মোদীর শাসনে সত্যিই ‘হিন্দুত্ব খাতরেমে’
পার্থ প্রতীম বিশ্বাস
রাজ্য সম্পাদক
পশ্চিমবঙ্গ প্রদেশ কংগ্রেস কমিটি
২০১২ সাল থেকে যে মানুষটাকে দেশবাসী একমাত্র ভরসাস্থল ভাবতে শুরু করেছিলেন সেই মানুষটা যখন বললেন, বিদেশ থেকে কালো টাকা ফিরিয়ে এনে প্রতিটি দেশবাসীর ব্যাঙ্ক একাউন্টে ১৫ লক্ষ টাকা ভরে দেবেন, দেশবাসী তখন আহ্লাদে আটখানা। সকলের মনে তখন একটাই স্লোগান ‘পদ্মে ভোট দাও পদ্মে ভোট দাও হাত ডুবে যাক হাত ডুবে যাক’। হলোও তাই।
দেশের স্বাধীনতার পর এই প্রথমবার জাতীয় কংগ্রেসের নির্বাচনী প্রতীক ‘হাত’ লজ্জাজনক ভাবেই ডুবে গেল। মোদীজী শপথ নিয়েই প্রধানমন্ত্রী পদটাকে ‘প্রধান সেবক’ বানিয়ে দিলেন। এরপর দেশবাসীকে ব্যাঙ্কে জিরো ব্যালান্স একাউন্ট খুলিয়ে গিনেস বুকে রেকর্ড গড়লেন। দেশবাসীও তখন বেজায় খুশিতে।
ম্যাজিশিয়ানরা যেমন ‘গিলিগিলিগে’ বলে দর্শককে সম্মোহিত করেন, মোদীজী যেন ঠিক তেমনি ভাবেই দেশবাসীকে সম্মোহিত করে ফেলেছেন। দেশবাসীর স্বপ্নে ভাবনায় তখন শুধুই ‘১৫ লাখ’।
এরপর এলো নোটবন্দী। সিয়াচেন এ বরফের ভেতরে সারা বছর ধরে সীমান্ত পাহারা দেওয়া বড়োজোর পাঁচ হাজার সেনাকে নকল করে দেশের সামান্য কিছু বড়লোক বাদ দিয়ে বাকী প্রায় ১৩০ কোটি নাগরিক মাসের পর মাস ব্যাঙ্কের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন।
আরও পড়ুনঃ বাংলার গর্ব মমতা’য় কখনই সিলমোহর দেবে না বাঙালি
যদিও এরা প্রায় সকলেই বুঝতে পারলেন যে, দেশের অর্থনীতিকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া হলো, কিন্তু সে কথা বললেই তাকে ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দেওয়া হবে, এই ভয়ে অনেকেই চুপ থাকলেন। নোটবন্দীর ফলে বন্ধ হলো দেশ জুড়ে কাঁচা টাকায় চলা হাজার হাজার কর্মদ্যোগ। আর এসব লক্ষ্য করে অনেকেই সত্যি কথাটা বলে মোদীজীর মনগড়া ‘দেশদ্রোহী’ তকমা পেতেও পিছপা হননি।
এরপর জিএসটি এলো। পূর্ববর্তী সরকার সর্বোচ্চ ১৮ শতাংশ কর বেঁধে যে জিএসটি আইন করতে চেয়েছিল এবং সেদিনের বিরোধীপক্ষ তা করতে দেয়নি, মোদীজীর সরকার সেই জিএসটি সর্বোচ্চ ২৮ শতাংশ কর বেঁধে আইন নিয়ে এলেন। দেশবাসী তাতেও খুশি। ওদিকে এই আইন আনার সঙ্গে সঙ্গেই অন্ধকারে চলে গেল দেশের লাখোলাখো ক্ষুদ্র শিল্প ও উদ্যোগ। প্রতিষ্ঠিত বেকার সংখ্যার সঙ্গে যুক্ত হতে লাগলেন নতুন কর্মহীনের দল।
কারণ, তাঁর দেওয়া কথা ‘বছরে দুকোটি বেকারের চাকরী’ বেমালুম ভুলেই গেলেন মোদীজী। এসবের ফাঁকে আরও একটা নিয়ম এলো, তা হলো, ব্যাঙ্ক খাতায় ন্যূনতম অর্থরাশি জমা না থাকলে ফাইন হিসাবে টাকা কেটে নেওয়া।
যে সকল দেশবাসী মোদীজীর দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে তারই কথায় ১৫ লক্ষ টাকা পাওয়ার আশায় জিরো ব্যালান্স অ্যাকাউন্ট খুলেছিলেন, তাদের সে টাকা পাওয়া তো দূর অস্ত, বদলে যে যেটুকু টাকা ওই ব্যাঙ্ক খাতায় রেখেছিলেন, তাও আইন করে ব্যাঙ্কের মাধ্যমে কেটে নিলো সরকার। তাই আজ আর কেউ সেই স্বপ্নের ‘১৫ লাখ’-এর কথা বলেন না।
বহু মানুষ নতুন করে ফিরে গিয়েছেন তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টবিহীন পর্ণকুটিরে। বর্তমানে তাদের মুখের ভাষা বলে, ‘ভিখ চাইনা, বাপ কুকুর ঠেকা’।
এসব তো গেল দেশের নিচুতলা তথা আমজনতার সঙ্গে মোদীজী ও তাঁর সরকারের ব্যবহার। কিন্তু দেশের উঁচুতলা অর্থাৎ মোদীজীর বন্ধু তথা দেশের বড়লোকদের প্রতি মোদীজীর সরকারের ব্যবহার কিন্তু একদমই অন্যরকম। ইতিমধ্যেই সেই বন্ধুদের প্রায় ১০০ জন শিল্পপতি তথা বেওসায়ী সেজে দেশের ব্যাঙ্কে জমানো আমজনতার কয়েক লক্ষ কোটি টাকা লোন হিসাবে নিয়ে দেশ ছেড়ে ভেগেছেন।
ব্যাঙ্ক লুঠ করে পালিয়ে যাওয়া লোকেদের সে তালিকাটা মাঝে মাঝেই বাড়ছে। লুঠ হয়ে যাওয়ার ফলে বন্ধ হতে বসা রাষ্টায়ত্ব ব্যাঙ্কগুলোকে অন্য ব্যাঙ্কগুলোর সঙ্গে জুড়ে দিয়ে ‘সব ঠিক হায়’ দেখানোর চেষ্টা হলেও বাস্তবে সরকার যে দেশের ‘ভাঁড়ে মা ভবানী অবস্থা’ করে দিয়েছে, সে কথা বলাই বাহুল্য।
সাম্প্রতিক অতীতে পিএমসি ব্যাঙ্কও লুঠ হয়েছে। প্রায় সাতটা রাজ্য জুড়ে পিএমসি ব্যাঙ্কের বিস্তৃতি এবং পরিসেবা ছড়িয়ে ছিলো। সে সবের আজ প্রায় কংকালসার অবস্থা। এবারে একই অবস্থা হলো ইয়েস ব্যাঙ্কের। মোদীজী মাঝে মাঝেই প্রশ্ন করে বলেন, ‘সত্তর সালমে কংগ্রেস নে কেয়া কিয়া’।
যদিও সে প্রশ্নের উত্তর তিনি নিজেও ভালো করেই জানেন। আর এটাও জানেন যে, ওই ৭০ বছরের ভেতরে সাড়ে ছয় বছর বিজেপি নেতা অটল বিহারী বাজপেয়ীর নেতৃত্বে সরকার এ দেশে ক্ষমতায় ছিলো।
সেই অটল বিহারী সরকারের আমলে ২০০৩ সালে এই ‘ইয়েস ব্যাঙ্ক’-এর জন্ম। ইয়েস ব্যাঙ্ক থেকে ইতিমধ্যেই হাজার হাজার কোটি টাকা লোন নিয়েছেন এবং তা শোধ করেননি মোদীর বন্ধু অনিল আম্বানী, সুভাসচন্দ্ররা।
আরও পড়ুনঃ আওয়াজ একটাই লড়কে লেঙ্গে হিন্দুস্তান
ব্যাঙ্ক ডুবে যাওয়ার গোপন খবর আগাম পেয়ে গুজরাট এমনকি মোদীজীর লোকসভা কেন্দ্রের উন্নয়নের দায়িত্বে থাকা কোম্পানিও তাদের গচ্ছিত টাকা আগেই তুলে নিয়েছে।
কিন্তু মোদীজী ও তার দল, যে হিন্দুত্বের গল্প ফেঁদে দেশের জনতাকে নিয়মিত বোকা বানান, সেই হিন্দু দেবতাদের একজন প্রভু জগন্নাথ (জগতের নাথ) কিন্তু ইয়েস ব্যাঙ্কের এই দুরাবস্থার ফলে বেশ ফাঁপরেই পড়েছেন। এবারে আসুন, মোদীজীর অপশাসনে হিন্দু দেবতাদের সম্পর্কে এবং ইয়েস ব্যাঙ্কের ডুবে যাওয়ার ফলে তাদের ফাঁপরে পড়া নিয়ে বিস্তারিত ঘটনা জানি।
জগন্নাথ (অর্থাৎ, ‘জগতের নাথ’ বা ‘জগতের প্রভু’) হলেন একজন হিন্দু দেবতা। ভারতের ওড়িশা, ছত্তীসগঢ় (বস্তার অঞ্চল), পশ্চিমবঙ্গ, ঝাড়খণ্ড, বিহার, অসম, মণিপুর ও ত্রিপুরা রাজ্যে এবং বাংলাদেশে তার পুজো প্রচলিত। জগন্নাথ হলেন হিন্দু দেবতা বিষ্ণু বা তার অবতার কৃষ্ণের একটি বিশেষ রূপ। তাকে তার দাদা বলরাম ও বোন সুভদ্রার সঙ্গে পুজো করা হয়।
অন্যদিকে, তিরুপতি বা বেঙ্কটেশ্বর মন্দির হল ভারতের অন্ধ্রপ্রদেশ রাজ্যের চিত্তুর জেলার অন্তর্গত তিরুপতির তিরুমালা শৈলশহরে অবস্থিত একটি অন্যতম প্রধান বিষ্ণু মন্দির। এই মন্দিরের প্রধান উপাস্য দেবতা হলেন হিন্দু দেবতা বিষ্ণুর অবতার বেঙ্কটেশ্বর। তিরুমালা বেঙ্কটেশ্বর মন্দির তিরুপতি মন্দির, তিরুমালা মন্দির ও তিরুপতি বালাজি মন্দির নামেও পরিচিত।
হিন্দু বিশ্বাস অনুসারে, কলিযুগের দুঃখ ও যন্ত্রণা থেকে মানব সমাজকে ত্রাণ করতে বিষ্ণু তিরুমালায় ‘বেঙ্কটেশ্বর’ রূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। এই জন্য এই মন্দিরটিকে ‘কলিযুগ বৈকুণ্ঠম্’ বলা হয় এবং বেঙ্কটেশ্বরকে বলা হয় ‘কলিযুগ প্রত্যক্ষ দৈবতম্’ (কলিযুগের প্রত্যক্ষ দেবতা)। বেঙ্কটেশ্বর ‘বালাজি’, ‘গোবিন্দ’ ও ‘শ্রীনিবাস’ নামেও পরিচিত। এই দুই দেবতার নাম ও তাদের সম্পর্কে উইকিপিডিয়া থেকে এমনটাই জানা যায়।
এ থেকে বোঝা যায় দুজনেই ভগবান বিষ্ণুর অবতার। এদের দুজনেরই বর্তমানে ডুবে যাওয়া ইয়েস ব্যাঙ্ক-এ খাতা বা একাউন্ট ছিলো। কিন্তু কি অবাক কান্ড! একজন অর্থাৎ ভেঙ্কটেশ্বর আগেই বুঝেছিলেন যে, ইয়েস ব্যাঙ্ক মোদীজীর হাতে পড়ে ডুবে যাবে, তাই আগে থেকেই সেখানে তার নামে রাখা গচ্ছিত টাকা তুলে নেওয়া হয়।
অন্যদিকে অপরজন অর্থাৎ প্রভু জগন্নাথ মোদীজীর ওপর ভরসা করে নিজ নামে একই ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখা যাবতীয় অর্থ খোয়ালেন।
শাসন ক্ষমতায় বসার পর থেকেই মোদীজীর চেলারা প্রায়শই বলেন, ‘হিন্দুত্ব খাতরেমে’। আজ বোঝা গেল তো, মোদীজীর শাসনে হিন্দুত্ব সত্যিই খাতরেমে!!
প্রতিবেদনে প্রকাশিত বক্তব্য সম্পূর্ণভাবেই লেখকের ব্যক্তিগত। কোনোভাবেই #TheQuiry কর্তৃপক্ষ দায়ী নয়।