তৃণমূলের একসময়ের চাণক্য মুকুলের হল কী? ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে কিন্তু

কাঁচরাপাড়ার কাঁচা ছেলে ক্যাচরা করে বেড়ায়! সামাজিক মাধ্যমে এইরকম কোনও লেখা যদি চোখে পড়ে তবে বিশেষ অবাক হবেন না‌। কারণ কাঁচরাপাড়ার মুকুল রায় এখন যেখানে-সেখানে ছড়িয়ে বেড়াচ্ছেন! কিন্তু সত্যি কী তিনি ছড়াচ্ছেন, নাকি ধুরন্ধর মুকুলের এটাও একটা কৌশল?

১৯৯৮ সাল পর্যন্ত কংগ্রেস করতেন মুকুল রায়। আর পাঁচটা তৃণমূল নেতার যে গল্প আরকি। তবে তখন কাঁচরাপাড়ার সকলে তাঁর নাম জানত কিনা তার নিয়েই সন্দেহ আছে। অবশ্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে ভালোই যোগাযোগ গড়ে তুলেছিলেন।

শোনা যায় কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেস গঠনের জন্য মমতার হয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে যাবতীয় কাগজপত্র তুলেছিলেন তিনি। এমনকি দলের প্রথম প্রস্তাবক হিসেবে মমতা নয়, তাঁর স্বাক্ষর জামা পরে নির্বাচন কমিশনের কাছে।

তবে তৃণমূলের জন্মলগ্ন থেকেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আস্থার পাত্র হয়ে উঠেছিলেন মুকুল রায়। ২০০১ সালে যে নির্বাচনে মমতা ‘হয় এবার, নয় নেভার’ ডাক দিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছিলেন, সেবার ব্যারাকপুর শিল্পাঞ্চলের জগদ্দল কেন্দ্রে মুকুল তৃণমূল প্রার্থী হন। কিন্তু ফরওয়ার্ড ব্লকের হরিপদ বিশ্বাসের কাছে গোহারা হেরে যান। তারপর থেকে দীর্ঘদিন সরাসরি জনগণের দরবারে ‘রায়’ নিতে হাজির হননি তিনি।

অবশ্য ওই পরাজয় মুকুল রায়ের কাছে শাপে বর হয়েছিল। তৃণমূলে রকেট গতিতে তার উত্থান শুরু হয়। ২০০৬ সালে তাঁকে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক করে দেন মমতা। এরপর থেকে দীর্ঘ এক দশক তৃণমূলের সাংগঠনিক রাস পুরোপুরি মুকুলের কব্জায় ছিল। ওই বছরই তিনি প্রথম রাজ্যসভার সাংসদ নির্বাচিত হন।

মুকুল রায়ের রাজনৈতিক জীবনে এই পর্বটি সবচেয়ে আকর্ষণীয়। তিনি রাজ্যসভার সাংসদ হয়ে দেশের অন্যান্য দলের সঙ্গে তৃণমূলের যোগসুত্র স্থাপন করেন। সেইসঙ্গে দলের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার দরুণ যাবতীয় রণকৌশল তৈরির দায়িত্ব তাঁর হাতেই ছেড়ে দিয়েছিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।

নীতি-আদর্শের ধার না ধরা মুকুল নির্বাচনী ময়দানে লাভের গুড়টা বেশ ভালোই চিনে নিতে জানতেন। মূলত তাঁর হাতযশেই একের পর এক নির্বাচনে সাফল্য পেতে শুরু করে তৃণমূল। সেই সময়ই তিনি বঙ্গ রাজনীতির চাণক্য বলে পরিচিত হয়ে ওঠেন।

এর মাঝে ২০১২ সালে মাস ছয়েকের জন্য ভারত সরকারের ক্যাবিনেটে রেলমন্ত্রী হিসেবে জায়গা পেয়েছিলেন মুকুল রায়। দীনেশ ত্রিবেদীকে সরিয়ে তাঁকে রেলমন্ত্রী করাটা অবশ্য তৃণমূলের রাজনৈতিক ইতিহাসে আরেক বড় কাণ্ড।

তবে সারদা ও নারদা কেলেঙ্কারিতে জড়িয়ে পড়ার পর ধীরে ধীরে মমতার সঙ্গে তাঁর দূরত্ব বাড়তে শুরু করে। এক্ষেত্রে একটা বিষয় স্বীকার করতেই হবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু শুরু থেকেই মুকুল রায়ের পাশে ছিলেন। সম্ভবত কেন্দ্রীয় এজেন্সির তদন্তের চাপ বাড়িয়ে মুকুলকে জালে তোলার টার্গেট করেছিল বিজেপি। যার ফলে তৃণমূলের নম্বর টু হ‌ওয়া সত্ত্বেও ২০১৭ সালে বিজেপিতে চলে যান তিনি।

লক্ষ্মীর ভাণ্ডার আসলে মমতার তৈরি মিথ, এতে উন্নয়নের নামগন্ধ নেই!

বিজেপিতেও মুকুল রায়ের শুরুটা ভালই হয়েছিল। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে তাঁর হাতযশেই যে গেরুয়া শিবির রাজ্যে ১৮ টি আসনে জয়ী হয়েছিল তা হলফ করে বলা যায়। তাঁকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছিলেন নরেন্দ্র মোদি-অমিত শাহরা। যদিও দিলীপ ঘোষের মতো সংঘ পরিবার থেকে উঠে আসা বিজেপি নেতারা মুকুলের এই ‘আদর্শবিহীন’ নির্বাচনী রাজনীতি মেনে নিতে চাননি।

স্বাভাবিকভাবেই বঙ্গ বিজেপিতে খুব দ্রুত তাঁকে কেন্দ্র করে ফাটল ধরে। সেই কারণেই বোধহয় ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে মুকুল রায়কে দলের রণকৌশল রচনার দায়িত্ব থেকে সরিয়ে কৃষ্ণনগর উত্তর কেন্দ্রে বেঁধে ফেলা হয়। অবশ্য প্রচার না করেই ৩৫ হাজারের বেশি ভোটে জিতে প্রথমবারের জন্য বিধায়ক হন মুকুল রায়।

তার পরের ঘটনা সকলেরই জানা। বিধানসভা নির্বাচনের ফল বেরোনোর মাত্র এক মাস পর ১৭ জুন সপুত্র তৃণমূলে ফিরে আসেন তিনি। কিন্তু বিধায়ক পদে ইস্তফা না দিয়ে তিনি দলত্যাগ করায় মুকুলের ওপর ব্যাপক ক্ষেপে যায় বিজেপি। বিশেষ করে বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী তাঁর বিধায়ক পদ খারিজ করার জন্য উঠেপড়ে লাগেন।

বিধানসভার অধ্যক্ষ বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়কে এই নিয়ে চিঠিও দেন। এমনকি স্পিকার বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস নয় এই অভিযোগ করে আদালতের দ্বারস্থ‌ও হয়েছে গেরুয়া শিবির। এই পর্যায়ে তৃণমূলে ফিরে আসা মুকুলকে বিধানসভার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান করা নিয়ে আরেকপ্রস্থ নাটক হয়। সাধারণত প্রধান বিরোধী দলের কোনও গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে এই পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটির চেয়ারম্যান করা হয়। আসলে এটাই দীর্ঘদিনের সংসদীয় রীতি।

কিন্তু এর পরের পর্বে অবাক হয়ে দেখা যায় একদা বঙ্গ রাজনীতির ‘চাণক্য’ নামে পরিচিত মুকুল রায় বিচিত্র বিচিত্র সব মন্তব্য করছেন। কখনও তৃণমূলের মঞ্চে বসে বলছেন বিধানসভা উপনির্বাচনে জয়ী হবে বিজেপি! আবার কখনও বিধানসভার সামনে দাঁড়িয়ে বলছেন, তিনি বিজেপিতেই আছেন। আবার কখনও অনুব্রত মণ্ডলের পাশে দাঁড়িয়ে বলে দিচ্ছেন ‘বিজেপি মানেই তৃণমূল’!

এই অবস্থায় মুকুল রায়ের ছেলে শুভ্রাংশু বিবৃতি দিয়ে জানিয়েছেন তাঁর বাবার মানসিক স্থিতি ঠিক নেই। তিনি নাকি ভারসাম্য হারিয়েছে! এমনকি বিধানসভার অধ্যক্ষের শুনানিতে মুকুলের আইনজীবীরা পর্যন্ত জানিয়েছেন তিনি বিজেপিতেই আছেন। মানসিক পরিস্থিতি ঠিক না থাকায় তৃণমূলের দলীয় দফতরে চলে গিয়েছিলেন!

চিকিৎসাশাস্ত্র বলছে কোন‌ও মানুষের শরীরে সোডিয়াম-পটাশিয়ামের ভারসাম্যে গণ্ডগোল হয়ে গেলে সেই ব্যক্তি মাঝেমধ্যেই এরকম ভুলভাল কথা বলতে পারেন, ঠিক যেমনটা হচ্ছে মুকুল রায়ের। মুকুল রায় বিধানসভা ভোটের পরই সস্ত্রীক করোনায় আক্রান্ত হয়েছিলেন। তিনি মারণ ভাইরাসকে হারিয়ে সুস্থ হয়ে উঠলেও স্ত্রী কৃষ্ণা রায়কে ফেরাতে পারেননি।

বস্তুত স্ত্রী হাসপাতালে ভর্তি থাকার সময়ই তিনি তৃণমূলে ফিরে আসেন। চিকিৎসাশাস্ত্র বলছে করোনার ধাক্কায় সাময়িক মস্তিষ্ক বিভ্রাট দেখা দিতে পারে। সেইসঙ্গে ঘনিষ্ঠ কারোর আকস্মিক মৃত্যুর অভিঘাতে কোন‌ও মানুষ ভারসাম্যহীন হয়ে পড়তেই পারেন।

কিন্তু, সত্যিই কি মুকুল রায়ের মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে বলেই তিনি বিভ্রান্তিকর মন্তব্য করে ফেলছেন? সত্যিই কী তিনি বিজেপি ছাড়তে চান না? সেক্ষেত্রে তো স্বাভাবিক সময়ে তাঁর বিজেপির সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা রেখে চলার কথা। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে তিনি তৃণমূলের সঙ্গেই ওঠাবসা করছেন। তবে কী পরিকল্পনা করেই মাঝেমধ্যে বিজেপির হয়ে কথা বলছেন? উদ্দেশ্য গোটাটা গুলিয়ে দেওয়া!

প্রশ্ন কিন্তু থাকছেই। কারণ মানুষটা মুকুল রায়। বাংলার রাজনৈতিক মহলে একটা কথা খুব প্রচলিত, কাঁচরাপাড়ার মুকুল রায় আবেগের ধার ধারেন না। তিনি বুঝেশুনেই এক হাত ওঠান, আরেক হাত নামান!

তবে এটাও কি মমতার সম্মতি নিয়েই মুকুলের আরেক কৌশল? এইভাবেই কী মুকুলকে দিয়ে বিজেপির অভ্যন্তরে ঝগড়া বাঁধিয়ে দিতে চাইছে বাংলার শাসক দল? তাই কী তাঁকে এবার আর রাজ্যসভায় না পাঠিয়ে বাংলায় রেখে দেওয়া হয়েছে? সংশয় সংশয়, স্বয়ং ব্যোমকেশ বক্সিও এই রহস্যের সমাধান করতে পারবেন না!

সম্পর্কিত পোস্ট