আদা-কাঁচকলায় সম্পর্ক ঘুচিয়ে সরকার গঠনে একজোট নীতিশ-মোদি

।। শুভজিৎ চক্রবর্তী ।।

পড়শি রাজ্যের নির্বচানের উত্তাপে গা ঘামাচ্ছে বাংলা। রাজনীতির অঙ্ক কষা শুরু হয়েছে এরাজ্যেও। “আব কি বার, বিহার মেয় কিসকা সরকার”? মহাজোটের তেজস্বী, নাকি এনডিএ পরিবারের নীতিশ? কোন ফর্মুলায় কোন জোট? উত্তর খুঁজছে গোটা দেশ। ইতিহাসের পাতা উলটে দেখে নেওয়া যাক কেমন ছিল নীতিশ-মোদির জুটি।

২০০২ সাল তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী সরকারের কেবিনেট মন্ত্রী ছিলেন নীতিশ। গুজরাটের ঘটনায় গোটা দেশে মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির একটা বিতর্কিত ছবি তৈরি হয়েছিল। গোটা ঘটনার তীব্র নিন্দা করেছিলেন তৎকালীন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী নীতিশ কুমার। এমনিতেই উন্নয়ন এবং ধর্মনিরপেক্ষতার বিচারে অন্যান্য এনডিএ সদস্যের থেকে এগিয়ে রয়েছেন তিনি। তাই সেবার গুজরাটের ঘটনায় মোদির নিন্দা করতে বিন্দুমাত্র পিছপা হননি নীতিশ।

২০০৩ সালে সেই ছবি পাল্টে যায়। গুজরাটের কচে রেলওয়ের একটি কর্মসূচীতে যান তৎকালীন কেন্দ্রীয় রেলমন্ত্রী নীতিশ কুমার। সেবার মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উন্নয়নমূলক কাজের জন্য ভূয়সী প্রশংসা করেন তিনি। নরেন্দ্র মোদির মধ্যে দীর্ঘ সময়ের নেতার হওয়ার পূর্ণ সম্ভাবনা রয়েছে দাবী করেন নীতিশ কুমার। সেইসঙ্গে তিনি এও বলেন, গুজরাটে ব্যাপক উন্নয়ন হলেও ২০০২ সালের ঘটনায় গুজরাটের বাইরে মোদির ইমেজ ব্যাপকভাবে নষ্ট হয়েছে। গুজরাটের ঘটনা যদি আমরা সারাজীবন মনে রাখি সেটা ভালো হবে না। গুজরাটের বিকাশ ঘটলে দেশের বিকাশ ঘটবে দাবী করেন নীতিশ।

২০০৪ সালের নির্বাচনে এনডিএর পতন হয়। ইউপিএর পূর্ণ সমর্থনে প্রধানমন্ত্রী হন মনমোহন সিং। কিন্তু বিহার থেকে দায়িত্ব নিয়ে ১১ জন সাংসদকে দিল্লির টিকিট ধরিয়েছিলেন নীতিশ। এমনই এক সময়ে নীতিশের গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন বিজেপি হাইকম্যান্ড। অটল বিহারী বাজপেয়ী, অরুণ জেটলি এবং লালকৃষ্ণ আদবানীর আরও ঘনিষ্ঠ হতে শুরু করেন নীতিশ। আর নীতিশের সঙ্গে এনডিএ জোটের হাত শক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিয়েছিলেন বিহারের উপমুখ্যমন্ত্রী সুশীল মোদি।

গুজরাটের ঘটনার প্রেক্ষিতে তখনও এনডিএ শিবিরের আধিপত্য কায়েম করতে পারেননি নরেন্দ্র মোদি। শিবিরের মধ্যে ক্রমাগত গুরুত্ব বাড়ছিল নীতিশের। ২০০৫ সালে বিহারের মুজাফরপুরের একটি জনসভায় নীতিশ কুমারকে এনডিএর পদপ্রার্থী ঘোষণা করলেন আদবানী। সেখান থেকেই পাল্টে গেল বিহারের ভবিষ্যত। টানা তিনবার মুখ্যমন্ত্রী পদের জন্য নির্বাচিত হলেন নীতিশ।

২০০৯ মে মাস। লোকসভা নির্বাচনে এনডিএ বনাম ইউপিএ শিবিরের লড়াই তখন তুঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য লালকৃষ্ণ আদবানীকে বেছে নিয়েছে এনডিএ শিবির। এনডিএ শিবিরের সমস্ত মুখ্যমন্ত্রীদের নিয়ে লুধিয়ানায় বিরাট সমাবেশের ডাক দেন আদবানী। উপস্থিত থাকার কথা নরেন্দ্র মোদির। সেদিনের সভামঞ্চে উপস্থিত থাকার জন্য শরদ যাদবকে নির্দেশ দিয়েছিলেন নীতিশ। কিন্তু জেটলি এবং সুশীল মোদি মারফত আদবানী নীতিশকে নির্দেশ দেন নীতিশ যেন স্বয়ং ওই মঞ্চে উপস্থিত থাকেন। বর্ষীয়ান নেতার কথামতো উপস্থিত ছিলেন বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। মঞ্চে উপস্থিত হতেই নরেন্দ্র মোদি আকাশপাণে নীতিশ কুমারের মুষ্টিবদ্ধ ধরে জোটের বার্তা দিলেন।

এরপর ২০১০ সালে পাটনায় দলীয় কর্মসূচীতে আসেন নরেন্দ্র মোদি। সেসময় প্রশাসনিক কাজের জন্য পাটনার বাইরে ছিলেন নীতিশ কুমার। পরের দিন বিজেপির সমস্ত নেতৃত্বদের ডিনারের জন্য আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু সেইদিন সকালে খবরের কাগজ দেখে তাক লেগে যায় নীতিশের। কয়েকটি খবরের কাগজে মোদি এবং নীতিশের মুষ্টিবদ্ধ সেই ছবি এবং সেখানে লেখা বিহারের বন্যা দুর্গতদের জন্য ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ করবে গুজরাট সরকার। সেদিনেই ডিনার বাতিল করেন নীতিশ। এমনকি গুজরাট সরকারকে পরে ৫ কোটি টাকা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।

বদলাচ্ছে জাতীয় রাজনীতির ধরন। ক্ষমতা বাড়িয়ে এবার জাতীয় রাজনীতিতে পা বাড়িয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। দলের গুরুত্ব কমছে আদবানীদের। ২০১৪ সালে এনডিএ শিবিরে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর জন্য উঠে এসেছিল নীতিশ কুমারের নাম। ২০১৩ সালেই এনডিএ শিবিরে চলছিল জোর জল্পনা। তৎকালীন বিজেপির সর্বভারতীয় সভাপতি নীতিন গডকরি ঠিক নীতিশ কুমারকে আশ্বাস দিলেন প্রধানমন্ত্রী পদের জন্য যাকেই বেছে নেওয়া হোক না কেন নীতিশ কুমারকে তিনি জানাবেন। কিন্তু সর্বভারতীয় সভাপতি পদে বসলেন রাজনাথ সিং। আর পাল্লাভারী হল নরেন্দ্র মোদির। ২০১৩ সালের গোয়ার কনভেনশনে প্রধানমন্ত্রী পদপ্রার্থীর জন্য উঠে এল নরেন্দ্র মোদির নাম।

২০১৪ সালে বিহারের ৪০ টি আসনের মধ্যে ৩১ টি আসন পায় নীতিশ কুমারের জনতা দল ইউনাইটেড। কিন্তু এনডিএ শিবির থেকে নিজেকে সরিয়া রাখলেন নীতিশ। ২০১৫ সালে মহাজোটের অংশ হয়ে পেলেন লালু প্রসাদ যাদবের সমর্থন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়া থেকে নীতিশকে আটকানো গেল না। ২০১৭ সালে জোট ছাড়লেন নীতিশ। সময়ের সঙ্গে সদ্ব্যবহার করে এনডিএ শিবিরে নীতিশকে ফিরিয়ে আনলেন সুশীল কুমার মোদি। বদলে পেলেন উপমুখ্যমন্ত্রী পদ। ২০১৯ এর লোকসভা নির্বাচনে ব্যাপক জনমত পেয়ে যখন নরেন্দ্র মোদি দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হলেন, তখন দিল্লির রায়সেনা হিলের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন নীতিশ কুমার।

২০২০ তেও কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদিকে প্রোজেক্ট করলেও এনডিএ শিবিরের মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী নীতিশ কুমার। মুখোমুখি লড়াই দুই যুব নেতা তেজস্বী যাদব এবং চিরাগ পাসোয়ানের বিরুদ্ধে। এবারের নির্বাচনে নীতিশের পায়ের তলার মাটি নড়বড়ে হয়েছে। ফর্মুলায় সরকার গঠন করতে হলে এবার নীতিশের প্রয়োজন হবে বিজেপিকে।

সম্পর্কিত পোস্ট