আজও কোচবিহারে ঐতিহ্য বহন করে চলেছে বড় দেবীর পুজো
দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ গোটা আশ্বিন মাস মল মাস হওয়ায় প্রায় একমাস পিছিয়ে শনিবার প্রতিপদ তিথিতে কোচবিহারের ঐতিহ্যবাহী বড় দেবী বাড়িতে প্রতিষ্ঠা হলো বড়দেবীর পুজোর ঘট। আগামী ষষ্ঠী তিথি পর্যন্ত নিয়মিত চলবে এই ঘট পুজো।
রবিবার পূর্ণ সাজে সজ্জিত হবেন বড় দেবী, পড়বেন অলংকার। এরপর রয়েছে বিশেষ পুজো। যা “গাও দর্শন” নামে পরিচিত। প্রথম বড় দেবী দর্শন করবেন দুয়ার বক্সী অজয় দে বক্সি।
শনিবার বিশেষ পুজোর মাধ্যমে ঘট প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর একথা জানালেন কোচবিহারের রাজপুরোহিত হীরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য।
কোচবিহারের লোকগাথা অনুসারে কোচবিহার রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা মহারাজা বিশ্বসিংহ শৈশবকালে তাঁর তিন ভাই শিষ্যসিংহ, কুমার চন্দন ও কুমার মদন এবং শৈশবের খেলার সাথীদের নিয়ে ১৫১০ খ্রিস্টাব্দে আসামের ‘চিকনা’ নামক গভীর বনে ময়না কাঠের ডালকে দেবী দূর্গা কল্পনা করে বনফুল, ফল দিয়ে পুজো করেছিলেন।
প্রচলিতা আছে খেলার এক সাথীকে রাজকুমার শিষ্য সিংহ পাঠার মতো আটকে রাখেন এবং মহারাজা বিশ্বসিংহ কুশ দিয়ে আঘাত করা মাত্রই দেবীর অলৌকিক ক্ষমতায় সেই বন্ধুর মাথা ধর থেকে আলাদা হয়ে যায়।
মহারাজা বিশ্বসিংহ সেই বন্ধুর ধরহীন মাথা দেবীর নামে নিবেদন করেন। কথিত আছে যে, সেই সময় দেবী দুর্গার আশীর্বাদেই নাকি মহারাজা বিশ্বসিংহ ‘চিকনা’-র অধিপতি তুরকা কোতোয়ালকে পরাজিত ও নিহত করে কোচবিহারের সিংহাসনে আসীন হন। দেবী দুর্গা সেই সময় নিজের হাতের কঙ্কন ও তীক্ষ্ণ খড়গ উপহার দেন তাকে।
এখানে ময়না গাছের ডালকে দেবী দুর্গা কল্পনা করে পুজো হয়েছিল বলে আজও ময়না গাছের ডাল রাধা অষ্টমীর পুন্যতিথিতে পুজো করে দেবীপ্রতিমার শক্তিগোজ করা হয়। মহারাজা বিশ্বসিংহের পুত্র কোচবিহারের দ্বিতীয় মহারাজা নরনারায়ণ স্বপ্নাদেশে স্ববংশে দশভুজা দূর্গা মূর্তির পূজার প্রচলন করেন।
কোচবিহারের ইতিহাস মতে, মহারাজা নরনারায়ণের ভাই সেনাপতি চিলা রায় নিজের বীরত্বে গর্বিত হয়েছিলেন। তাঁর মনে কোচবিহারের সিংহাসনে বসবার লোভ জন্ম নেয়। একদিন তিনি দাদা নরনারায়ণকে হত্যা করবার জন্য রাজসভায় গিয়েছিলেন।
কিন্তু, সেখানে উপস্থিত হয়ে দেখতে তিনি দেখতে পান, স্বয়ং ভগবতী দূর্গা দশ হাত দিয়ে ঘিরে রাজা নরনারায়ণকে রক্ষা করছেন। চিলা রায় এই অলৌকিক দৃশ্য দেখে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে লজ্জায় দাদার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। কিন্তু, এই ঘটনায় নরনারায়ণ নিজেকে ভাগ্যহীন মনে করেন এবং চিলা রায়কে ভাগ্যবান মনে করলেন।
নিজের ভাগ্যে দেবী দর্শন না ঘটায় মনের দুঃখে অন্ন জল ত্যাগ করে নির্জনবাস করতে আরম্ভ করেন তিনি। জনশ্রুতি আছে যে ৩ দিন পর গভীর রাতে দেবী দুর্গা তাঁকে স্বপ্নে দর্শন দিয়ে বলেন, ‘বৎস ওঠ, জগৎ সংসার আমার যে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে পূজা করে তা প্রত্যক্ষ কর। শরৎকালে তুমি এই মূর্তি নির্মাণ করে যথাবিধি পূজা করবে।’
মহারাজা নরনারায়ণ চোখ খুলে ভগবতীকে দর্শন করে প্রনাম ও স্তুতি করে করে বলেন, ‘মা, মহিষাসুরের ডান হাত সিংহ দন্তাঘাত করে আছে, কিন্তু তাঁর বাম হাত শূন্য রয়েছে।’ দেবী দুর্গা তখন বললেন-‘ঐ স্থানে একটি বাঘ দিও।’ রাজা নরনারায়ণ দেবীর অতসী কুসুমাকার বর্ণ দেখে মনে করলেন ভগবতী দেবী দুর্গার লাল রং হলে ভালো হয়।
মহারাজা নরনারায়ণ সেই স্বপ্নে দেখা মূর্তি স্থাপণ করে শারদীয়া দূর্গাপুজোর প্রচলন করলেন। কোচবিহার রাজবাড়ীর বড়দেবী দুর্গার চেহারা বেশ ভীতি উদ্রেককারী। তাঁর গায়ের রঙ লাল, তাঁর দ্বারা দলিত অসুরের গায়ের রঙ সবুজ। দেবীর বাহন সিংহ অসুরের পায়ে কামড়ে ধরে রয়েছে। আর অসুরের হাতে কামড় বসিয়েছে একটি বাঘ।
দেবীর দু’পাশে অবস্থান করছেন, দেবীর দুই সখি— জয়া-বিজয়া। বলাই বাহুল্য এই মূর্তি মহারাজা নর নারায়ণের স্বপ্নে দেখা দেবী দুর্গার রক্তবর্ণ রূপের প্রকাশ। কাল প্রবাহিত হয়ে চলেছে। সেদিনের রাজতন্ত্র থেকে কোচবিহার কয়েক যোজন দূরে। কিন্তু আজ ও বন্ধ হয়নি বড়দেবী দূর্গা পুজো।
আজও কোচবিহার শহরের প্রাচীন গুঞ্জবাড়ির ডাঙারাই মন্দিরে শ্রাবণ মাসের শুক্লাঅষ্টমী তিথিতে ময়না গাছের ডাল কেটে এনে যুপছেদ পুজো হয় দেবী দুর্গার। এবং দেবীপক্ষে দুর্গোৎসবের সময়েই হয় দেবীর পূজা।
এই পুজো আজও কোচবিহারে রাজবংশের নিজস্ব পুজো। এখন দেবোত্তর ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানেই এই পুজো হয়। মহালয়ার পরদিন থেকেই শুরু হয়ে যায় বড়দেবী দূর্গা পুজো। মহাষষ্ঠীর দিন থেকে পুজো হয় পুরোমাত্রায়।
কথিত রয়েছে, একদা এই মন্দিরে নিয়মিত নরবলি হত। মহারাজা নরনারায়ণের আমলে এই নরবলি চালু হয়। পরবর্তীকালে নর বলির বীভৎসতা দেখে কোচবিহারের ১৯ তম কোচ মহারাজা নরেন্দ্রনারায়ণ ভূপ বাহাদুর দ্বার পন্ডিতদের সঙ্গে আলোচনা করে নরবলি বন্ধ করে দেন।
http://sh103.global.temp.domains/~lyricsin/thequiry/humanitarian-police-with-the-help-of-deputy-superintendent-of-police-chandan-das-55-unemployed-youths-built-a-secure-future/
কিন্তু এমনটা মনে করা হয় যে, কোচবিহার রাজবংশের বড়দেবী দূর্গা নররক্ত না পেলে কুপিত হন। তাই প্রতি বছর মহাঅষ্টমীর রাতে এখানে এক বিশেষ ধরনের বলির ব্যবস্থা করা হয়। মহাষ্টমী ও মহানবমীর সন্ধিলগ্নে বড়দেবীর মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় ‘গুপ্তপূজা’। বাইরের লোকের প্রবেশ তখন নিষিদ্ধ।
পুরোহিত এবং রাজবংশের প্রতিনিধিরাই মূলত থাকেন এই উপাচারের সময়ে। এখানে কামসানাইট উপাধিধারী প্রতিনিধি তাঁর আঙুল কেটে কয়েক ফোঁটা রক্ত দেন দেবীর পদতলে। বলি দেওয়া হয় চালের গুঁড়ো দিয়ে তৈরী মানুষরূপী একটি পুতুলকে।
এই সময় প্রবল ছন্দে বাজতে শুরু করে ঢাক। বর্তমানের মুখোমুখি এসে দাঁড়ায় লোকগাথা সমৃদ্ধ ঐতিহ্যময় অতীত। আজও এই ঐতিহ্য বহন করে চলেছে কোচবিহার।