ভার্চুয়ালে একুশের আমেজ ম্লান, শহীদ তর্পণ শেষ পর্যন্ত মানুষের কাছে পৌঁছবে তো!
সর্নিকা দত্ত
অনেকগুলো বছর আগের কথা৷ সালটা ছিল ১৯৯৩, ২১ জুলাই৷ পশ্চিমবঙ্গ যুব কংগ্রেসের তৎকালীন সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ডাকে ঐতিহাসিক যুব সমাবেশ হয়েছিল৷ সেটা ছিল যুব কংগ্রেসের কর্মসূচি৷
দাবি ছিল ভোটে ভোটার পরিচয়পত্রকেই একমাত্র প্রামাণ্য হিসেবে গণ্য করা হোক৷ এই দাবিতে সারা রাজ্যের যুব সম্প্রদায়ের হাজার হাজার মানুষ শামিল হয়েছিলেন মমতার ডাকা মিছিলে৷ সেদিন ছিল মহাকরণ অভিযান। তারপর কি হয়েছিল প্রায় সকলেরই জানা।
১৩টা তরতাজা প্রাণ সেদিন ঝরে গিয়েছিল পুলিশের গুলিতে। সেই দিনটিকে আজও ভুলতে পারেননি তৃণমূল কংগ্রেসের সর্বভারতীয় সভানেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। আজ তিনি রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী।
কংগ্রেসের না থাকলেও তাঁর নিজের দলে এই দিনটিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন করে আসেন প্রথম দিন থেকেই। শুধু ব্যতিক্রম এই বছরটাই।
ধর্মতলায় সেই গতানুগতিক শহীদ তর্পণ এবার হবে না। এবার করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বাড়বাড়ন্তের কারণে ধর্মতলা কোনও বিশাল জমায়েত হচ্ছে না। তাই বলে তিনি ভুলে যাননি একুশের সেই শহীদদের। সেই রক্তস্নাত রাজপথ, পুলিশের গুলি ও লাঠির ঘায়ে ছিন্নভিন্ন ভাইদের দেহ।
এই দিনটা বরাবরই তৃণমূলের কাছে অন্য মাত্রা নিয়ে আসে। আবেগ, প্রত্যয় এবং অঙ্গীকারে মিলেমিশে এই একটা দিন তৃণমূল কর্মীদের শহীদ তর্পণের দিন।
২০২০ সাল শুরু থেকেই ঘটনাবহুল। শাসক দল তৃণমূলকে এই বছর যেমন তার পায়ের তলার জমি ধরে রাখার জন্য লড়াই করতে হচ্ছে, একইভাবে এই বছরটা গুরুত্বপূর্ণ ঘর গোছানোর জন্য। বছর শেষে নির্বাচন।
সরকার ও মানুষের চাপে পিছু হটল সিইএসসি, এতে কলকাতার জয় দেখছেন অভিষেক
গেরুয়া শিবির কোটি কোটি টাকা খরচ করছে এ রাজ্যের মসনদ দখলের জন্য। সাম দাম দন্ড ভেদ সব ব্যবহার করে তারা চাইছে মমতাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে। কিন্তু এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ বছরে এবার একুশে জুলাই-এর সমাবেশ না হওয়াটা তৃণমূলের জন্য একটা বড় ধাক্কার।
তবে দলের তরফ থেকে ঘোষণা করা হয়েছে এই দিন তৃণমূল নেত্রী ফেসবুক ও ইউটিউবের মাধ্যমে কর্মী-সমর্থকদের কাছে দলের বার্তা তুলে দেবেন।
কিন্তু এই সম্মেলনকে ঘিরে গোটা মাসব্যাপী যে সাংগঠনিক তৎপরতা, তৃণমূল স্তরে মানুষের কাছে দলের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার যে প্রক্রিয়া চলে তা কিন্তু এবার সেভাবে ঝালিয়ে নেওয়া গেল না।
কলকাতা রাস্তা দেখতে পেল না, শহরের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে দলীয় পতাকা কাঁধে থেকে আসা আদিবাসী, সংখ্যালঘু, নমঃশূদ্র, রাজবংশী ভাইদের দীর্ঘ মিছিল। ঘাসফুল হাতে তৃণমূল সমর্থকদের রাতজাগা ভিড়।
এবছর ধর্মতলা দেখতে পেল না লাখো লাখো মানুষের কালো মাথার সারি, মেক্সিকান ওয়েভের মত, ওয়েভ মমতার দাপট। দেখা গেল না, একুশের সেই রক্ত গরম করা স্লোগান।
করোনা ভাইরাস বিশ্ব মানচিত্রের অনেক কিছুকেই বদলে দিয়ে গেছে এবছর। এবছর ঈদের রেড রোডে নামাজ ছিল অনুপস্থিত। পাকসার্কাস থেকে ইসকনের সম্প্রীতির রথ বের হয়নি।
জানা নেই শেষ পর্যন্ত দুর্গোৎসবের সেই চিরাচররিত ছবিতা এবার দেখা যাবে কিনা সন্দেহ। তবে ধর্মতলার পেল্লাই একুশে মঞ্চে মমতার ভোকাল টনিক এবার থাকবে না।
থাকবে না সেন্ট্রাল এভিনিউ জুড়ে মাইলের পর মাইল লম্বা বাসের সারি। শুধু মন্দের ভালোর মতো ব্লকে ব্লকে মাইকে বাজবে দেশাত্মবোধের গান। স্মরণ করা হবে একুশে শহীদদের ইতিহাস।
এরপর দুপুর দুটোয় টিভির পর্দায় ফেসবুকের ওয়ালে অথবা ইউটিউবের নোটিফিকেশনে-এ ভেসে উঠবে মমতা লাইভ।
তিনি বলবেন আর পাঁচটা প্রশাসনিক সভার মতই। কিন্তু পূর্ব বর্ধমানে প্রখর রোদে হাল চষতে ব্যস্ত কৃষক সদস্যের কাছে কিংবা শান্তিপুরে তাঁত বুনতে থাকা মহিলা তৃণমূল কর্মীর কাছে সে বার্তা আদৌ পৌঁছল কিনা তা কেউ বলতে পারবে না।
তাঁরা হয়তো জানতেও পারবেন না এবছরও একুশে শহীদদের ভোলেননি অগ্নিকন্যা। শুধু অপেক্ষাই থাকবে তাদের চোখে। এবার নয়তো নেভার…।