মোস্ট ওয়ান্টেড থেকে মূলস্রোতে, ছত্রধরের হাত ধরে বৈতরণী পার করার ভাবনা মমতার…
নয়ন রায়
এরাজ্যে তখন বাম শাসন। সূর্য তখন মধ্য গগনে। সূর্যের উত্তাপ কিছুটা পশ্চিমের দিকে হেলেছিল। সেই সময় মসনদে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য।
সিঙ্গুর, নন্দীগ্রামের সময় থেকেই জঙ্গলমহল উত্তপ্ত হতে শুরু করেছিল। একদিকে সুবর্ণরেখা নদী, অন্যদিকে কাঁসাই নদী। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে জঙ্গলমহল।
একদিকে অনুন্নয়ন। অন্যদিকে খিদের যন্ত্রনায় আদিবাসীদের আর্তনাদ। এই দুই বৃত্তের মাঝে তৈরী হয়েছিল বিক্ষোভের বিপ্লব। নাম ছিল জনসাধারণের কমিটি।
বাম সরকারের অত্যাচার ও পুলিশের পাশবিক নির্যাতন। সেখান থেকে যে স্ফুলিঙ্গের জন্ম হয়েছিল তার নাম ছত্রধর মাহাত।
ক্রমাগত মাওবাদীরা জঙ্গলমহলে বিস্তার করতে শুরু করল। কিছুটা মাও শক্তি। অন্যদিকে ছত্রধরের বিকাশ। এই দুইয়ের সংমিশ্রনে জঙ্গলমহলে শুরু হল এক নতুন বিপ্লব।
২০০৬ থেকে ২০১০ । এই সময়ে জঙ্গলমহল ছিল সংবাদের শিরোনামে। সে আন্দোলন শুধু ভারতবর্ষে নয়,সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেসময় মাও দমনের নামে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য কেন্দ্রের কাছে যৌথ বাহিনী চেয়ে পাঠায়।
‘শান্তি’তেই অশান্ত পুরুলিয়া, ২১এ অকাল পদ্মবৃষ্টির আশঙ্কা জেলা জুড়ে…
তখন, ঝাড়গ্রাম, লোধাশুলি, গিধনি , পিরাকাটা , হুমাগড়, গোয়ালতোড়, বান্দোয়ান, বিনপুর, নয়াগ্রাম, সর্বত্রই মাওবাদীদের গুলিতে বহু নিরীহ মানুষের নিথর ছবি সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় স্থান পেত।
সেই আন্দোলনের সলতে পাকিয়েছিলেন কোটেশ্বর রাও (কিষেণ জি)। তাকে সহযোগীতা করেছিলেন আকাশ-বিকাশ-সুচিত্রার মত গেরিলা বাহিনী।
শালবনীতে জিন্দালদের প্রকল্প উদ্বোধন করতে যাওয়ার সময় মাওবাদীরা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছিল।
বিস্তীর্ণ এই জঙ্গলমহলে সিপিএম নেতৃত্বের বাড়িতে প্রাণের হুমকি আসত। সাঁকরাইলের ওসি অতীন্দ্র অপহরণ বা নেতাই গণহত্যা। এসবের পিছনেই মাওবাদীদের হাত ছিল । অন্তত এমন অভিযোগ সেসময় কান পাতলেই শোনা যেত।
তখন পুলিশের খাতায় ছত্রধর মাহাত হয়ে ওঠে মোস্ট ওয়ান্টেড। নামানো হয়েছিল কোবরা বাহিনী। দিল্লি থেকে উড়ে এসেছিলেন তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম। লালগড় থানার মাঠে সেদিন বিএসএফের হেলিকপ্টার থেকে নেমেছিলেন চিদম্বরম।
লালগড় থানায় বসে মাও দমনের ছক কষা হয়েছিল ২০১০ সালে। ততদিনে আদিবাসী, পিছিয়ে পড়া অনুন্নত সম্প্রদায়ের ঘরের মধ্যে সরকারের এই বিরোধীতা ও মাওবাদীদের ফর্মূলা পৌঁছে দিয়েছিল এই ছত্রধর মাহাত। তখন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
সেসময় বিধানসভার অধিবেশন প্রতিদিন মাও ইস্যুতে উত্তপ্ত হত। গণ আন্দোলন করতে এসে পুলিশের রাইফেলের বাঁটে ছিতামনী মুর্মুর চোখ নষ্ট হয়েগেছিল।
সেদিন বিধানসভায় ছিতামনী ইস্যুতে তৎকালীন কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া সরব হয়েছিলেন। শুধু মানস কেন, সিপিএমের অনেক ফ্রন্টলাইনের নেতাও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন দলের অন্দরেই।
দলের ভিতর প্রশ্ন তুললেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য মাও দমনে যৌথ বাহিনীর হয়ে সাফাই গেয়েছিলেন।
একদিকে পুলিশ, অন্যদিক যৌথ বাহিনী। এই দুইয়ের সাঁড়াশী আক্রমনে জঙ্গলমহলে জনহীন পরিস্থিতি তৈরী হয়েছিল। সেসময় আন্দোলনের মুখই ছিল ছত্রধর মাহাত।
তারপর ছত্রধর গা ঢাকা দেয়। ২০১১ সাল। দীর্ঘদিনের বাম শাসনকে উপড়ে ফেলে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জনান্তিকে শোনা যায় জঙ্গলমহলে তৃণমূল যেকটি আসন পেয়েছিল তার কৃতিত্ব অনেকাংশে ছত্রধরের।
২০১১ সালের ২৪ নভেম্বর। তৎকালীন পুলিশ সুপার মনোজ ভার্মার নেতৃত্বে লোধাশুলির জঙ্গলে পুলিশের এনকাউন্টারে কিষেণ জীর মৃত্যু হয়েছিল।
ধীরে ধীরে মাও স্কোয়াডের নেতারা এলাকা ছেড়ে পালিয়ে বাঁচে। কিছু মাও নেতৃত্ব মমতার কাছে আত্মসমর্পণ করে। আর ছত্রধরের কপালে জোটে ইউএপিএ ধারায় হাজতবাস। ছিন্নভিন্ন হয়ে যায় পারিবারিক জীবন।
রাজ্যের সহ সভাপতি রবীন্দ্রনাথ ঘোষ, রাজনৈতিক পুনর্বাসন নাকি বনবাস?
দীর্ঘ কয়েকবছর জেল খাটার পর ছত্রধর ছাড়া পায়। অবশ্য এর আগে বিস্তীর্ণ জঙ্গলমহলে মমতার উদ্যোগে রাস্তাঘাট, বিদ্যুত, মাল্টিসুপার স্পেশালিটি হসপিটাল এই প্রকল্পগুলি পিছিয়ে পড়া জনজাতির কাছে পৌঁছে যায়।
সূর্য এখনো মধ্যগগনে। খানিকটা পুবের দিকে হেলে। জঙ্গলমহলের ভরাডুবির পর, সীমাহীন দুর্নীতি ও দলীয় কোন্দল, সুবর্ণরেখা নদীর বালি ও কাঁসাই নদীর বালি লুঠ -এই সমস্ত তথ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ভাবিয়েছে।
তাই বল্গাহীন দুর্নীতি রুখতে ছত্রধরকে সামনে আনলেন মমতা। অতীতের বিষাদ ও বিষ ভুলে ছত্রধরই হল বর্তমানে মমতার ভরসা।
তিনি এটা বুঝেছেন দলীয় নেতৃত্বকে দিয়ে জঙ্গলমহল পুনরুদ্ধার হবে না। তাই ছত্রধরের মেধা ও লৌহশক্তি মানসিকতা মমতার কাছে এক নির্ভরতার জায়গা তৈরী করেছে।
লোহা গরম থাকতে থাকতেই ছত্রধরকে দিয়ে প্রাথমিক কাজটা মমতা ২১ এর আগেই সেরে ফেলতে চাইছেন।