বুদ্ধিজীবীরা আগেই বাংলায় প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছেন
দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ নন্দীগ্রাম কাণ্ডের পর কলকাতার রাজপথ পরপর দুদিন দুটো বড় মিছিলের সাক্ষী হয়েছিল। কোনও রাজনৈতিক দল নয়, বরং বিভিন্ন ক্ষেত্রে কৃতি ও সজ্জন মানুষদের ডাকে পা মিলিয়েছিল হাজারে হাজারে।
যদিও রাজ্যবাসী পরিষ্কার বুঝতে পেরেছিল সেই মিছিল ছিল সরকার বিরোধী ও সরকারপন্থীদের। তবে সেই প্রথম বাংলার আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটির প্রবল উত্থান ঘটে। এর আগেও বুদ্ধিজীবীরা ছিলেন, কিন্তু এই শব্দ বন্ধটিকে আগে ততটাও ধারাল হাতিয়ার হয়ে উঠতে দেখা যায়নি।
তৎকালীন শাসকদল সিপিএমের বিরোধিতা করে অপর্ণা সেন, জয় গোস্বামী, কৌশিক সেন, শাঁওলি মিত্ররা প্রথম মিছিলে হেঁটেছিলেন। পরবর্তী ঘটনাক্রম থেকে পরিষ্কার হয়ে যায় যে তাঁরা সকলেই তৃণমূলপন্থী ছিলেন। তবে কৌশিক, শঙ্খ ঘোষের মতো কয়েকজন অবশ্য নিজেদের কিছুটা হলেও আপাত নিরপেক্ষ রাখতে সফল হন।
এর পরের দিনের মিছিলে সব্যসাচী চক্রবর্তী, বাদশা মৈত্র, পবিত্র সরকারদের নেতৃত্বে বাম সরকারের সমর্থনে পাল্টা মিছিল হয়। এখানেও ‘বুদ্ধিজীবী’ পরিচয় তুলে ধরা হয়েছিল। তবে দুপক্ষকে আলাদা করে বোঝাতে বাম সমর্থিত শিল্পী-কৃতিদের নামকরণ হয়েছিল ‘বুদ্ধজীবী’ বলে! এ অবশ্য সেই সময়ের বিরোধীদের কটাক্ষ ছিল।
কিন্তু মিছিল, পাল্টা মিছিলের মধ্য দিয়ে বাংলার সজ্জন, শিল্পীদের পরস্পরের রাজনৈতিক আনুগত্যের বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। পরবর্তী নানান ঘটনাক্রম থেকে এটাও বোঝা যায় বিবেকের ডাক বা সমাজের প্রয়োজনে নয়, তারা যে যার রাজনৈতিক আনুগত্য ও মতাদর্শ থেকেই রাস্তায় নামেন।
শুধু পার্থ নয়, দুর্নীতির অভিযোগে এর আগেও পদচ্যুত হয়েছে বাংলার মন্ত্রীরা
যেকোনও মানুষের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক পছন্দ ও মতাদর্শ থাকতেই পারে। সেই হিসেবে তিনি তাঁর পছন্দসই পক্ষের হয়ে রাজনীতির ময়দানেও নামতে পারেন। কিন্তু শিল্পী, নাগরিক সমাজ, বুদ্ধিজীবী এই ট্যাগ লাইনগুলো নিজেদের গায়ে লাগিয়ে যখন রাস্তায় নামেন তখন এক সার্বিক নিরপেক্ষতার প্রত্যাশা থাকে আমজনতার মধ্যে। যেখানে অন্যায় অত্যাচার ব্যভিচারের বিরুদ্ধে সরব হওয়াটাই একমাত্র পক্ষ হওয়া উচিৎ। কে করছে তা দেখে নিজেকে তফাতে রাখাটা পক্ষান্তরে সুবিধাবাদ ছাড়া আর কিছু নয়।
এক্ষেত্রে ব্রাত্য বসু, অর্পিতা ঘোষ বা সব্যসাচী চক্রবর্তী, বাদশা মৈত্ররা বরং অনেক পরিষ্কার। তাঁরা শিল্পী হলেও নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের প্রতি নিজেদের আনুগত্যের কথা প্রকাশ্যেই বুক ফুলিয়ে বলেন। নিজেদের কখনোই নিরপেক্ষ বলে এঁরা দাবি করেন না। কিন্তু বাকিরা গায়ে নাগরিক সমাজের ট্যাগ লাইন লাগিয়ে পক্ষপাতিত্ব করেন বলেই আজ ‘বুদ্ধিজীবী’ শব্দটি গালাগালে পরিণত হয়েছে। মানুষ শিল্পী, বিজ্ঞানী, কৃতিদের আর কদর করছে না।
অথচ একটা সময় মনে করা হতো যাঁরা যত মেধা ও বুদ্ধির চর্চা করেন তাঁদের মেরুদণ্ড তত সবল। তাঁরা কখনোই অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা ঝোঁকান না। এক্ষেত্রে প্রয়াত কবি শঙ্খ ঘোষের থেকে আদর্শ উদাহরণ বোধহয় কেউ হতে পারেন না। নন্দীগ্রাম কাণ্ডের পর অপর্ণা, অর্পিতা, কৌশিকদের সঙ্গে মিছিলে পা মিলিয়ে তৎকালীন সরকারের যেমন তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন, তেমনই ২০১৮ এর পঞ্চায়েত নির্বাচন সময় বিরোধীদের কন্ঠ রোধের চেষ্টা দেখেও শঙ্খ ঘোষ সমানভাবে সোচ্চার হয়েছিলেন।
প্রয়াত শঙ্খ ঘোষ নিঃসন্দেহে নাগরিক সমাজের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিলেন। তাঁর কাছে অন্যায়টাই মুখ্য ছিল। সেটা তৃণমূল করল, না সিপিএম, নাকি বিজেপি সেটা দেখে প্রতিবাদে তিনি ভেদাভেদ করেননি। কিন্তু একা শঙ্খ ঘোষ কী আর শিল্পী সমাজের এই চূড়ান্ত অধঃপতন রোধ করতে পারেন!
তাইতো বিভিন্ন পক্ষের ক্রীড়ানকে পরিণত হয়েছেন তথাকথিত কৃতি বাঙালিরা!