হোটেলে পাক সেনার সঙ্গে ৩২ ঘণ্টা লুকোচুরি, গণহত্যার সংবাদদাতা সাইমন ড্রিং প্রয়াত
ভিয়েতনাম থেকে পাকিস্তান, হাইতি : সাইমন ড্রিং মুক্তিযুদ্ধের কথক
দ্য কোয়ারি ডেস্ক: বিশ্ব কেঁপে গেছিল। ৩০ মার্চ, ১৯৭১ সালে লন্ডন ডেইলি টেলিগ্রাফের শিরোনাম “ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান ” দেখে। এক্সক্লুসিভ সেই সংবাদেই প্রকাশ হয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পাক সেনার গণহত্যার বিবরণ ছবি। ভয়াবহ সেই ঘটনার মুহূর্তে ঢাকায় একমাত্র বিদেশি সাংবাদিক সাইমন ড্রিং টানা ৩২ ঘণ্টা লুকোচুরি চালিয়ে যান। সে এক রোমহর্ষক অধ্যায়।
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর বিবরণ দেওয়া প্রখ্যাত ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং প্রয়াত হলেন। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৫ বছর। তাঁর প্রয়াণে বাংলাদেশ শোকস্তব্ধ। আন্তর্জাতিক যুদ্ধ সংবাদ সংগ্রহকারী সাংবাদিক মহলে ছড়িয়েছে শোক।
ভিয়েতনাম থেকে পাকিস্তান: সাইমন ড্রিং মুক্তিযুদ্ধের কথক: বিশ্বজোড়া দুটি মুক্তি সংগ্রামের সংবাদ প্রতিবেদনকারী হিসেবে সাইমন ড্রিং থাকবেন স্মরণীয়। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফ সংবাদপত্রের হয়ে ভিয়েতনামে আমেরিকান সেনার বর্বরতা লিখে বিশ্ব কাঁপিয়েছিলেন তিনি। এমন সাংবাদিককে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় পাঠায় তাঁর সংস্থা। ১৯৭১ সালের ঢাকা তখন পাকিস্তানি সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র গণ আন্দোলনের কেন্দ্র।
সাইমন ড্রিং যখন ভিয়েতনাম থেকে ঢাকা আসেন। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক ঘনঘটা আরও ঘোরালো হয়। তিনি ঢাকায় অন্যান্য বিদেশি সংবাদদাতাদের সঙ্গে থেকে যান। ২৫ মার্চ পাকিস্তান সরকার ঢাকায় গণহত্যা শুরু করল। পোশাকি নাম “অপারেশন সার্চলাইট”। সেই ভয়াবহ রাতেই বন্দি করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে। এর পরেই বিদেশি সাংবাদিকদের ঢাকা থেকে জোর করে বের করে করাচি নিয়ে যায় পাক সেনা।
এখানেই ঘটনার মোড় নেয়। পরিস্থিতি বুঝে ব্রিটিশ সাংবাদিক সাইমন ড্রিং আত্মগোপন করেন বিখ্যাত হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ভিতর। ২৫ মার্চের ভয়াবহ ট্যাংক অভিযান, গণহত্যার ছবি ও বিবরণ তিনিই হোটেল থেকে দেখে সাংকেতিক আকারে লিখে রাখেন।
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের ভয়াবহ ৩২ ঘণ্টার সেই মুহূর্তে সাইমন ড্রিং ছদ্মবেশ নিয়ে গুটি কয়েক হোটেল কর্মীর সাহায্যে কখনো জলের ট্যাংকে, চেয়ার টেবিলের আড়ালে, রান্নাঘরের ভিতর লুকিয়ে ছিলেন। তাঁর খোঁজে পাক সেনা বারবার হোটেলে তল্লাশি চালিয়ে বিফল হয়।
২৫ মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরুর মুহূর্তগুলি সাইমন ড্রিং গোপনে সংরক্ষণ করেন। ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ উঠে গেলে হোটেলের কর্মচারীদের সহযোগিতায় ছোট্ট একটি মোটরভ্যানে করে ঘুরে ঘুরে দেখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, রাজারবাগ পুলিশ ব্যারাক ও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকা। তারপর লেখেন ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামের এক প্রতিবেদন। ৩০ মার্চ সেই সংবাদ প্রকাশ করে লন্ডন টেলিগ্রাফ।
সংবাদ প্রকাশের পরেই আন্তর্জাতিক মহলে তীব্র শেরগোল পড়ে যায়। এর পর সাইমন ড্রিং কে বন্দি করে পাক সরকার। প্রবল অত্যাচার করে তাঁকে ঢাকা থেকে করাচি নিয়ে যাওয়া হয়। ব্রিটিশ নাগরিক হওয়ায় তাকে ছাড়তে বাধ্য হয় পাকিস্তান। লন্ডন ফিরে সাইমন ড্রিং ঢাকার বিবরণ পরপর প্রকাশ করতে থাকেন। গণহত্যার বিবরণগুলি বিশ্বজুড়ে আলোড়ন ফেলে দেয়। ফের সাইমন ড্রিং লন্ডন থেকে কলকাতা আসেন। মুক্তিযুদ্ধের বিবরণ সীমান্ত এলাকা থেকে ঘুরে এসে লিখতেন।
টানা ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তানের থেকে ছিন্ন হয়ে তৈরি হয় বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর সাইমন ড্রিং নতুন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় আসেন ভারতীয় সেনার সঙ্গে। পরবর্তীতে দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন সাইমন ড্রিং। শুধু বাংলাদেশ নয়, হাইতি দ্বীপে আমেরিকান সেনার হামলার ঘটনাস্থল থেকে সংবাদ লিখেছেন তিনি।