বেঁধে বেঁধে থাকার গল্প
বেঁধে বেধে থাকার গল্পগুলি যদি আমাদের সামাজিক পরিসরে আর একটু প্রসারিত ও স্বীকৃত হতে পারতো তাহলে হয়তো আজ এদেশের সাম্প্রদায়িক বিভাজন নিয়ে আমাদের এতটা চিন্তা ও উদ্বেগে কাটাতে হত না।
বর্তমানে গোটা দেশ জুড়ে এক অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজমান। ধর্মকে হাতিয়ার করেই শাসক বনাম বিরোধী ঠান্ডা লড়াই চলছেই। সেই টানাপোড়েনের মাঝেই রাজনীতির ছক ভাঙা গল্প আমরা তুলে ধরব আপনাদের কাছে। লিখছেন বিশিষ্ট সাংবাদিক অনুপম কাঞ্জিলাল। চোখ রাখুন #TheQuiry এর ওয়েবসাইটে। প্রতি মঙ্গলবার রাত ৮ টা।
||অনুপম কাঞ্জিলাল, সাংবাদিক||
গত সংখ্যার লেখায় জানিয়েছিলাম এদেশের ইতিহাসের পাতায় হিন্দু-মুসলমাল দুই সম্প্রদায়ের মানুষের বেঁধে থাকার কত উদাহরণ থেকে গেছে।সেই বেঁধে বেধে থাকার গল্পগুলি যদি আমাদের সামাজিক পরিসরে আর একটু প্রসারিত ও স্বীকৃত হতে পারতো তাহলে হয়তো আজ এদেশের সাম্প্রদায়িক বিভাজন নিয়ে আমাদের এতটা চিন্তা ও উদ্বেগে কাটাতে হত না।
তবে হয়তো আমরা ওরার দেওয়াল এতটা পোক্ত ও দৃঢ হয়ে আমাদের সাংবিধানিক পবিত্রতাকে নষ্ট করতে পারতো না।শুধু ইতিহাসের পাতা নয় এরকম বেঁধে বেঁধে থাকার গল্প ছড়িয়ে রয়েছে আমাদের রোজকার জীবন যাপনের চৌহদ্দির মধ্যেও।একটু হাত ছড়িয়ে দিলেই তার নাগাল পাওয়া সম্ভব।
খুব বেশীদিন নয়, মা্ত্র দুবছর পেছিয়ে গেলেই আমরা আমাদেরই এই রাজ্যে এরকম এক বাঁধনের গল্পের নাগাল পেয়ে যেতে পারি।
সময়টা ২০১৮ সালের এপ্রিল মাসের প্রথমদিক।সেসময় আসানসোলের নুরানি মসজিদের ইমাম মৌলানা ইমদাদুল্লাহ রসিদির ১৫-১৬ বছরের পুত্র সবিল্লাহ রসিদিকে নৃশংসভাবে খুন করে একদল হিন্দু ধর্মোন্মাদ।
ফুটফুটে কিশোর সাবিল্লাহের কলজে ছিড়ে তার দেহ টুকরো টুকর করতেও দ্বিধা হয় নি একদল ধর্মীয় বিকারগ্রস্তের।এই ভায়াবহ খুনের খবর ছড়িয়ে পড়তেই সেদিন নুরানি মসজিদ সংলগ্ন ফাঁকা প্রান্তরে জড় হতে থাকেন হাজার হাজার মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষজন।তাদের চোখে মুখে ঘৃণা আর হাতে সকলেরই ধারাল ্অস্ত্র ।
সেদিন বিকেলের পড়ন্ত আলোয় আসানসোলোর নুরানি মসজিদ সংলগ্ন প্রান্তরটি যেন ক্রমেই বদলে যাচ্ছিল ঐতিহাসিক সেই বিয়োগান্তক কারবালা প্রান্তরের প্রতিচ্ছবিতে।আর সেখান থেকেই ক্রমে ঘনীভূত হতে থাকে এক অন্য সর্বনাশের আশঙ্কা,শোকস্তব্ধ হাজার হাজার মুসলিম যুবকের বুকের মধ্যে তখন দ্রিম-দ্রিম শব্দে বেজে উঠতে শুরু করেছে প্রতিশোধ স্পৃহার দামামা।তারা চাইছিলেন তাদের প্রিয় ইমাম একবার বলুন তাঁর সন্তানকে যারা খুন করেছে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে ঝাঁপিয়ে পড়ুক সব মুসলিম যুবক যুবতী।
শোক মিছিলের এই নিরুচ্চার দাবি বুঝতে সেদিন ভুল হয় নি আসানসোলের নুরানি মসজিদের ইমাম মৌলানা ইমদাদুল্লাহ রসিদির।সেদিন ছিল চৈত্র মাস আর নুরানি মসজিদের ইমাম সাহেব তাঁর ধর্মীয় স্বগোত্রীয়দের চোখে দেখেছিলেন সভ্যতা-কৃষ্টি মুষ্যত্বের সর্বনাশ।
সেই মুহূর্তে তাই পৃথিবীর সবচেয়ে ভারি বোঝা সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়েই ইমাম সাহেব এগিয়ে এসেছিলেন সেই সর্বনাশ রুখে দিতে।তাঁর সমস্ত মুসলিম ভাই ও বোনদের উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন,তাঁর সন্তানকে আল্লাহ যতদিন বেচে থাকার নিদান দিয়েছিলেন,সে ততদিন বেঁচে ছিল।
তাঁর সন্তানকে যারা হত্যা করেছে তাদের শাল্তি দেবার হলে আল্লাহ দেবেন।মানুষে মানুষে কোন হানাহানি তিনি অনুমোদন করবেন না।কোন মুসলিম যদি কোন হিংসার সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন তবে তিনি বুঝবেন তিনি ইসলাম ধর্মের মর্ম কথা মুসলিম সম্প্রদায়কে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছেন,তার সন্তানের হত্যার বদলা নিতে যদি কেউ হিন্দু সন্তানকে হত্যার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নেন তবে তিনি ইমাম হিসেবে আর কোনদিন মসজিদে ঢুকবেন না।এলাকা ছেড়ে চিরদিনের মত চলে যাবেন নির্বাসনে।তিনি জানিয়ে দেন তিনি সন্তান হারানোর যে যন্ত্রণা বুকে ধারণ করছেন,সেই যন্ত্রণা কোন ভাবেই হিন্দু কোন পিতার বুক থেকে তার সন্তান কেড়ে নিয়ে লাঘব হতে পারে না।
মানুষে মানুষে হানাহানি ও খুন কোন ধর্মই বরদাল্ত করে না বলে নিদান দেন তিনি।ইমামের এই নিদানের পর সমবেত সকলের মধ্যে উত্তেজনা থিতিয়ে আসে,শান্ত আবহে সকলে একে একে বাড়ি ফিরে যান।এভাবেই এক ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে প্রতিহত করার মুখ্য চরিত্র হয়ে উঠেছিলেন আসানসোলের নুরানি মসজিদের ইমাম মৌলানা ইমদাদুল্লাহ রসিদি।
একই বার্তাই তো দিয়েছিলেন দিল্লিবাসী অঙ্কিক সাক্সেনার বাবাও।২০১৮ সালেরই ঘটনা,দিল্লিবাসী যুবক অঙ্কিত সাক্সেনা প্রেমে পড়েন এক মুসলিম পরিবারের মেয়ের।অঙ্কিত দিল্লির একটি প্রযুক্তি সংস্থায় কর্মরত ছিলেন।আচমকা একদিন অঙ্কিত খুন হয়ে যান।অভিযোগ ওঠে অঙ্কিতের সঙ্গে মেয়ের মেলামেশা পছন্দ করতে না পেরে মুসলিম পরিবার অঙ্কিতকে খুন করে।
দিল্লির হিন্দু আগ্রাসীপনা এই খুনের ঘটনাকে ব্যবহার করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে কিন্তু ধর্ম ব্যবসায়ীদের সমস্ত অভিসন্ধী ভেস্তে দিয়ে অঙ্কিত সাক্সেনার বাবা জানিয়ে দেন তার পুত্রকে যারা খুন করেছে তারা খুনি-দুষ্কৃতী,তাদের ধর্ম পরিচয় নিয়ে তার কোন আগ্রহ নেই।
হিন্দু খুনের জন্য নয় মানুষ খুনের জন্য খুনিদের শাস্তি দাবি করেন অঙ্কিত সাক্সেনার বাবা।এভাবেই সাম্প্রদায়িকতার আগ্রাসীপনাকে চুপসে দেন অঙ্কিত সাক্সেনার বাবা।
গতবছরই উত্তরপ্রদেশে সিএএ নিয়ে এক বিক্ষোভ সমাবেশ সামাল দিতে গিয়ে বিক্ষোভকারীদের হাতে খুন হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় পুলিশ কর্মী অজয়কুমারের কিন্তু সেখানে তার প্রাণ রক্ষা করতে এগিয়ে আসেন এক মুসলিম বৃদ্ধ হাজি কাদির।
কোনক্রমে হাজি কাদির অজয়কুমারকে প্রাণে বাঁচিয়ে ঘরে ফিরিয়ে দেন।বাড়িতে ফেরার পর আহত অজয়কুমারকে একদিন দেখতে আসেন হাজি কাদির,সেদিন হিন্দু অজয়কুমার মুসলিম হাজি কাদিরের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে জানিয়ে দেন হাজি কাদিরই তার প্রাণদাতা।
সাম্প্রতিক দিল্লির দাঙ্গায় এ রাজ্য থেকে যাওয়া এক মুসলিম ভাড়াটে মনিরুল ইসলামকে প্রাণ বাজি রেখে পাহাড়া দিয়েছেন হিন্দু বাড়িওয়ালা রাম শর্মা।
এই সমস্ত ঘটনাগুলো খবরের চ্যানেল ও কাগজে প্রকাশ পেয়েছে।ঘটনাগুলো কোনটাই বানানো নয় সবগুলোই সত্যি শুধু এই সত্যিগুলো সমাজের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ুক আর স্বীকৃত ও আলোচিত হোক,প্রত্যাশা করা যায় তাহলেই আমরা ওরার দেওয়াল আর দূর্বল হবে,একসময় হয়তো বা ভেঙেও পড়বে।
আমি অন্তত বিশ্বাস করি ইতিবাচক সংবাদের প্রসার ও বিস্তার ঘটাবার প্রয়াসটাও সাংবাদিকতার দায়বদ্ধতার মধ্যেই পড়ে।