এগোলেও বিপদ পিছলেও, জিটিএ নির্বাচন গুরুংয়ের কফিনে শেষ পেরেক হতে পারে
দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ তাঁর নির্দেশ ছাড়া গাছের একটা পাতাও নড়ত না! পাহাড়ে এই ছিলেন বিমল গুরুং। দার্জিলিং, কালিম্পং এবং কার্শিয়াং এই তিন বিধানসভা এলাকায় সুভাষ ঘিসিংয়ের একদা অনুগামী বিমল গুরুং হয়ে উঠেছিলেন একচ্ছত্র অধিপতি। এক্ষেত্রে গুরু ঘিসিংয়ের পদাঙ্কই তিনি হুবহু অনুসরণ করেন। শুধু দলটা বদলে গিয়েছিল।
জিএনএলএফের বদলে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা। তবে গুরুং বোধহয় আরও বেশি আক্রমনাত্মক। যদিও সেই সুখের সময় গিয়েছে। আর এক মাস পর পাহাড়ের মানুষ আদৌ বিমল গুরুংকে পুছবে কিনা তা নিয়েই সংশয় আছে!
মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সম্প্রতি পাহাড় সফরে গিয়ে জিটিএ নির্বাচন হবে বলে জানিয়েছিলেন। রাজ্য সরকার ইতিমধ্যে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে পাহাড়ের জিটিএ নির্বাচন ও শিলিগুড়ি মহকুমা পরিষদের বকেয়া ভোট সেরে ফেলার কথা জানিয়েছে। সম্ভবত জুন মাসেই সেই নির্বাচন হয়ে যাবে। আর তাতেই রক্তচাপ বাড়ার জোগাড় গুরুংয়ের।
পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের কনস্টেবল অমিতাভ মালিকের অস্বাভাবিক মৃত্যুর পর বিমল গুরুং-রোশন গিরিরা আত্মগোপন করেন। তাঁদের বিরুদ্ধে খুনের মামলা দায়ের করে পুলিশ। তারপরই পাহাড়ে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চায় ভাঙন ধরে। বিনয় তামাংয়ের নেতৃত্বে গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার একটি গোষ্ঠী সরকারপন্থী হয়ে ওঠে। তারা জিটিএর ক্ষমতা দখল নেয়।
এই সময় মোর্চার অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে জিএনএলএফের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাহাড়ে প্রভাব বাড়ায় বিজেপি। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে বিনয় তামাং তৃণমূলের দিকে থাকলেও গুরুং বিজেপিকে সমর্থন করেছিলেন। ফলে সহজেই জিতে যান গেরুয়া শিবিরের প্রার্থী রাজু বিস্তা।
তখনও পাহাড়ে বিমল গুরুংয়ের দাপটের কাছে কেউ ছিল না। তিনি আত্মগোপন করে থাকলেও পাহাড়বাসীর বড় অংশ তাঁকেই মেনে চলছিলেন। কিন্তু দীর্ঘদিন অনুপস্থিত থাকায় পাহাড়ের রাজনীতিতে গুরুংয়ের রাশ দুর্বল হচ্ছিল। তাছাড়া বিজেপি প্রতিশ্রুতি দিলেও তারা গোর্খাল্যান্ড নিয়ে কিছু করেনি। এই নিয়ে পাহাড়বাসীর ক্ষোভ ছিল।
বুদ্ধ-অনিলের পথ ধরেই মীনাক্ষীকে আরও তুলে ধরার পরিকল্পনা আলিমুদ্দিনের
প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল গোর্খাল্যান্ড যদি পাওয়া যাবে না তবে কেন রাজ্যের সঙ্গে শুধু-শুধু বৈরিতার সম্পর্ক তৈরী করা হবে। এই পর্যায়ে গুরুং বিজেপির দিকে ছিলেন বলে ধীরে ধীরে তাঁর প্রতিও মোহ ভঙ্গ হয় মানুষের।
এই সময় বিনয় তামাংয়ের নেতৃত্বাধীন মোর্চা পাহাড়ে উন্নয়নের কথা বলতে শুরু করে। ফলে পাহাড়ের একটা বড় অংশের মানুষ আর অশান্তি চাইছিল না। এরই মাঝে একুশের বিধানসভা নির্বাচনের আগে আচমকাই গোপন আস্তানা ছেড়ে প্রকাশ্যে আসেন বিমল গুরুংরা।
পুরো ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে রাজ্যের শাসক দল তৃণমূলকে সমর্থন জানান তাঁরা। ফলে পৃথকভাবে হলেও মোর্চার দুটি গোষ্ঠীই তৃণমূলের শরিক দল হয়ে ওঠে।
বিধানসভা নির্বাচনে পাহাড়ে গুরুং ম্যাজিক কাজ করেনি। শাসক শিবিরের একজনই মাত্র প্রার্থী জেতেন, তিনি বিনয় তামাং গোষ্ঠীর। মোটামুটি পরিষ্কার হয়ে যায় বিমল গুরুংয়ের আগের দাপট আর নেই।
বিধানসভা ভোটের পর পর পাহাড়ের রাজনীতিতে অজস্র বাঁক এসেছে। বিনয় তামাং সরাসরি তৃণমূলে যোগ দিয়েছেন, অনীত থাপা পৃথক ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা গঠন করেছেন। আবার জিএনএলএফ ছেড়ে গ্ল্যেনারিজের মালিক অজয় এডোয়ার্ড হামরো পার্টি তৈরি করে সাড়া ফেলে দেন। নতুন দল তৈরীর মাত্র মাসখানেকের মধ্যে পুর নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে দার্জিলিং পুরসভার ক্ষমতা দখল করেছে এই নতুন রাজনৈতিক দল।
দার্জিলিং পুরসভার ভোটেই টের পাওয়া যায় বিমল গুরুং পাহাড়ের রাজনীতিতে মিথে পরিণত হতে চলেছেন। তাঁর আর প্রাসঙ্গিকতা নেই। কারণ যার কথায় একসময় দার্জিলিঙে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত সেই তাঁর দল মাত্র তিনটি ওয়ার্ডে কোনরকমে জয়ী হয়েছে। তাঁর থেকে বেশি আসনে জিতেছে শরিক তৃণমূল কংগ্রেস। আসন সংখ্যার নিরিখে গুরুংয়ের দল দার্জিলিঙে এই মুহূর্তে চতুর্থ স্থানে!
নিজের হাল বুঝে পুরসভা নির্বাচনের পরই বিমল গুরুং পাহাড়ের স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধানের দাবিতে সরব হন। ঘোষণা করেন যতক্ষণ না স্থায়ী রাজনৈতিক সমাধান মিলছে ততদিন জিটিএ নির্বাচন করা যাবে না। আসলে দেওয়াল লিখনটা বিমল গুরুং খুব ভালো পড়তে পেরে গিয়েছেন। বুঝেছেন নির্বাচন হলে মোর্চার জামানত রাখা কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। আবার পাহাড়জুড়ে উন্নয়নের স্লোগান দিয়ে হামরো পার্টি বা ভারতীয় গোর্খা প্রজাতান্ত্রিক মোর্চা যেভাবে অশান্তির রাজনীতি থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিয়েছে তাতে তাদের প্রতি আমজনতার সমর্থনও যথেষ্ট।
এই পরিস্থিতিতে বিমল গুরুং ভোট বয়কটের পথে হাঁটলে তা পাহাড়ের রাজনীতিতে বিশেষ প্রভাব ফেলবে না। কারণ তাঁর পাশে সমর্থক বলেই বিশেষ কেউ নেই। ফলে আগের মত জ্বালাও-পোড়াওয়ের রাজনীতি করাটাও তাঁর পক্ষে কঠিন। আগে পাশে মানুষ ছিল তাই পাহাড়কে অচল করে দিতে পেরেছিলেন। এই অবস্থায় গুরুংয়ের গোর্খা জনমুক্তি মোর্চা জিটিএ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করলেও দিব্যি ভোট হয়ে যাবে। ফলে এগোলোও বিপদ, পিছলেও সাড়ে সর্বনাশের সম্ভাবনা আছে গুরুংয়ের।
তৃণমূল কংগ্রেসের শীর্ষ নেতৃত্ব গুরুংয়ের এই প্যাঁচে পড়ে যাওয়ার বিষয়টি ভালোই বুঝতে পেরেছেন। পাহাড়কে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে রাখতে হলে গুরুংয়ের মত নেতাদের সত্যিই একঘরে করে দেওয়া প্রয়োজন। তাই এই সুযোগকে কোনমতেই হাতছাড়া করতে চাননি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সম্ভবত সব দিক বিচার বিবেচনা করেই জুন মাসে তিনি নির্বাচনের কথা ঘোষণা করেছেন। এই নির্বাচনের পর পাহাড়ের রাজনীতিতে বিমল গুরুংয়ের আর কোনও অস্তিত্বই হয়ত থাকবে না!