তদন্ত কমিটির ফাইলে ধুলো জমে, গাইসালের পর ময়নাগুড়ি এসে যায়!
দ্য কোয়ারি ওয়েবডেস্কঃ ১৯৯৯ সালের ১ আগস্ট, ২০১০ সালের ২৭ মে কিংবা ২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি এই তিনটে দিনের মধ্যে একটির সঙ্গে অপরটির ব্যবধান কমপক্ষে এক দশক সময়টা খুব একটা কম নয়। কিন্তু এই দীর্ঘ ব্যবধান সত্বেও তাদের মধ্যে মিল প্রচুর। এই তিনটে দিনের সঙ্গেই অসংখ্য পরিবারের বুকফাটা আর্তনাদ জড়িয়ে আছে।
১৯৯ সালের ১ আগস্ট উত্তর দিনাজপুরের প্রান্তিক রেল স্টেশন গাইসালে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছিল অবধ-অসম এক্সপ্রেস ও ব্রহ্মপুত্র মেলের মধ্যে। জানা গিয়েছিল রেলের সিগন্যালিং ব্যবস্থায় ‘ছোট্ট’ একটি ভুলের জেরে এই দুর্ঘটনা ঘটে। কিন্তু তার পরিনামে সরকারি হিসেবেই প্রাণ হারান ৩০০ জন। বেসরকারি মতে সংখ্যাটা আরও বেশ কিছুটা বেশি। এই ঘটনার দায়ভার কাঁধে নিয়ে ইস্তফা দিয়েছিলেন তৎকালীন রেলমন্ত্রী নিতীশ কুমার। তৈরি হয়েছিল তদন্ত কমিশন।
২০১০ সালের ২৭ মে ঝাড়গ্রামের সরডিহার রাজবাঁধ এলাকায় মধ্যরাতে হাওড়া থেকে মুম্বইগামী জ্ঞানেশ্বরী এক্সপ্রেসে উল্টোদিক থেকে ছুটে এসে ধাক্কা মারে একটি মালগাড়ি। এবারে অবশ্য যান্ত্রিক ত্রুটি নয়, অভিযোগের আঙুল উঠেছিল মাওবাদীদের দিকে। তারা রেললাইনের ফিস প্লেট খুলে রাখার ফলেই এই দুর্ঘটনা বলে জানা যায়। প্রাণ হারান ১৪৮ জন। এই দুর্ঘটনার কারণ খতিয়ে দেখতে তৈরি হয় আরেকটি তদন্ত কমিশন।
২০২২ সালের ১৩ জানুয়ারি ময়নাগুড়ির দোমহনিতে বিকেল পাঁচটার সময় হয় ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনার মুখে পড়ে আপ বিকানের-গুয়াহাটি এক্সপ্রেস। প্রথমে ট্রেনের লাইনচ্যুতি, ড্রাইভারের এমার্জেন্সি ব্রেক চাপা সহ নানা কারণ শোনা যাচ্ছিল।
কিন্তু শুক্রবার দুর্ঘটনাস্থলে দাঁড়িয়ে রেলমন্ত্রী অশ্বিনী বৈষ্ণব নিজের মুখে জানিয়েছেন ইঞ্জিনে থাকা ট্র্যাকশন মোটোরে গোলযোগ দেখা দেওয়াতেই দুর্ঘটনার মুখে পরে আপ বিকানের-গুয়াহাটি এক্সপ্রেস। মৃতের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত ৯। তবে নিয়ম মেনে এবারেও তৈরি হয়েছে তদন্ত কমিটি।
Covid-19 Restriction Westbengal: মেলা আয়োজনে বেশ কিছু ছাড়, বিধি বাড়ল আরও ১৫ দিন
ভারতবর্ষে রেল দুর্ঘটনার সংখ্যা খুব একটা কম নয়। বরং তা গাঁটে গুনে বলতে গেলে হাতের কড় ফুরিয়ে যাবে তাও গুনে শেষ করা যাবে না! এর আগে এই দেশেই দেখা গিয়েছে নদীর উপরের ব্রিজ দিয়ে যেতে যেতে খোদ রাজধানী এক্সপ্রেসের কামরা টুপুস করে নদীর জলে ডুবে গিয়েছে। যথারীতি তাতেও অসংখ্য মানুষের প্রাণহানি হয়েছিল। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যেকোনও বড় ট্রেন দুর্ঘটনার পরই গালভরা তদন্ত কমিটি তৈরি করে রেলমন্ত্রক। কিন্তু সেই তদন্ত কমিটির রিপোর্ট আদৌ দিল্লির রেল ভবনে জমা পড়ে কিনা সেটা একটা বড়সড় বিস্ময়ের ব্যাপার।
যদি ধরেও নেওয়া যায় যে তদন্ত কমিটির রিপোর্ট যথারীতি যথাসময়ে রেল কর্তাদের হাতে জমা পড়ে, তার পরের প্রশ্নটা হচ্ছে তদন্ত কমিটির রিপোর্টের ভিত্তিতে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়? আদৌ কী কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়? আর যদি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েই থাকে তবে তার পরেও কেন এই ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে? বিশেষ করে আজকের এই উন্নত প্রযুক্তির সময়ে দাঁড়িয়ে খেলনা গাড়ির মতো ট্রেনের বগি দুমড়েমুচড়ে গিয়ে মানুষ প্রাণ হারাবে তা সত্যিই মেনে নেওয়া কঠিন।
ময়নাগুড়িতে যে ট্রেন দুর্ঘটনা ঘটেছে সেখানে আপ বিকানের-গুয়াহাটি এক্সপ্রেসের একটিও কামরা অত্যাধুনিক ইস্পাতের তৈরি ছিল না। অথচ পাঞ্জাবের কাপুরথালায় প্রতিনিয়ত এই অত্যাধুনিক কোচ তৈরি হয়ে চলেছে। রেল বিশেষজ্ঞদের একাংশ জানাচ্ছেন এই ট্রেনের কামরাগুলি যদি অত্যাধুনিক ইস্পাত দিয়ে তৈরি হতো তবে হতাহতের সংখ্যা আরও কম হতো। কিন্তু পুরনো কোচ হওয়ায় দুর্ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই সেগুলি দুমড়ে-মুচড়ে যায়। স্বাভাবিকভাবেই হতাহতের সংখ্যা বেড়েছে।
অতীতের বিভিন্ন দুর্ঘনার পর বারবার বলা হয়েছে উপযুক্ত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে রেল ট্র্যাক ও ট্রেনের ইঞ্জিনগুলির পরিস্থিতি সঠিক থাকে না। তাই দুর্ঘটনা ঘটে। সেইসঙ্গে সিগন্যাল ব্যবস্থাকেও বারবার কাঠগড়ায় তোলা হয়। কিন্তু রেল মন্ত্রকের দাবি অনুযায়ী বর্তমানে সারাদেশের সিগন্যাল ব্যবস্থাই অটোমেটিক হয়ে গিয়েছে। সেখানে এক লাইনে দুটি ট্রেন চলে আসার মতো ব্যাপার নাকি আর কোনভাবেই ঘটবে না।
এমনকি রেললাইন অর্থাৎ রেল ট্র্যাকগুলি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামত করা হয় না বলেও রিপোর্টে বারবার দাবি করা হয়েছে। ময়নাগুড়ির দুর্ঘটনাগ্রস্ত ট্রেনের চালক বা যাত্রীদের অভিজ্ঞতাও সেই কথা বলছে। প্রত্যেকেই জানিয়েছেন যখনই ওই এলাকা দিয়ে ট্রেনে যায় তা তীব্র ঝাঁকুনিতে কেঁপে উঠত।
ট্রেন চালকদের দাবি ওই এলাকায় রেললাইনের অবস্থা বিশেষ ভাল ছিল না। প্রশ্ন হচ্ছে কেন এইরকম গুরুত্বপূর্ণ রেল ট্র্যাকের ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। এর জন্য তো যাত্রীদের কাছ থেকে রেল অর্থ নিয়েই থাকে। তবে কাজ হয় না কেন! আর যদি এই রেললাইনগুলো ঠিকমতো রক্ষণাবেক্ষণ করা সম্ভব না হয় তবে সেখানে কেন ঝুঁকি নিয়ে ট্রেন চালানো হয়?
প্রশ্ন অনেক, উত্তর দেবে কে? আসলে উত্তর দেওয়ার কেউ নেই। কোনও একটা দুর্ঘটনা ঘটলেই সঙ্গে সঙ্গে মৃত ও আহতদের জন্য ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করে দায় সারে সরকার। কিন্তু প্রাণের মূল্য কী ক্ষতিপূরণ দিয়ে মেটানো সম্ভব?
রেলমন্ত্রীরা বিভিন্ন সময়ে লম্বা চওড়া কথা বললেও তাই আজও প্রাণ হাতে নিয়েই ঝুঁকির যাতায়াত করতে হয় সাধারণ যাত্রীদের। তাইতো দুই দশকের বেশি সময় পরেও গাইসালের কথা মনে পড়িয়ে দেয় ময়নাগুড়ির দুর্ঘটনা। আসলে নিজেদের পিঠ বাঁচাতে তৈরি হয় তদন্ত কমিটি। কিন্তু যেখানে সর্ষের মধ্যেই ভূত, সেখানে তদন্ত করে আলাদা করে কীই বা হবে!