‘বোড়ে’ সিঙ্গুর, রাজনৈতিক পালাবদলে এবার বাম স্মরণে বিজেপি
|| সহেলী চক্রবর্তী ||
সালটা ২০০৬-২০০৭। সিঙ্গুরের মাটিতে জমি অধিগ্রহণকে কেন্দ্র করে রক্ত ঝড়েছিল। তাপসী মালিকের মৃত্যু, রাজকুমারের মৃত্যুতে তৎকালীন শাসক দল বামফ্রন্টকে কাঠগড়ায় তুলেছিলেন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁর বক্তব্য ছিল জোর করে কৃষকদের জমি অধিগ্রহণ করা যাবে না। তখন মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। শিল্পমন্ত্রী ছিলেন প্রয়াত নিরুপম সেন। তৃণমূল সুপ্রিমোর ঝাঁঝালো আক্রমণের নিশানায় ছিলেন তাঁরা।
সিঙ্গুরের শতকরা ৯০ শতাংশ জমি চাষাবাদে নিযুক্ত। এর মধ্যে ১০০০ একর জমি নিয়ে ২০০৬ সালে টাটা মোটর্স কোম্পানিকে দেওয়া হয়। ২০০৭-২০১১সালে এখানে টাটা ন্যানোর কারখানা নির্মাণ শুরু হয়। সেই সময়ে জানা যায় যে কিছু চাষিকে পুরো ক্ষতিপুরণ দেওয়া হয়নি। জুন মাসে পশ্চিমবঙ্গ সরকার কোর্টে জানায় যে প্রায় ৩০ শতাংশ চাষি ক্ষতিপূরণের চেক নিতে রাজি হননি। এই নিয়ে ২০০৭ থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে প্রবল গণ আন্দোলন আরম্ভ হয়। দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ের উপর অনশনে বসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।
২০০৮ সাল। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলনে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে দুর্গাপুর এক্সপ্রেসওয়ে। বিজেপি নেতা রাজনাথ সিং সেসময় হাজির হয়েছিলেন মমতার আন্দোলন মঞ্চে। অর্থাৎ স্পষ্ট, সেসময় সিঙ্গুরের জমি অধিগ্রহন নিয়ে যে আন্দোলনের বীজ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বপন করেছিলেন তাতে সায় ছিল বিজেপিরও। মমতার সুরে সুর মিলিয়ে তারা বলেছিলেন, জোর করে কৃষকের জমি কেড়ে নেওয়া যাবে না। এরপর বয়ে গিয়েছে অনেক জল। সিঙ্গুরের উপর ভর দিয়েই এরাজ্যে ৩৪ বছরের বাম শাসনকে সমূলে উৎখাত করে ক্ষমতায় আসেন তৃণমূল।
একদিকে সিঙ্গুর। অন্যদিকে নন্দীগ্রাম। রাজনৈতিকভাবে তাৎপর্যপূর্ণ বরাবরই সিঙ্গুর। দেশের অন্যান্য রাজ্যের জমি অধিগ্রহণ হলেও এ রাজ্যে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জমি অধিগ্রহণের ক্ষেত্রে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে চেয়েছিলেন। তাঁর কথায় কৃষকদের বঞ্চিত করা যাবে না। যদিও তৎকালীন বাম সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য জানিয়েছিলেন কৃষকের জমির ন্যায্যদাম তাঁরা দিয়েছেন। তাতেও চিঁড়ে ভেজেনি। জল এতদূর গড়ায় যে কলকাতায় তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন তৎকালীন বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কলকাতায় ইনফরমেশন সেন্টারে বৈঠকে বসেন। সেখানেও জট খোলেনি।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সিঙ্গুর ফিরে যান। আন্দোলন আরও তীব্রতর হয়ে ওঠে। সেখান থেকে মেট্রো চ্যানেলে ধরনায় বসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। যার সাক্ষী থেকেছে গোটা রাজ্যের মানুষ। যদিও তখন সিঙ্গুরে কারখানা তৈরীর কাজ শুরু হয়ে গিয়েছে। ২০১১ সালের মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পর প্রথম ল্যান্ড অ্যাকুইজিশন অ্যাক্ট সংশোধন করলেন। তৎকালীন ভূমি ও রাজস্ব মন্ত্রী আব্দুর রাজ্জাক মোল্লা বিধানসভার বাইরের লবিতে দাঁড়িয়ে বলেন আমলারাই ডুবিয়েছে বুদ্ধ বাবুকে। যদিও তিনি পরে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগদান করে মন্ত্রী হয়ে যান। তারপর সিঙ্গুর মামলা হাইকোর্ট থেকে যায় সুপ্রিম কোর্টে।
৩১ আগস্ট ২০১৬ সাল। সুপ্রিম কোর্টে সিঙ্গুর মামলার ঐতিহাসিক রায় ঘোষণা হয়। নৈতিক জয় হয় মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বিচারপতি অরুণ কুমার মিশ্র ও বিচারপতি ভি. গোপাল গৌড়া-র ডিভিশন বেঞ্চ, ২০০৬ সালের জমি অধিগ্রহণ অবৈধ ঘোষণা করে। টাটাগোষ্ঠীকে চাষীদের জমি ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দেয়। ১২ সপ্তাহের মধ্যে অনিচ্ছুক চাষীদের জমি ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেয়।
এই ঘটনা ঐতিহাসিক। কারণ ভারতবর্ষের আর কোন রাজ্যে ভূমি আন্দোলন এরূপ প্রাধান্য লাভ করেনি। মূলত এই মামলাই ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট সরকারের ভিতকে উৎপাটিত করতে ও বর্তমান সরকারকে ক্ষমতায় আসার পথকে প্রসারিত করেছিল। তবে এই মামলার প্রভাব কিন্তু রাজনৈতিক ব্যাপ্তি ছাড়িয়ে সামাজিক ও অর্থনৈতিক পরিসরেও বিস্তৃতি লাভ করে।
টাটারা তাদের জমি ফেলে রেখে দিয়ে চলে যায়। নির্মীয়মান সেই প্রকল্প ভাঙার কাজ শুরু হয়। রাজ্য সরকারের তরফে সেক্ষেত্রে অর্থ বরাদ্দ করা হয়। যদিও তাতে সিঙ্গুরের জমির কোনো সুরাহা হয়নি। ক্রমেই সেই জমির রুক্ষ চেহারা ফুটে ওঠে। নিন্দুকেরা বলেন, এরাজ্যের শিল্পের ক্ষেত্রে যে খরা রয়েছে তা জানতেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রকাশ্যে স্বীকার না করলেও মনে মনে তিনি জানতেন সিঙ্গুর কারখানায় এ রাজ্যে গড়ে উঠলে রাজ্যের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি পাল্টে যেতে পারত। শুধু তাই নয় শিল্প স্থাপনের পাশাপাশি বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ করে উঠত।
এরপর সেই জমিতে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সর্ষের বীজ ছড়ালেন। বিজেপি নেতা দিলীপ ঘোষের কথায় এই সর্ষের মধ্যেই লুকিয়ে রয়েছে ভূত। ২০২১ সালে বিধানসভা নির্বাচনে তৃতীয়বার বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ব্যাপকভাবে পর্যদস্ত হয় বিজেপি। শুধু তাই নয় যে কৃষি আইন কেন্দ্রীয় সরকার প্রণয়ন করেছিলেন, কৃষকদের দীর্ঘ আন্দোলন প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন। এরাজ্যের বিজেপি নেতৃত্ব কৃষি বাঁচাও ও কৃষক বাঁচাও আন্দোলনে নামে। যেখানে এক সময় মঞ্চ করে আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসার বীজ পুঁতে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, আজ সেখানে দাঁড়িয়েই শাসককে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিচ্ছেন বিরোধী বেঁচে থাকা গেরুয়া শিবির।
তাদের কথায় এরাজ্যে শিল্প করতে হবে। আজ তাদের এই আন্দোলনে স্পষ্ট সে সময় তারা ভুল ছিলেন। এই আন্দোলনে থেকে মঞ্চে দাঁড়িয়ে রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার, বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী, রাহুল সিনহা, শমিক ভট্টাচার্যের মতো নেতারা শিল্পের পক্ষে সওয়াল করছেন। তাহলে কি বিলম্বিত বোধোদয় বিজেপির ? অথচ ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে লকেট চট্টোপাধ্যায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তিনি জিতলে শিল্প গড়ে উঠবে সিঙ্গুরে। কিন্তু দুবছরে তার প্রতিশ্রুতির বিন্দুমাত্র পূরণের প্রতিফলন বাস্তবে দেখা গেল না।
একদিকে ২০২৪ এর লোকসভা নির্বাচনের আগে বিজেপির এই সিঙ্গুর আন্দোলন যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ বলেই মনে করছেন রাজনৈতিক মহল। তাদের মতে, বাম জমানায় মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য্য বলেছিলেন, ‘কৃষি আমাদের ভিত্তি আর শিল্প আমাদের ভবিষ্যৎ’ । বামেরা ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার ১০ বছর পর কার্যত প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সেই কথাকেই মান্যতা দিয়ে আন্দোলন শুরু করল বিজেপি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ক্ষমতা দখল থেকে শুরু করে রাজনৈতিক ব্যাপ্তি পরের বিষয়। শিল্পের দিক থেকে এ রাজ্য যে অনুকূল পরিস্থিতিতে নেই তা স্পষ্ট। কারণ অন্যতম উদাহরণ দেওচা পাচামি কয়লা খনি প্রকল্প। নানাবিধ জটে আটকে রয়েছে এই কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলন। যদি তা সম্ভবপর হয় তাহলে এরাজ্যের অর্থনৈতিক চেহারা বদলাতে শুরু করবে। যদিও দেওচা পাচামি নিয়ে ইতিমধ্যেই সরব হয়েছে গেরুয়া শিবির।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ঈশান কোণে অশনি সংকেত। বছর ঘুরতেই এরাজ্যে বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন। তার আগে সিঙ্গুরে আন্দোলন শুরু করে কি বার্তা দিতে চাইছে বিজেপি তা অনুধাবন করতে পারছেন সকলেই। তৃতীয়বার ক্ষমতায় এসে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, আগামী বছরগুলোতে তাঁর লক্ষ্য হবে এরাজ্যে শিল্পের পরিস্থিতি পরিবর্তন ঘটানো। বিপুল কর্মসংস্থানের সুযোগ গড়ে তোলা। বিজনেস সামিট থেকে আদৌ কোন শিল্প রাজ্যে আসে কিনা সেদিকে নজর থাকবে সমস্ত রাজনৈতিক মহলের।
উল্লেখ্য, লোকসভা নির্বাচনে এ রাজ্যের ৪২ টি আসনে পদ্ম ফুল ফোটাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে গেরুয়া শিবির। অন্যদিকে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কে প্রধানমন্ত্রী দাবীদার হিসেবে তুলে ধরতে মরিয়া তৃণমূল কংগ্রেস। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন যে সিঙ্গুরকে হাতিয়ার করেই পাশা উল্টেছিল এ রাজ্যের রাজনৈতিক রঙের, এবার ঠিক সেই পথেই অগ্রগামী হয়েছে ভারতীয় জনতা পার্টি। তাদের লক্ষ্য পশ্চিমবঙ্গের কুরসি দখল।
এখানে উঠছে প্রশ্ন। একদিন যে আন্দোলন করে এরাজ্যের রাজনৈতিক পালাবদল ঘটিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবার সেই আন্দোলন কি তৃণমূল কংগ্রেসের পাশা উল্টে দিতে সক্ষম হবে? তাহলে কি সেদিন সিঙ্গুরের চাষীদের ভুল বুঝিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়? তাহলে কি এটাই ধরে নিতে হবে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ভবিষ্যৎ বাণী আসলে কতটা বাস্তব?