নবীর অপমান, প্রতিবাদ, বিজেপির অক্সিজেন ও বামেদের অসহায়তা
নয়ন রায়
ইতিহাস বলে খাদ্যের প্রয়োজনে, মূলত কৃষিকাজ শুরু হওয়ার সময় মানুষ প্রথম সচেতনভাবে জোটবদ্ধ হয়েছিল। এরপর ধর্মের মাধ্যমে আরও বৃহত্তর পরিসরে জোট বাঁধে তারা। এমনকি ভাষা-সংস্কৃতিগত ভিন্নতাও এর ফলে সহজে উপেক্ষা করে আজও বারে বারে জোটবদ্ধ হয়ে ওঠে সে।
আবার এই পৃথিবীতে বিজ্ঞানসম্মত জোটের কথা বলে যে মতবাদ সেই কমিউনিজম বা বামপন্থা এই ধর্মের সামনেই সবচেয়ে বেশি অসহায়। সহজ করে বললে ধর্ম প্রধান বিষয় হয়ে উঠলে বামপন্থার বিশেষ কিছু করার থাকে না।
পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি সেই বিষয়টি আরও একবার স্পষ্ট করে দিল। রাজ্যের একটা বড় অংশের মানুষ এই মুহূর্তে ধর্মের ভিত্তিতে দুভাগে বিভক্ত হয়ে গিয়েছে। তাতে বিজেপি, আব্বাস বাহিনীদের অনেক কিছু করার আছে, কিন্তু বামেদের কিচ্ছু করার নেই। সত্যি কিছু করার নেই?
এখানে সবচেয়ে বেশি কিছু করার আছে বামেদের। কিন্তু রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে না থাকায় বা রাজ্যে তেমন একটা প্রভাবশালী না হওয়ায় প্রায় কিছুই করে উঠতে পারছে না তারা। তাদের সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বার্তায় কান দিচ্ছে না কেউ।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটর পদে রাজ্যপালকে সরিয়ে শিক্ষামন্ত্রী, সংশোধনী বিল পাশ বিধানসভায়
ঠিক কী নিয়ে এই অশান্তি?
অতীত অভিজ্ঞতা থেকে হলফ করে বলা যায় যারা যারা এই অশান্তিতে মুখ্য ভূমিকা নিচ্ছেন বা নিয়েছেন তাঁদের একটা বড় অংশ নূপুর শর্মার বক্তব্য শোনেননি। নূপুর নিঃসন্দেহে বিজেপির রাজনৈতিক লাইন মেনে উস্কানি দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। কারণ যে কনটেক্সটে তিনি হজরত মহম্মদ এবং তাঁর স্ত্রী আয়েষার নামে মন্তব্য করেছেন সেটা ওখানে সম্পূর্ণ অপ্রাসঙ্গিক ছিল। আবার হজরত মহম্মদ সম্বন্ধে এই নিয়ে বিতর্ক চিরকালীন। সবচেয়ে বড় কথা কোনও মহামানবকে নিয়ে ভিন্নমত থাকা মানেই তাঁকে অপমান করা নয়।
তারপরও অযাচিতভাবে এই মন্তব্য করে অশান্তিতে উস্কানি দেওয়ায় নূপুর শর্মা, নবীন জিন্দাল ও বিজেপির বিরুদ্ধে ক্ষোভ থাকা স্বাভাবিক। এর জন্য আদালতে মামলা হতে পারে, তাঁদের বিরুদ্ধে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদও হতে পারে। বরং মুসলমান সমাজের নেতারা যদি এই উস্কানিমূলক মন্তব্যের বিষয়টিকে উল্লেখ করে বিজেপি সম্বন্ধে সাধারণ মানুষকে আরও বেশি সচেতন করে দেওয়ার দায়িত্বটা পালন করতেন তাহলে সব দিক দিয়ে ভালো হতো।
আসলে কী হল?
নূপুর শর্মাদের এই উস্কানিমূলক মন্তব্যের প্রতিবাদে প্রথমদিকে মুসলমান সমাজের পাশাপাশি ভারতের বামপন্থী এবং ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার সমস্ত মানুষ বিজেপির সমালোচনায় সরব হয়েছিল। বলেছিল, রাজনৈতিক লাভ-ক্ষতির হিসেব মাথায় রেখে ২৪ এর লোকসভা নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আগেভাগেই ঘুঁটি সাজাতে শুরু করেছে গেরুয়া শিবির।
কিন্তু শেষ ৪-৫ দিনের ঘটনায় পরিস্থিতি পুরো বদলে গেল। মুসলমান সমাজের একাংশের নেতৃত্বে যেভাবে সারা দেশের পাশাপাশি বাংলার বিভিন্ন স্থানে হিংসা হল তাতে বামপন্থীরা তো বটেই, ধর্মনিরপেক্ষ সব মানুষই প্রতিবাদীদের পাশ থেকে সরে এসেছেন।
যে কৃষ্ণ, সেই গৌর,সেই জগন্নাথ ; জগন্নাথের স্নানযাত্রার মাহাত্ম্য়
ভুলটা কোথায় হল?
নূপুর শর্মা উস্কানি দিয়েছেন ঠিকই, কিন্তু তাকে কোনমতেই দাঙ্গা বাধানোর প্রচেষ্টা বলা যায় না। মহান নবী (সাঃ) এর কেউ সমালোচনা করলেই তিনি ছোট হয়ে যাবেন কেন? তাঁর ব্যক্তিত্ব বিপুল। এই দেশে একটা বড় অংশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষ ভগবান রামকে চোখে হারান।
আবার সেই রামচন্দ্রই স্ত্রী সীতার সঙ্গে অন্যায় আচরণ করেছেন বলে অনেকেই সমালোচনা করেন। অবশ্য হজরত মহম্মদ ও শ্রী রামচন্দ্রের মধ্যে বেসিক পার্থক্য আছে। কারণ হজরত মহম্মদ বাস্তবে এই পৃথিবীতে জন্ম নিয়েছিলেন, আর শ্রী রামচন্দ্র পৌরাণিক চরিত্র। কিন্তু এঁদের দুজনকেই দুই সম্প্রদায়ের মানুষ সর্বোচ্চ ঈশ্বরজ্ঞানে শ্রদ্ধা করেন।
শুধু রামচন্দ্র নয়, হিন্দু ধর্মের সর্বোচ্চ দেবতাকে যাঁকে মান্য করা হয় সেই শিবেরও প্রভূত সমালোচনা হয়। অনেক হাসি মজা ঠাট্টা হয় শিব লিঙ্গের উচ্চতা নিয়ে। অনেকেই এর প্রতিবাদে সরব হন। কারণ তাঁদের অনুভুতিতে আঘাত লাগে। তা হতেই পারে। কিন্তু তা বলে এইভাবে রাস্তায় নেমে ত্রাস তৈরি করার ঘটনা সাধারণ চোখে দেখা যায় না। ঠিক এই জায়গাতেই ভুল করে বসেছেন ইসলাম ধর্মের মৌলবি-ইমামরা।
কারণ দেশের বিপুল সংখ্যক সংখ্যাগুরু মানুষ, যারা একইসঙ্গে বিজেপি বিরোধী তাঁরা রাম-শিবের উদাহরণ টেনে এনে এই ঘটনার সঙ্গে তুলনা করছেন। ফলে ধর্মনিরপেক্ষ শিবিরের একটা বড় অংশের মানুষ রীতিমতো বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠেছেন গোটা বিষয়টায়।
ভারতে ব্লাসফেমি অ্যাক্ট নেই। তাই এখানে একজন কেউ ঈশ্বর সম্বন্ধে সমালোচনামূলক মন্তব্য করলে সঙ্গে সঙ্গে তার গর্দান চলে যাবে সেটা হওয়ার কোনও সম্ভাবনা বাস্তবে নেই।
সবচেয়ে বড় কথা কেন কারোর সমালোচনা করা যাবে না? অন্য ধর্মের মানুষ হজরত মহম্মদকে অপমান করতে পারেন না এটা যেমন ঠিক, তেমনই তাঁর প্রতি একজন সাচ্চা মুসলমানের মতো সমান বিগলিত থাকবেন এটা আশা করা বাড়াবাড়ি। এই অদ্ভুত এবং যুক্তিহীন আচরণের ফলে মানুষের মনে ইসলামফোবিয়া আরও বেড়ে গেল। বলা হল বাড়িয়ে তোলার সুযোগ পেয়ে গেল বিজেপি।
এতে বিজেপির লাভ কোথায়?
অতীত অভিজ্ঞতা বলছে বিতর্কিত মন্তব্যের জেরে নূপুর শর্মা, নবীন জিন্দালদের বহিষ্কার করাটা বিজেপির স্রেফ আই ওয়াশ। বছরখানেক পর এরা ঠিক গেরুয়া শিবিরে বড় জায়গা করে নেবেন। বিজেপি চেয়েছিল এমন একটা কিছু হোক যেখানে মুসলমান অত্যাচারের জুজু দেখিয়ে সংখ্যাগুরু হিন্দু ভোট যতটা বেশি সম্ভব নিজেদের দিকে টেনে আনা।
এদেশে আজও বহু হিন্দু ধর্মের মানুষ আছেন যাঁরা নিয়মিত ধর্মাচরণ করেন। কিন্তু বিজেপিকে পছন্দ করেন না। তাঁরা ধর্মের সঙ্গে রাজনীতিকে মেশাতে চান না। তাঁদের কাছে বিজেপি পরিত্যাজ্য। কিন্তু যা ঘটল তাতে এই মানুষগুলোকেও ভুল বোঝানোর সুযোগ পেয়ে গেল বিজেপি।
এটা বিজেপির পক্ষে খুব জরুরি ছিল। দেশের বেহাল অর্থনীতি, কর্মসংস্থানের অভাব, ভয়াবহ মূল্যবৃদ্ধি, মানুষের খেতে না পাওয়ার নিত্যনৈমিত্তিক জ্বালা-যন্ত্রণায় বিধ্বস্ত সাধারণ মানুষ ক্রমশ বিজেপির দিক থেকে সরে আসছিল। এই অবস্থায় একমাত্র ধর্মই পারে বিজেপিকে ২৪ এর লোকসভা নির্বাচনে জেতাতে। ফলে চূড়ান্ত সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ প্রয়োজন ছিল বিজেপির পক্ষে। আর সাম্প্রতিক বিতর্ঔকের জেবেল সেটাই পরিষ্কারভাবে হয়ে গেল।
বিজেপির আমলে দেশের সংখ্যালঘুরা, বিশেষ করে মুসলমানরা অত্যাচারিত নিপীড়িত কোণঠাসা হয়ে আছে সেটা জানা কথা। এর থেকে মুক্তি পেতে হলে, সবার সমান অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হলে সবার আগে বিজেপিকে কেন্দ্রের ক্ষমতা থেকে সরানো দরকার।
তার জন্য ধর্মনিরপেক্ষ শক্তির হাত শক্ত করা প্রয়োজন ছিল সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের। ভারতের জনসংখ্যার হিসেব বলছে সারা দেশে মুসলমানের সংখ্যা মেরেকেটে ১৬ শতাংশ। অপরদিকে হিন্দুদের সংখ্যা প্রায় ৮০ শতাংশের কাছাকাছি। এই হিসাবটাকেই কাজে লাগাতে চায় বিজেপি।
এদিকে সংখ্যালঘুরা সবচেয়ে বেশি নিরাপদে থাকতে পারে কেন্দ্রের ক্ষমতায় ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি থাকলে। কিন্তু তারা পাল্টা সাম্প্রদায়িক পথে হাঁটলে সুবিধাটা বিজেপির হয়ে যায়। এই সহজ হিসেবটা সংখ্যালঘু ধর্মীয় নেতারা যদি না বোঝেন তবে বিপদ বাড়তেই থাকবে।
অনেকেই আক্ষেপ করে প্রশ্ন করছেন, কেন এই সময়ে সংখ্যালঘুদের পাশে গিয়ে দাঁড়াল না বামপন্থীরা? প্রশ্ন হচ্ছে তারা কী করে পাশে এসে দাঁড়াবে? বামপন্থীদের আদর্শ কোনরকম ধর্মীয় মৌলবাদকে প্রশ্রয় দেয় না তারা যেমন সংখ্যাগুরু মৌলবাদের তীব্র বিরোধী, তেমনই সংখ্যালঘু মৌলবাদেরও সমান বিরোধী। ফলে দুই তরফেই মৌলবাদী শক্তির উত্থানের জেরে বামেরা কোণঠাসা হয়ে পড়ে, কোণঠাসা হয় দেশের ধর্মনিরপেক্ষ শক্তি।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাধারণ মানুষ আবেগের বশে কিছু করে বসতেই পারে। কিন্তু তাদের নেতারা সত্যি কী এই সহজ বিষয়টাই বোঝেন না? এটা কিন্তু বিশ্বাস করা কঠিন। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটা মন্তব্যের সূত্র ধরেই প্রশ্ন উঠছে এর পিছনে আরও বড় খেলা নেই তো? এটা ইচ্ছা করে বিজেপির পক্ষ থেকে ঘটানো হয়নি তো? এমন অভিযোগ কিন্তু বিভিন্ন মহল থেকে উঠতে শুরু করেছে।
আসলে আসাদুদ্দিন ওয়াইসিরা না থাকলে বিজেপির অস্তিত্ব ভালোভাবে টিকে থাকে না। তেমনই বিজেপির অস্তিত্বের উপর আসাদুদ্দিন ওয়াইসিদের অস্তিত্ব নির্ভর করে। ফলে বিষয়টা এমনও হতে পারে দুই মৌলবাদী শক্তি বোঝাপড়া করেই এইভাবে চূড়ান্ত মেরুকরণ করতে চাইছে! দয়া করে সাবধান হোন।