জঙ্গি NLFT ও টাইগারের ‘বিষদাঁত’ ভাঙতে ৫৬ ইঞ্চি ছাতি লাগেনি মানিক সরকারের

প্রসেনজিৎ চৌধুরী

বাংলাদেশের দুর্গম খাগড়াছড়ি থেকে বারবার হামলা চালিয়ে আসছে ‘স্বাধীন ত্রিপুরা’ দাবিতে অনড় বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগঠন ন্যাশনাল লিবারেশন ফ্রন্ট অফ ত্রিপুরা (NLFT)। সংগঠনটির মূল ঘাঁটি ত্রিপুরার ধলাই জেলার লাগোয়া বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টোগ্রাম বিভাগের খাগড়াছড়ি জেলা।

দীর্ঘ সময় নীরব থাকার পর বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটি ফের গুলিবর্ষণ শুরু করল। মঙ্গলবার সকালে ভারত-বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক সীমান্তের একেবারে ধার ঘেঁষে বিএসএফ জওয়ানদের সঙ্গে গুলি বিনিময় হয় এনএলএফটি জঙ্গিদের। গুলিতে মারা যান দুই বিএসএফ জওয়ান। সীমান্তরেখার ধার ঘেঁষে দুই জওয়ানের রক্তাক্ত দেহ পড়ে থাকে।

বিএসএফ জানিয়েছে প্রতিদিনের মতো মঙ্গলবার খুব সকালে ধলাই জেলার ছামনু থানার অধীন বিএসএফ-এর ৬৪ নম্বর ব্যাটালিয়নের আরসি নাথ বিওপি তে জওয়ানরা টহল দিচ্ছিলেন। পেট্রোলিং করার সময় জঙ্গি হামলা হয়। বিএসএফ জওয়ানরা গুলি চালান। গুলি বিনিময়ের সময় দুই বিএসএফ জওয়ান এসআই ভুরু সিং এবং কনস্টেবল রাজ কুমার গুলিবিদ্ধ ঘটনাস্থলেই মারা যান।

ত্রিপুরার সঙ্গে বাংলাদেশের এই সীমান্ত এলাকায় এনএলএফটি সক্রিয় হয়েছে ফের। বিশেষ করে ২০১৮ সালে পূর্বতন বামফ্রন্ট সরকারের পতনের পরেই ত্রিপুরায় বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলির সক্রিয়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

ফের সক্রিয় ত্রিপুরার জঙ্গিরা, বাংলাদেশ সীমান্তে গুলিতে মৃত ২ জওয়ান

সূত্রের খবর, আগের মতো ততটা শক্তিশালী নয় এই রাজ্যের অপর বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী অল ত্রিপুরা টাইগার ফোর্স (ATTF)। তাদের প্রতিপক্ষ এনএলএফটি ফের সক্রিয়। উপজাতি বিচ্ছিন্নতাবাদের রক্তাক্ত নব্বই দশকে ‘স্বাধীন ত্রিপুরা’ স্বপ্ন দেখা দুই গোষ্ঠীর মধ্যে পারস্পরিক সংঘর্ষ বহু মৃত্যু হয়েছে। আবার দুই গোষ্ঠীর পৃথক হামলায় রক্তাক্ত হয়েছিল জনজীবন।

সীমান্তের ওপারে বাংলাদেশের খাগড়াছড়ির বিশাল অরণ্যাঞ্চলের গোপন বাংকার, ঘাঁটি তৈরি করেই এনএলএফটি হামলা চলাত বারবার। তবে ত্রিপুরায় দ্বিতীয়বার বামফ্রন্ট সরকার প্রতিষ্ঠিত হলে মুখ্যমন্ত্রী দশরথ দেবের বিপুল উপজাতি জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্নতাবাদী আবেগে পলি ফেলতে থাকে। দশরথ দেবের পর মানিক সরকার মুখ্যমন্ত্রী হন। এই দীর্ঘ ২৫ বছরে সিপিআইএম রাজ্য পরিচালনা করে। বাম আমলে একেবারেই নিশ্চিহ্ন শক্তিতে পরিণত হয় উপজাতি বিচ্ছিন্নতাবাদীরা।

জঙ্গি বিচ্ছিন্নতাবাদ দমনে মানিকবাবুর ৫৬ ইঞ্চি ছাতি ছিলনা। তবে সিপিআইএমের সাংগঠনিক শক্তি ও কড়া প্রশাসনের কারণে ত্রিপুরায় মানিক সরকার উপজাতি সন্ত্রাসবাদকে দমিয়ে দিয়েছিলেন।
এই বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তির তৎপরতা দেখা দিতে শুরু করে গত বিধানসভা ভোটে সরকার পরিবর্তনের পরে। ক্ষমতায় আসে বিজেপি ও আইপিএফটি জোট সরকার।

বর্তমান বিজেপি জোট সরকারের শরিক দল আইপিএফটি পৃথক স্বশাসিত এলাকার দাবিতে সরব। তাদের আবেগ ও দীর্ঘ বাম জমানার পরিবর্তনমুখী ফ্যাক্টরের ধাক্কা আর নরেন্দ্র মোদীর প্রতি ঝড়ো ভোট হাওয়ায় রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার থেকে সরে যায়।

বিধানসভা ভোট পরবর্তী সময়ে দেখা গিয়েছে উপজাতি এলাকায় সিপিআইএম তার অস্তিত্ব হারিয়েছে। সদ্য সমাপ্ত উপজাতি স্বশাসিত পরিষদ (ADC) ভোটে সিপিআইএম একেবারে শূন্য। তবে বিজেপি ও আইপিএফটির সুবিধা হয়নি। বরং এডিসি দখল করেছে তিপ্রা মথা। সংগঠনটির সুপ্রিমো ত্রিপুরা রাজপরিবারের সদস্য প্রদ্যোত কিশোর দেববর্মা।

ত্রিপুরায় ফের বিধানসভা ভোটের ঢাক বাজতে শুরু করেছে। শাসক বিজেপি, বিরোধী সিপিআইএমের লড়াইয়ের মাঝে এবার সামিল পশ্চিমবঙ্গে সরকার চালানো তৃণমূল কংগ্রেস। আর আছে কংগ্রেস। মূল স্রোতের রাজনৈতিক দলগুলির পাশাপাশি উপজাতি সংগঠনগুলির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ভোট যত এগিয়ে আসছে ততই উপজাতি পার্বত্য এলাকা সহ বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকা নতুন করে উত্তপ্ত হতে চলেছে।

১৯৮৯ সালে জন্ম নেওয়া এনএলএফটি সংগঠনটি সম্প্রতি সক্রিয় হয়। তাদের বেশকিছু সদস্য ধরা পড়ে। উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিচ্ছিনতাবাদী সংগঠনগুলি নিয়ে পর্যালোচনা করা বিশেষজ্ঞরা জানিয়েছেন, এনএলএফটি সদস্যদের বেশিরভাগ খ্রিষ্টান মতালম্বী।

সূত্রের খবর, বছর কয়েক আগে বাংলাদেশের খাগড়াছড়িতেই গোপন অধিবেশনে এনএলএফটি তার সাংগঠনিক নেতৃত্বের বদল ঘটায়। পুরাতন বিচ্ছিন্নতাবাদী নেতারা বয়স্ক। তাদের জায়গায় নতুন নেতা তৈরিতে জোর দেওয়া হয়েছে। তবে মানিক সরকার উপজাতি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনগুলির বিষদাঁত ভেঙেছিলেন। তাঁর সেই ভূমিকার কথা স্মরণ করেন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক ও গোয়েন্দা বিভাগের কর্মকর্তারা।

এনএলএফটি বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনটি বাংলাদেশ সীমান্তের কাছে সক্রিয় এমনটা বারবার সতর্ক করেছেন প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী ও বিরোধী নেতা মানিক সরকার। গত বিধানসভা ভোটের আগে তিনি মুখ্যমন্ত্রী থাকার সময় দক্ষিণ ভারতের একটি সংবাদপত্রে সাক্ষাতকার দিতে গিয়ে বলেছিলেন, বাংলাদেশ সীমান্তে সে দেশের জমিতে জঙ্গি শিবিরের কথা। এই সাক্ষাৎকারে দেশ জুড়ে আলোড়ন ফেলে দেয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক উদ্বিগ্ন হয়। পরে বাংলাদেশ সরকার জানায়, তাদের জমি থেকে কোনওরকম ভারত বিরোধী জঙ্গি তৎপরতা বরদাস্ত করা হবে না।

সম্পর্কিত পোস্ট