কংগ্রেসের ভরাডুবীর জন্য দায়ী শুধুমাত্র বাংলার নেতৃত্ব?

।। শুভজিৎ চক্রবর্তী ।। 

বাংলায় কংগ্রেসের সলতে নেভানোর পিছনে দায়ী কে? রবিবারের নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর এই প্রশ্ন ঘুরে বেড়াচ্ছে জাতীয় রাজনীতিতে। যদিও বিগত কয়েক রাজ্যের নির্বাচনী ফলাফলের দিকে তাকালে দেখা যাবে অন্যান্য রাজ্যতেও কংগ্রেসের পিলার ভেঙে পড়েছে। ২০১৯ এর নির্বাচনের পর ঝাড়খণ্ডে হাতে গোনা কয়েকটি আসন জিতেছিল তাঁরা। বিহারে মহাজোটের ক্ষমতা থেকে বিচ্যুত হওয়ার জন্য অনেকে মনে করছেন কংগ্রেসের অস্তমিত হওয়া।

তবে এই প্রথম বাংলায় কংগ্রেস এবং বামেরা থাকছেন না বিধানসভায়। এবার ভার কার ওপর বর্তাবে? প্রদেশ কংগ্রেসের প্রথম সারীর নেতাদের ওপর? নাকি একা অধীর রঞ্জন চৌধুরী? নীচু তলার কর্মীদের কথায়, গতবারের বিধানসভা নির্বাচনে যে সমস্ত কংগ্রেস বিধায়করা জয়লাভ করেছিলেন, তাঁরা পরে অনেকেই বিজেপি নয়তো তৃণমূলে চলে যান। সেখানেই আলগা হয়ে পড়ে সংগঠন। তবুও ১৯ এর নির্বাচনে বাম-কংগ্রেসের জোটের ওপর ভরসা রেখেছিলেন কর্মীরা। কিন্তু তা ভেস্তে গিয়েছিল। ২১ নির্বাচনে একেবারে শুরু থেকে আলোচনা করেই এগোতে থাকা জোটের বার্তা যতটা পজিটিভ এনার্জি দিচ্ছিল, জোটের মধ্যে ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্টের এন্ট্রি সেই ভীত আরও নড়বড়ে করে তোলে।

২১ নির্বাচনের আগে ব্রিগেডের ময়দানে মানুষের ভিড় দেখে অনেকেই ভোটের অঙ্ক মেলাতে শুরু করেছিলেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের ধারণা ছিল, ভিড়ের কিছু অংশ ভোটব্যাঙ্কে গেলে ২০ থেকে ২৫ টি আসন পেতে পারেন সংযুক্ত মোর্চা। কিন্তু একটি মাত্র আসন পেল তাঁরা। এমনকি কংগ্রেসের গড় মালদহ মুর্শিদাবাদ রক্ষা করতে পারলেন না স্বয়ং অধীর রঞ্জন চৌধুরী, দীপা দাশমুন্সীরা।

কংগ্রেসের এই বেহাল অবস্থার জন্য প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতিকেই দুষতে শুরু করেছেন দলীয় কর্মীরা। কংগ্রেসের একাংশের মতে প্রাক্তন প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি সোমেন মিত্রের সঙ্গে দলের নীচুতলার কর্মীদের যতটা যোগাযোগ ছিল ‘দিল্লির নেতা’ অধীর চৌধুরীর সঙ্গে ততটা যোগ ছিল না। সমস্যা আরও প্রকট হতে শুরু করে যখন জোটের পক্ষে সায় না দিয়ে নিজের মতো করে দল পরিচালনা করতে শুরু করলেন তিনি। ছাতা ছাড়াই বাম এবং আইএসএফের সঙ্গে জোটের বৈঠকে বসতে দেখা গিয়েছিল প্রদীপ ভট্টাচার্য এবং আবদুল মান্নানদের। জোটের মধ্যে থেকেও একে অপরের দিকে কাদা ছুঁড়েছিলেন আব্বাস এবং অধীর। মুর্শিদাবাদে আইএসএফ এবং বামদের সঙ্গে কংগ্রেসের ‘বন্ধুত্বপূর্ণ’ লড়াই দেখে অনেকেই বলেছিলেন এই জোটের বাঁধন আলগা হতে শুরু করেছে।

সমস্যা আরও বাড়তে শুরু করে। কংগ্রেসের একাংশের কথায়, টাকার অভাবে অনেক জায়গায় প্রচারের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। প্রচারে বেরিয়ে অনেক সময় অস্বস্তিতে পড়তে হয়েছে দলীয় কর্মীদেরকে। ভার্চুয়ালি প্রচারের পাশাপাশি জনসংযোগেও ব্যর্থ হয়েছে দল।

তবে এই দায় শুধুমাত্র অধির রঞ্জন চৌধুরীর ওপর একার? তা কখনই মেনে নিচ্ছেন না কংগ্রেস কর্মীরা। অনেকেই বলছেন, বাংলায় প্রচারের জন্য দিল্লির প্রথম সারীর লম্বা তালিকা তৈরি করেছিল কংগ্রেস। প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় দফার নির্বাচনের পর একে একে সকলের আসার কথা ছিল। কিন্তু একা রাহুল গান্ধী ছাড়া আর কাউকেই দেখা যায়নি। কোভিডের কারণে আসতে পারেননি প্রিয়াঙ্কা গান্ধী, শচীন পাইলট এবং পি চিদম্বরম সহ প্রথম সারীর নেতারা। জীতিন প্রসাদ কোভিড আক্রান্ত হওয়ার পর একে একে প্রচার বাতিল করেন সকলেই। অন্যদিকে, কোভিডের মধ্যে শেষ মুহুর্ত অবধি প্রচার চালিয়ে গিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি, জেপি নাড্ডা, যোগী আদিত্যনাথ, অমিত শাহ, রাজনাথ সিং সহ গেরুয়া শিবিরের নেতারা।

রবিবার নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর অধীর রঞ্জন চৌধুরী বললেন, মানুষের কাছে তাঁরা বোঝাতে পারেননি একমাত্র তাঁরাই সারা দেশে লড়াই করছেন বিজেপির বিরুদ্ধে। কিন্তু হিসাবে লোকসভায় মাত্র ৫২ টি আসন রয়েছে কংগ্রেসের। লোকসভায় বিজেপির বিরুদ্ধে বেশী ঝাঁঝালো বক্তব্য রাখতে দেখা গিয়েছে তৃণমূলের নেতাদের। তাই মানুষ তাঁদের ওপরেই ভরসা করাটাই স্বাভাবিক বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। সেইসঙ্গে সিএএ, এনআরসি এবং এনপিআরের বিরুদ্ধে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আন্দোলনের ছবি আন্তর্জাতিক মহলে যেমন আলোচনা হয়েছে, তেমন প্রভাব পড়েছে ভোটব্যাঙ্কেও। এখানেই পিছিয়ে পড়েছে কংগ্রেস। যার ফলেই নীভু নীভু হয়ে জ্বলতে থাকা কংগ্রেসের প্রদীপের সলতে সরিয়ে নিয়েছে সাধারণ মানুষ।

সম্পর্কিত পোস্ট