শিল্পাঞ্চলের চাবিকাঠি কার হাতে, চতুর্থ দফায় নির্ধারিত লড়াইয়ে এগিয়ে কারা?

।। শুভজিৎ চক্রবর্তী ।।

শনিবার ৫ জেলার ৪৪ টি কেন্দ্রে চতুর্থ দফার নির্বাচন। চতুর্থ দফার নির্বাচনে উল্লেখযোগ্য নজর রয়েছে হাওড়া জেলার দিকে। এই জেলার ১৬ টি জেলার মধ্যে ৯ টি কেন্দ্রে রয়েছে নির্বাচন।

তৃতীয় দফার নির্বাচনে জেলার একাধিক কেন্দ্রে হিংসার খবর সামনে এসেছিল। উঠে আসে ভোট পরবর্তী হিংসার ছবি। তাই বিশেষভাবে নজর রয়েছে এই জেলার বাকি ৯ টি আসনে ওপর।

কারণ, একসময় তৃণমূলের জন্মভিটে বলা হত এই জেলাকেই। কিন্তু তৃণমূল নেতাদের জনসংযোগের বিচ্ছিন্ন মনোভাব বিজেপিকে জায়গা করে দেয়। সেইসঙ্গে জেলার প্রাক্তন মন্ত্রী তথা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের দলবদলের পর তাতেই আরও বেশী করে হাওয়া লাগে।

গতবারের নির্বাচনে তৃণমূলের টিকিটে ১ লক্ষের বেশী ভোটে জেতা  রাজীবের চ্যালেঞ্জ এবারে প্রতীক বদলে গেলেও ওই কেন্দ্র থেকেই বিপুল ভোটে জয়লাভ করবেন তিনি। রাজীবের ছোঁড়া চ্যালেঞ্জ তৃণমূলের জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই প্রচারে এসে একাধিক দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরব হচ্ছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। কিন্তু খানিকটা খোশ মেজাজে সমস্ত বিষয়কে এড়িয়ে গিয়েছেন রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়। তাই মূল লক্ষ প্রতিপক্ষ তৃণমূল এবং সংযুক্ত মোর্চাকে নির্বাচনে পরাজিত করা।

এরই মধ্যে প্রচারে এসে রাজীবের সহযোদ্ধা দাবী করেন প্রতিপক্ষ তৃণমূল প্রার্থী কল্যাণ ঘোষ বিজেপিতে যাওয়ার জন্য তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলেন। যদিও বদলে যাওয়া রাজনৈতিক আবহাওয়াতে এটা নতুন কিছু নয়।

রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়ের পাশাপাশি দলবদলের হাওয়ায় গা ভাসিয়েছেন বৈশালী ডালমিয়া। ২০১৬ সালে তৃণমূলের টিকিটে জয়ী বৈশালী এবারে বালি কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী। তাঁর দুই প্রতিপক্ষ তৃণমূলের রানা চট্টোপাধ্যায় এবং সিপি(আই)এমের সতেজ নেত্রী দীপ্সিতা ধর।

গত কয়েক বছরে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে বিদায়ী বিধায়কের বিরুদ্ধে। স্থানীয় বাসিন্দাকে প্রার্থীর দাবী তুলে আগে থেকেই সরব হয়েছিলেন স্থানীয় তৃণমূলের নেতারা। আর এখন বৈশালীর দলবদলে আখেরে লাভ হয়েছে ঘাসফুল শিবিরের। অন্যদিকে নিজেকে ঘরের মেয়ে বলে দাবী করে প্রচারে ঝড় তুলেছেন দীপ্সিতা। বহু মানুষের সমর্থন পেয়েছেন তিনি।

ছাত্র রাজনীতি থেকে সংসদীয় রাজনীতিতে দীপ্সিতার ডেবিউ হলেও, প্রতিপক্ষরা তাঁকে কিছুতেই এড়িয়ে যেতে চাইছেন না। কারণ, দিল্লি থেকে কলকাতা আন্দোলনের প্রথম সারীর মুখ হিসাবে দেখা গিয়েছে তাঁকেই।

তবে হাওড়ায় বামেদের দুর্গ ভেঙে দীর্ঘ সময় ধরে তৃণমূলের পিলার যিনি ধরে রেখেছেন সেই অরূপ রায়কে এবারেও তাঁর পুরাতন কেন্দ্র হাওড়া মধ্য থেকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। তবে এবার তাঁর জন্য লড়াই সহজ নয়। কারণ সেখানে গত লোকসভা নির্বাচন থেকেই এই কেন্দ্রে পদ্মের চাষ বেড়েছে। আর এবারের প্রার্থী এলাকার পরিচিত মুখ সঞ্জয় সিং। অনেকেই বলছেন এবারে হাওড়া মধ্য কেন্দ্রে বাজী হতে পারেন সাইলেন্ট ভোটাররা।

সাইলেন্ট ভোটারদের কথা মাথায় রেখেই এই কেন্দ্রে পলাশ ভাণ্ডারীকে প্রার্থী করেছে কংগ্রেস। স্থানীয়দের দাবী, এবারের নির্বাচনে তাঁর পুরাতন কেন্দ্রে ধাক্কা খেতে পারেন অরূপ রায়। আর জিতলেও টাফ ফাইট দিতে হতে পারে এই কেন্দ্রে।

পছন্দমতো কেন্দ্র না পেয়ে অখুশি ছিলেন হাওড়া দক্ষিণের বিজেপি প্রার্থী রন্তীদেব সেনগুপ্ত। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব মানভঞ্জন করলে প্রচারে নামেন প্রাক্তন সাংবাদিক। কিন্তু আগে থেকেই এই কেন্দ্রে  বর্ষীয়ান বিধায়ক অম্বিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে নন্দীতা চৌধুরীকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। তাঁর মূল লড়াই বিজেপির সঙ্গে হলেও প্রতিপক্ষ সুমিত্র অধিকারীকে পিছনে রাখছেন না নন্দীতা চৌধুরী।

বিধায়ক এবং দলীয় পদ থেকে লক্ষীরতন শুক্লার ইস্তফার পর ২১ এর নির্বাচনে হাওড়া উত্তর কেন্দ্রে যাদের নাম উঠে আসছিল তাঁদেরকে সরিয়ে গৌতম চৌধুরীকে প্রার্থী করেছে তৃণমূল। প্রতিপক্ষ উমেশ রাই। রাজনৈতিক মহলের মতে, এই কেন্দ্রে বাঙালী ভোটের পাশাপাশি অবাঙালী ভোটকে হাতিয়ার করবে বিজেপি। তাই গঙ্গাপাড়ের এই কেন্দ্রেও লড়াই দ্বিমুখী।

চতুর্থ দফার নির্বাচনে তারকাদের মধ্যে অন্যতম প্রাক্তন ক্রিকেটার মনোজ তিওয়ারি। এবারের শিবপুর কেন্দ্রে তৃণমূলের বাজি তিনিই। তাঁকে দিয়েই ছয় হাঁকাতে চাইছেন তৃণমূল সুপ্রিমো। অন্যদিকে এই কেন্দ্রের দ্বিমুখী লড়াইয়ে প্রতিপক্ষ সদ্য বিজেপিতে যোগদানকারী ডঃ রথীন চক্রবর্তী।

তবে বিশেষ নজর সাঁকরাইল কেন্দ্রের দিকে। এই কেন্দ্রে তৃণমূলের নতুন মুখ পিয়া পাল। বয়সের ভারে শীতল সর্দারকে সরিয়ে নতুন মুখ আনায় গোঁসা হয় বিদায়ী বিধায়কের। কিন্তু বিজেপিতে যোগ দিয়েও টিকিট পেলেন না শীতলবাবু। তাঁর পরিবর্তে স্থানীয় নেতা প্রভাকর পণ্ডিতকে প্রার্থী করেছে বিজেপি। এই কেন্দ্রে সিপি(আই)এমের প্রার্থী সমীর মালিক। স্থানীয়দের দাবী, বিজেপি এবং তৃণমূলের লড়াইয়ে ফায়দা তুলতে পারে সংযুক্ত মোর্চা।

হাওড়ার শিল্পাঞ্চলের আরও একটি কেন্দ্র পাঁচলা। পুর্বের ইতিহাস এবং ঘটনাক্রমকে সামনে রাখলে এবারের নির্বাচনে জয় সহজ হবে না তৃণমূল প্রার্থী গুলশান মল্লিকের জন্য। সম্প্রতি আমফানের সরকারী অনুদান নিয়ে ব্যাপক জলঘোলা হয়েছে এই বিধানসভার একাধিক পঞ্চায়েতে। বিজেপির পরিসর বৃদ্ধি এবং আইএসএফের প্রার্থী প্রদানে ঢোঁক গিলছেন তৃণমূল নেতারা। যদিও পুরাতন দুর্গে চেনা ফর্মেই ফিরবেন বলে আশাবাদী বর্ষীয়ান বিধায়ক এবং তৃণমূল সুপ্রিমো ঘনিষ্ট গুলশান মল্লিক।

গঙ্গাপাড়ের হাওয়ায় মোদি লেহের দেখা গেলেও বদলাবে না উলুবেড়িয়া পূর্ব। এমনটা আশাবাদী ছিলেন তৃণমূলের নেতারা। কিন্তু প্রাক্তন তারকা ফুটবলার বিদেশ বোসকে প্রার্থী করার পরেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন তৃণমূলের একাংশ। অন্যদিকে এই কেন্দ্রে বিজেপির প্রার্থী হাওড়া গ্রামীণ বিজেপির সভাপতি প্রত্যুষ মন্ডল। একুশের নির্বাচনে আর পাঁচটা বিজেপি নেতার মতো তিনিও আশাবাদী ভোটে জয় তাঁরই হবে। একইসঙ্গে ক্ষমতায় তাঁরাই আসবেন।

সব মিলিয়ে গঙ্গাপাড়ের হাওয়ায় হাওড়ার শিল্পাঞ্চলের ভবিষ্যৎ কার হাতে যাবে তাঁর নির্ধারিত হবে শনিবারেই। ফলাফল প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গে মিলতে পারে রাজনৈতিক সমীকরণও।

সম্পর্কিত পোস্ট