বালির দাপটে মধ্যবঙ্গে তৈরি হয়েছে সমান্তরাল অর্থনীতি, নাভিশ্বাস উঠছে আমজনতার
দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্ক: শিল্পহীন পশ্চিমবঙ্গে সহজে কাঁচা টাকা রোজগারের বেশ কিছু পথ আছে। তারমধ্যে অন্যতম সহজ উপায় হল বালি খাদানে বালি তোলার শ্রমিকের কাজ করা। অনেকে আবার ট্রাক চালক হিসেবেও এই শিল্পের মাধ্যমে রোজগার করেন। দুই বর্ধমান, বাঁকুড়া জেলায় যেমন বালি খাদান শিল্পের রমরমা দেখা যায়, তেমনই উত্তরবঙ্গে তিস্তা নদীর ধার ঘেঁষে অনেক জায়গায় বালি খাদান শিল্প গড়ে উঠেছে।
এই বালি খাদান আবার যতটা না বৈধ তার থেকে অবৈধ খাদানের সংখ্যা বহুগুণে বেশি। তবে বৈধ বালি খাদানগুলি থেকে সরকার নিয়মিত রাজস্ব পেয়ে থাকে। মাত্র ১ মাস আগে বালি খাদানের ট্রাকগুলি থেকে টোল আদায় বাবদ খণ্ডঘোষের একটি পঞ্চায়েত যে বিপুল পরিমাণ অর্থের চুক্তি করেছে ঠিকাদার সংস্থার সঙ্গে, তা নিয়ে যথেষ্ট হৈচৈ শুরু হয়েছে। এই চুক্তি বুঝিয়ে দিচ্ছে বালির দাপট ঠিক কতটা!
পূর্ব বর্ধমানের খণ্ডঘোষের শশঙ্গা গ্রাম পঞ্চায়েত গত ডিসেম্বর মাসে বার্ষিক ১ কোটি ৯৯ লক্ষ ৫০ হাজার টাকার চুক্তিতে এলাকার রাস্তার উপর দিয়ে যাওয়া বালি বোঝাই ট্রাক থেকে টোল আদায়ের অধিকার দিয়েছে একটি ঠিকাদার সংস্থাকে। একটি গ্রাম পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে এই পরিমাণ আর্থিক চুক্তি যথেষ্ট আকর্ষণীয় ব্যাপার। খুবই অল্প সংখ্যক পঞ্চায়েত আছে যারা সরকারের কাছ থেকে ছাড়া অন্য উপায়েও এতো বিপুল পরিমাণ অর্থ আয় করার সুযোগ পায়।
তবে এই বিপুল পরিমাণ অর্থের চুক্তির জন্য যথেষ্ট কৌশলী হতে হয়েছিল শশঙ্গা পঞ্চায়েতকে। তাঁরা ই-টেন্ডারের মাধ্যমে গোটা বিষয়টি সম্পন্ন করেন। বিশেষজ্ঞদের মতে ই-টেন্ডারের ফলেই এতো বিপুল অর্থ পাওয়া সম্ভব হয়েছে।
কিন্তু একই ব্লকের লোদনা গ্রাম পঞ্চায়েত তিন বছরের জন্য ১৫ লক্ষ ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে অপর একটি সংস্থাকে বালি বোঝাই গাড়ি থেকে টোল আদায়ের অধিকার দিয়েছে। দুটোই কিন্তু শাসক তৃণমূলের দখলে থাকা পঞ্চায়েত। এই লোদনা পঞ্চায়েতটি অবশ্য ই-টেন্ডার করেনি। একই ব্লকের দুই পঞ্চায়েতের চুক্তি অর্থের এই বিপুল ফারাক নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বিতর্ক তৈরি হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে লোদনা গ্রাম পঞ্চায়েত স্বজনপোষণ করার জন্যই অনেক কম টাকায় টোল আদায়ের অধিকার দিয়ে দিয়েছে বেসরকারি সংস্থাকে।
মজার ব্যাপার হচ্ছে রাজ্য প্রশাসন বারবার ই-টেন্ডারের কথা বললেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই তা করা হয় না। উল্টে পঞ্চায়েতের কর্তাব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গেই টোল আদায়ের চুক্তি করা হয়ে থাকে। নয়তো তাঁদের ঘনিষ্ঠ অন্য কোনো ব্যক্তি এই সুযোগ পান।
এ তো গেল বালি বোঝাই গাড়ি থেকে টোল আদায় নিয়ে বিতর্কের প্রসঙ্গ। কিন্তু মূল বিষয়, অর্থাৎ বালি উত্তোলন নিয়ে বিতর্কের কাছে এই টোল আদায় বিতর্ক যেন নেহাতই শিশু।
শুধু পূর্ব বর্ধমান জেলাতেই সরকারি হিসাব বলছে ৪২৭ টি বালি খাদান আছে। অর্থাৎ বৈধ বালি খাদানের কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু জেলার প্রতিটি মানুষ জানে বালি উত্তোলনের খাদানের সংখ্যা সরকারি হিসেবের বহুগুণ বেশি। বৈধ বালি খাদানের থেকে অবৈধ বালি খাদানের সংখ্যাই বেশি।
বিষয়টা শুধু বৈধ-অবৈধ নয়, বিষয়টা আসলে প্রকৃতি পরিবেশ এবং মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় বৈধ বালি খাদানের মালিকরাই অবৈধ উপায়ে বালি উত্তোলন করছেন। সরকারি নিয়ম বলছে একটি বৈধ বালি খাদানের এলাকা ৫ একর। এক্ষেত্রে জেলা ভূমি সংস্কার দফতর প্রতিটি বালি খাদানের জন্য ৫ একর করে জায়গা চিহ্নিত করে দিলেও প্রভাবশালী খাদান মালিকরা তা প্রায় কখনই মেনে চলেন না।
তাঁরা দামোদর, অজয়, ময়ূরাক্ষীর বুকে বৈধ খাদানের জায়গা ছাড়িয়ে নিজেদের খেয়ালখুশিমতো বালি উত্তোলন করতেই থাকেন। এমনকি আজকাল জেসিবি মেশিন, পাম্প ইত্যাদি স্বয়ংক্রিয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে অতিরিক্ত পরিমাণে বালি আদায় করা হচ্ছে। অথচ বালি উত্তোলনের ক্ষেত্রে এতো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ।
এক্ষেত্রে বালি খাদানের মালিকদের সঙ্গে শাসক দলের নেতৃত্বে সম্পর্কের বিষয়টি দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। কোথাও কোথাও শাসক দলের নেতারাই বেনামে বালি খাদান চালিয়ে থাকেন বলেও বিভিন্ন সময়ে অভিযোগ উঠেছে।
বালি খাদান মালিকদের কাজকর্ম ও প্রভাব-প্রতিপত্তি এতটাই যে তারা এলাকার মানুষের কাছে ‘বালি মাফিয়া’ নামে পরিচিত হয়ে উঠেছেন। কিন্তু নদী বিশেষজ্ঞ ও ভূ-বিজ্ঞানীরা এই নিয়ে সতর্ক করে দিয়েছেন। তাঁরা স্পষ্ট জানিয়েছেন অপরিকল্পিতভাবে বালি উত্তোলন হতে থাকলে নদী যেকোনও সময়ে তার গতিপথ পরিবর্তন করতে পারে। সেক্ষেত্রে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসবে নদীর তীরবর্তী এলাকার মানুষের জীবনে। কিন্তু তাতে এই বালি মাফিয়াদের কিছুই যায় আসেনা!
বালি মাফিয়াদের দৌরাত্ম নিয়ে যত কথাই হোক না কেন তা কম পড়বে। শাসকদলের আশীর্বাদের হাত মাথায় থাকাতেই তারা পুলিশ প্রশাসনকে থোড়াই কেয়ার করে নদীতে নৌকা পর্যন্ত নিয়ে গিয়ে বালি উত্তোলন করে থাকে।
এমনকি প্রশাসন ১৪৪ ধারা জারি করেও প্রাচীন নদী বাঁধের উপর বালি বোঝাই ট্রাকের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে পারেনি। নাকি বন্ধ করতে চায়নি! এর ফলে দামোদরের উপর নির্মিত বাঁধ বহু জায়গায় নষ্ট হয়ে যেতে বসেছে।
তার উপর অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে বাঁধ ও নদীর মধ্যবর্তী চড়ে মোরাম ফেলে ট্রাক চলাচলের রাস্তা পর্যন্ত বানিয়ে ফেলেছে এই বালি মাফিয়ারা। এই ধরণের কার্যকলাপ জাতীয় নদী আইনে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এই ঘটনাগুলোই বুঝিয়ে দিচ্ছে শাসক দলের একাংশের সঙ্গে ওতপ্রোত যোগসাজশেই তারা এতটা বেড়ে উঠতে পেরেছে। কারণ নদীর চরে রাস্তা তৈরি বা বাঁধের উপর দিয়ে ট্রাকের দৌরাত্ম্য, শাসক দল ও স্থানীয় প্রশাসনের সমর্থন না পেলে কোনভাবেই চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।
এক্ষেত্রে যে শ্রমিকরা বৈধ খাদানে কাজ করেন তাঁদের থেকে অনেকটাই বেশি টাকা উপার্জন করেন যারা অবৈধ বালি খাদানের সঙ্গে যুক্ত। কাঁচা টাকা রোজগারের এই হাতছানিতে কৃষিপ্রধান পূর্ব বর্ধমানের অনেক চাষিও চাষবাস ছেড়ে বালি খাদানের শ্রমিক হিসেবে কাজ করছেন! বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা বালি খাদানে লাগাম পরাতে না পারলে আগামী দিনে নদী গতিপথ পরিবর্তন করে যেমন ভয়াবহ বিপর্যয় টেনে আনবে, তেমনই কৃষিক্ষেত্রে মানব সম্পদের সমস্যা দেখা দিতে পারে।
এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হল মাঝেমধ্যে উপরতলা থেকে চা এলে জেলা প্রশাসন বালি খাদানের বিরুদ্ধে বিশেষ অভিযান চালায়। কিন্তু তাতে কখনোই খাদান মালিকরা ধরা পড়ে না। সাধারন দিন আনি দিন খাই শ্রমিকদেরই আটক করে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু খাদান মালিক বা বালি মাফিয়াদের গায়ে হাত না পরায় দু’দিন পর আবার আগের মতোই বালি চুরির কাজ শুরু হয়ে যায়।
এ তো গেল অবৈধ বালি ব্যবসার একটা দিক। খাদান থেকে বালি উত্তোলনের পর শুরু হয় আরেক দৌরাত্ম্য। প্রায় প্রতিটি ট্রাকি ওভারলোডিংয়ের দোষে দুষ্ট। যার জেরে রাজ্য সড়ক থেকে শুরু করে জাতীয় সড়ক কোনও রাস্তাই দু’দিনের বেশি টিকছে না। এর জেরে যেমন হামেশাই দুর্ঘটনা ঘটছে, তেমনই বারেবারে রাস্তা সরাতে গিয়ে সরকারের খরচ অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে।
পূর্ব বর্ধমান ও বাঁকুড়ায় বালিবোঝাই গাড়ির দৌরাত্ম্য এমনই যে নিত্যযাত্রীরা সময়ে কর্মক্ষেত্রে পৌঁছতে পারেন না। হামেশাই সার সার বালি বোঝাই লরি এমনভাবে রাস্তা আটকে দাঁড়িয়ে থাকে যে গুরুতর অসুস্থ রোগীকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্স এগিয়ে যেতে পারে না। খণ্ডঘোষ, জামালপুর, কেতুগ্রাম, রায়না ওদিকে সোনামুখী, বড়জোরায় মাঝেমধ্যেই সময়ে হাসপাতালে পৌঁছতে না পারায় মাঝ রাস্তাতেই রোগী মৃত্যুর ঘটনা ঘটে।
রাস্তাঘাটের এই অবস্থার পুরোটাই জানে শাসক দল এবং তাদের জনপ্রতিনিধিরা। তবু সকলে নির্বিকার। অবশ্য পিছনের দরজা দিয়ে এই নির্বিকার থাকার মূল্য বুঝে নেন জনপ্রতিনিধিরা। ঘুরপথে তাঁদের কাঞ্চন যোগ মন্দ হয় না!
এই সমস্ত অঞ্চলে রাতের অন্ধকার নামলে বালি মাফিয়াদের দাপট চরমে পৌঁছয়। বিভিন্ন গ্রামে শয়ে শয়ে বালি বোঝাই ট্রাকের লাইন লেগে যায়। তারপর সকালের ব্যস্ত সময় জুড়ে সেই সমস্ত বালি বোঝাই ট্রাক কলকাতার দিকে এগিয়ে চলে।
প্রশ্ন উঠতেই পারে স্থানীয়রা কেন এই দৌরাত্ম্যের প্রতিবাদ করছেন না। একেবারে যে প্রতিবাদ হয়নি তা নয়। তবে যখনই প্রতিবাদ করতে গিয়েছেন তখনই শাসকদলের চক্ষুশূল হতে হয়েছে স্থানীয় বাসিন্দাদের। তাছাড়া বালি মাফিয়ারা প্রয়োজনে খুনখারাপির রাস্তায় হাঁটতে পারে বলে আশঙ্কা আছে আম জনতার।
তবে যদি ভেবে থাকা হয় এই বিষয়টি স্থানীয় স্তরেই সীমাবদ্ধ তাহলে খুব ভুল হবে। খোদ মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত যে বালি মাফিয়াদের দৌরাত্ম্যের কথা জানেন তা বারেবারে তার বিভিন্ন বক্তব্য থেকে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে। সেই ২০১৫ সাল থেকে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিভিন্ন দলীয় কর্মসূচি থেকে অবৈধ বালি ব্যবসা নিয়ে কড়া মনোভাবের বার্তা দিয়ে চলেছেন। স্পষ্ট জানিয়েছেন দলের যে নেতাকর্মীরা অবৈধ বালি ব্যবসা করবে তাদের তৃণমূলে জায়গা হবে না।
প্রকাশ্যে মন্তব্য করে যে মুখ্যমন্ত্রী নিজের দায় সেরেছেন তা কিন্তু নয়, বরং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রশাসনকে বারবার নির্দেশ দিয়েছেন সবরকমভাবে অবৈধ বালি খাদান বন্ধ করার জন্য। তাঁর কড়া মনোভাব টের পেয়ে অনেক জায়গায় বৈধ বালি খাদানের চুক্তিও নতুন করে নবীকরণ করা হয়নি। নতুন খাদানের লিজ দেওয়া তো কবেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কিন্তু শাসক দল ও প্রশাসনের অন্দরেই যদি ঘুঘুর বাসা থাকে তবে একা মুখ্যমন্ত্রী আর কী করবেন!
প্রথম যে উদাহরণটি দিয়ে এই প্রতিবেদন শুরু হয়েছিল সেখানেই আপনারা বুঝতে পারছেন ঘুঘুর বাসা ঠিক কী পরিমাণে জাল বিস্তার করেছে।
বরং আর একটা কথা জেনে রাখুন, এই সমস্ত এলাকাগুলোতে যদি কোনদিন বিকেলের পর যান, তবে যেতে যেতে দেখবেন কোনও রাখঢাক ছাড়াই একদল লোক বালির গাড়ি থেকে টাকা নিচ্ছে। আসলে এটাই পূর্ব বর্ধমান, বাঁকুড়া, পশ্চিম বর্ধমানের একাংশে সমান্তরাল অর্থনীতি হয়ে উঠেছে।
শাসকদলের একদল ছেলে-ছোকরা এইভাবেই নিজেদের জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে দুষ্টু লোকেরা বলে থাকে ওই টাকার ভাগ নাকি একেবারে মাথা পর্যন্ত পৌঁছে যায়। যদিও মাথা বলতে কার কথা বলা হচ্ছে সেটা আমাদের জানা নেই!
মজার ব্যাপার হচ্ছে কোনও খাটুনি ছাড়াই যদি আপনি দৈনিক একটা ভালো টাকা রোজগার করতে পারেন তাহলে আর চিন্তা কী! ঠিক এই জায়গাটার সুযোগ নিয়ে নিজেদের সাম্রাজ্য আরও বিস্তার করে চলেছে বালি মাফিয়ারা। সবাই সব জানে, আবার কেউ কিছু জানে না! এটাই হচ্ছে পরিস্থিতি!
কিন্তু এর ফাঁক গলে পরিবেশ ও সরকারি রাজস্বের যে বিপুল ক্ষতি হচ্ছে তার দায়ভার কে নেবে? উত্তর- কেউ না। এতএব বালির দাপট চলছে চলবে!