খাদ্যের সুরক্ষা চায় তাঁরা।

নির্বাচনী প্রচারে ভাষণের জন্য তারা উপস্থিত হয় না। তাদের কাছে যুদ্ধবিমান এবং ফোর এক্স ফোর মডেলের চার চাকার গাড়ি কল্পনা জগতের বাইরে। তাই সেটাই দেখতে উপস্থিত হয় তারা।

গোড়ার কথা বলতে গেলে ভারতবর্ষের মানচিত্রের দিকে তাকাতে হয়। একবার ভারতের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল উত্তর-পুর্ব৷ এখন তাদের মেইনস্ট্রিম মিডিয়াতে দেখা যায় না। যদিও এরা বলতে পারে। এরা আলোচনায় এগিয়ে আসতে পারে৷ কিন্তু দেশে সাদরে-ই-রিয়াশত গত এক বছরে নিস্তব্ধ।

তার নিস্তব্ধতা এতটাই যে সেখান থেকে কারোর আওয়াজ বাইরে আসে না। কিন্তু এটাও তো ভারতীয় ভূখন্ড। সঠিক চিকিৎসা না পাওয়া, বিক্রিবাটা বন্ধ থাকার অভিযোগ বা অনুযোগের ক্ষমতা এদেরও রয়েছে। এখনকার দিনে এসে মনে হচ্ছে এটা অনেকটা বটবৃক্ষের ফলের মত। যা থেকে নতুন গাছের জন্ম হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু এতে কারোর কিছু আসে বা যায় না।

ঠিক আপনারও ততটাই আসে বা যায় না। যখন আপনি এই লেখার প্রথম লাইন গুলো পড়ার সময় উঠে দাঁড়ালেন কি না। সিনেমা হলের অন্ধকারে পাশের জনের হয়তো দেখার ক্ষমতা রয়েছে। কিন্তু আপনার বাড়ির চার দেওয়ালে চায়ের টেবিলে আপনাকে দেখার ক্ষমতা হয়তো কারোর নেই।

সম্পর্কিত পোস্ট