অতীত থেকে শিক্ষা নেননি, বোঝেননি মমতার লড়াই, আর সেটাই কাল হল পিকের
দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ কংগ্রেসের প্রণব মুখার্জি, কমলনাথ বা বিজেপির প্রমোদ মহাজনরা গত শতকের শেষ থেকে চলতি শতকের প্রথম দশক পর্যন্ত ভোট ম্যানেজার বলেই পরিচিত ছিলেন ভারতীয় রাজনীতিতে। তাঁরা শুধু সংসদে বা বিধানসভায় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে সংখ্যার খেলায় পারদর্শী ছিলেন তাই নয়, বিভিন্ন রাজ্যে নিজ নিজ দলের রাজনৈতিক রণকৌশল রচনাতেও দক্ষতার ছাপ রাখেন।
আবার তৎকালীন বাংলায় সিপিএমের অনিল বিশ্বাস ভোটের রণকৌশল রচনা করতে গিয়ে এই রকমই ভূমিকা রেখেছিলেন। কিন্তু নরেন্দ্র মোদির হাত ধরে ভারতীয় রাজনীতিতে ইলেকশন স্ট্র্যাটেজিস্ট নামে একটি শব্দের আমদানি হয়।
গুজরাটের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদি ২০১২ সালের বিধানসভা ভোটের প্রচারের যাবতীয় দায়িত্ব তুলে দেন জনৈক প্রশান্ত কিশোরের হাতে। এরপর আসে ২০১৪ এর লোকসভা নির্বাচন। এবারে শুধু ভোটের প্রচারের দায়িত্ব নয়, বরং কাদের প্রার্থী করা হবে, কোন রণকৌশলে দেশব্যাপী লড়াই করবে বিজেপি সবটাই নির্ধারণের দায়িত্ব ছিল পিকে ও তার সংস্থা আইপ্যাকের হাতে।
তারা সারাদেশব্যাপী ধামাকাধার প্রচার কৌশলের মাধ্যমে মোদির গুজরাট দাঙ্গার ভাবমূর্তি মুছে দেয়। তার নতুন এক শক্তিশালী ব্র্যান্ড ইমেজ গড়ে তোলা হয়। মজার ব্যাপার হচ্ছে সবটাই প্রচার কৌশলের দ্বারা মানুষের মনে তৈরি ভ্রান্তি, বাস্তব নয়। আর এগুলো যে বাস্তব নয় তা গত সাত বছরে ভারতবাসী বুঝে গিয়েছে।
তার ফল হাতেনাতে পায় বিজেপি। দীর্ঘ দুই দশক পর একার জোরে কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসে কোনও দল। কিন্তু পিকের সঙ্গে বিজেপির সখ্যতা তখন তুঙ্গে উঠেছিল। বিজেপির সংগঠনে কাকে গুরুত্ব দেওয়া হবে সেটাও পিকের পরামর্শ মেনেই করছিলেন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা। যদিও খুব দ্রুত নাটকীয় পরিবর্তন ঘটে বিজেপি নেতৃত্বের সঙ্গে সম্পর্ক নষ্ট হয়ে যায় এই ভোট কুশলীর।
শোনা যায় মূলত অমিত শাহ’র সঙ্গে বিরোধের কারণেই পিকে বিজেপির হাত ছেড়ে দেন। কেউ কেউ বলেন, গোটা বিজেপিকে নিজের ইচ্ছেমতো চালাতে চেয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর। সেই কারণেই তাঁর সঙ্গে বিরোধ ঘটেছিল বিজেপির তৎকালীন সভাপতি অমিত শাহের।
এরপর প্রশান্ত কিশোর সরাসরি নীতিশ কুমারের দলে যোগ দেন। তিনি জেডি(ইউ)-এর সর্বভারতীয় সহ-সভাপতি পর্যন্ত হন। লালু-নীতিশের জোটকে ২০১৫ সালে বিহারে ক্ষমতায় আনার পেছনে তাঁর বড় অবদান ছিল। ২০১৭ এর পাঞ্জাব বিধানসভার নির্বাচনে কংগ্রেসের হয়ে কাজ করেছিলেন পিকে। এবারেও সফল হন। ফলে এক দশকের অকালি-বিজেপি জোট সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করে পাঞ্জাবের কুর্সীতে ফিরে আসে কংগ্রেস।
বিভাজিত অন্ধপ্রদেশে ওয়াইএসআর কংগ্রেসের হয়েও সফল হন এই ভোট কুশলী। যদিও ২০১৭ এর উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের হয়ে রণকৌশল তৈরি করেও চূড়ান্ত ব্যর্থ হন প্রশান্ত কিশোর। শুধু তাই নয়, কংগ্রেসের বিধায়ক সংখ্যাকে দুই অঙ্কের ঘরেও পৌঁছে দিতে পারেননি। ৪০৩ আসনের উত্তরপ্রদেশে বিধানসভায় মাত্র ৭ টি তে জয়ী হয়েছিল কংগ্রেস।
এদিকে ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে বাংলায় ধাক্কা খাওয়ার পর তৃণমূল নির্বাচনের রণকৌশন তৈরি করতে প্রশান্ত কিশোরের হাত ধরে। তার ফল ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে হাতেনাতে পেয়েছে তারা। ওই একই সময়ে তামিলনাড়ু বিধানসভা নির্বাচনে সে রাজ্যের প্রধান বিরোধীদল ডিএমকে পিকের সংস্থা আইপ্যাকের সাহায্য নিয়েছিল। তারাও চূড়ান্ত সাফল্য পায়। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে তামিলনাড়ুর সরকার গঠন করে।
কিন্তু নীতিশ কুমার, অমিত শাহ, অমরিন্দর সিংয়ের মতো বাংলাতেও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পর্ক বিষিয়ে উঠেছে এই ভোট কুশলীর। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠেছে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট রাজনৈতিক দলকে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য এনে দিলেও কেন পরবর্তীকালে পিকের সঙ্গে সবার সম্পর্ক খারাপ হয়ে যাচ্ছে? এ ক্ষেত্রে সম্প্রতি প্রিয়াঙ্কা গান্ধির বলা একটি উক্তি তুলে ধরলে ব্যাপারটা বোধহয় সহজেই পরিষ্কার হবে।
বাংলার বিধানসভা ভোট মেটার মাসখানেক পর প্রশান্ত কিশোরের নিজেই জানিয়েছিলেন তিনি আর নির্বাচনী রণকৌশন রচনার কাজ করবেন না। এরপর রাহুল গান্ধির সঙ্গে তিনি দেখা করেন। কংগ্রেসের বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায় প্রশান্ত কিশোর এবার সক্রিয় রাজনীতিতে অংশ নেওয়ার জন্য কংগ্রেসে যোগ দিতে পারেন।
কংগ্রেস হাইকমান্ডের সঙ্গে এই নিয়ে তাঁর বেশ কয়েক দফা আলোচনা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কংগ্রেসের বিরুদ্ধে একাধিক বিতর্কিত মন্তব্য করে দেশের প্রধান বিরোধী দলে যোগ দেওয়ার সম্ভাবনা খারিজ করে দেন তিনি।
জামিন পেলেন আশিস মিশ্র, ভোটের মুখে কোন সমীকরণ?
সম্প্রতি উত্তরপ্রদেশ বিধানসভা নির্বাচন নিয়ে এক সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমের সাক্ষাৎকারে প্রিয়াঙ্কা গান্ধি এই বিষয়ে মুখ খোলেন। তিনি জানান সত্যিই কংগ্রেসে যোগ দিতে চেয়েছিলেন প্রশান্ত কিশোর। কিঊ দলীয় সংগঠনের সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার ইচ্ছে ছিল তাঁর। তা মেনে নিতে চায়নি কংগ্রেস হাইকমান্ড। তাই পিকেরও আর কংগ্রেসে যোগ দেওয়া হয়নি।
উল্লেখ্য প্রশান্ত কিশোর কংগ্রেসে যোগ দিলে নির্বাচনী রাজনীতিতে এই গ্র্যান্ড ওল্ড পার্টি যে বেশ কিছুটা লাভবান হতো তা বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু কংগ্রেস নিজেদের দলীয় অনুশাসন ও আদর্শ একজন ব্যক্তির হাতে তুলে দিতে চায়নি। সম্ভবত সেই একই ব্যাপার ঘটেছে তৃণমূলে।
পুরনির্বাচনের প্রার্থী তালিকা নিয়ে যা ঘটল সেটা রাজ্যের সকলেই জানে। এছাড়াও তৃণমূলের সাংগঠনিক আদল-বদলের বিভিন্ন খবর প্রকাশ্যে আসার পর একটা বিষয় পরিষ্কার প্রশান্ত কিশোর তৃণমূলের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন। সেখানে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায় হবেন কেবলমাত্র মুখ। পিছন থেকে সব কলকাঠি নাড়বেন তিনি!
স্বাভাবিকভাবেই এটা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পক্ষে মেনে নেওয়া খুব কঠিন। কারণ আজ তৃণমূল যে জায়গায় এসেছে পৌঁছেছে তার পিছনে মূলত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোটা জীবনের সংগ্রাম জড়িয়ে আছে। এই পরিস্থিতিতে প্রশান্ত কিশোরের মতো কেউ উড়ে এসে জুড়ে বসবে এবং সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করবেন তা মেনে নেওয়া যায় না। তাছাড়া মমতা আজীবন সাধারণ মানুষের জন্যই লড়াই করেছেন।
ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির কথা কখনও ভাবেননি। সেখানে প্রশান্ত কিশোরদের পুরোটাই কর্পোরেট ব্যাপার। এখানে মনের দাম নেই। শুধু লাভ-লোকসানের হিসেব আছে। আর এটাই সম্ভবত সব রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেই ঘটিয়ে বসেন পিকে। সেই কারণেই সাফল্য এনে দেওয়ার পরও প্রত্যেকেই তাঁর সঙ্গে গোল্ডেন হ্যান্ডশেক করতে বাধ্য হন।
এই ভোট স্ট্র্যাটেজিস্টদের বুঝতে হবে তারা কেবলমাত্র সহযোগীর ভূমিকাই পালন করবে। বহু আন্দোলন করে উঠে আসা রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করলে বারবার এইভাবেই প্রত্যাখ্যাত হতে হবে।