জ্যোৎস্নাভরা আকাশের তলায় প্রতিবাদে গর্জে উঠছে পার্ক সার্কাস
“আমাদের এখানে কোনও রাজনৈতিক পতাকা নেই, আমরা শুধু মাত্র জাতীয় পতাকাকে সামনে রেখে এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি”
শুভজিৎ চক্রবর্তী
রাত যতই বাড়ছে, ততই তাপমাত্রা ক্রমশ কমতে শুরু করছে। কিন্তু তাতেও কিছু আসে বা যায় না। কারণ ৭ তারিখ থেকে একটানা আন্দোলনে বসে রয়েছেন তাঁরা।
কলকাতা শহরে একসময় ৮ ডিগ্রির তাপমাত্রা তাঁদের প্রতিবাদী আন্দোলনের আগুনকে নেভাতে পারেনি।
বরং আগের থেকে সংখ্যা ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছে। নিজেদের ঘরের কাজ গুছিয়ে একবার হলেও প্রতিদিন অবস্থানে শামিল হতেই হবে।
প্রতিবাদে গর্জে উঠছে পার্ক সার্কাস
দিল্লির শাহিনবাগের ঘটনা নয়, এটা কলকাতা শহরের পার্ক সার্কাস। দেশজুড়ে যখন নাগরিকত্ব আইনের প্রতিবাদে সারা দেশের মানুষ একজোট হয়েছে, তখনই তাঁদের পাশে আন্দোলনে নেমেছেন মহিলারা।
নির্দিষ্ট কোনও ধর্ম নয়, বরং সকল ধর্মের সকল মানুষের জন্য তাঁদের এই আন্দোলন।
এমনটাই শোনা গেল প্রায় এক হাজারের বেশী আন্দোলনরত মহিলাদের গলাতে।
“আমাদের এখানে কোনও রাজনৈতিক পতাকা নেই, আমরা শুধু মাত্র জাতীয় পতাকাকে সামনে রেখে এই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি”।
কেউ এসেছেন নিজের বাচ্ছাকে সঙ্গে নিয়ে। আন্দোলনে বসে থেকেই দুধের শিশুর মুখে অন্ন তুলে দিচ্ছেন মায়েরা। সঙ্গে চলছে আজাদি শ্লোগান।
বুকের শিশুকে কোলে নিয়ে গলা ফাটানো আর্তনাদ যেন প্রমাণ করে দিচ্ছে এই লড়াই তাঁদের লড়াই নয়, তাঁদের পরবর্তী প্রজন্মকে টিকিয়ে রাখার লড়াই।
আরও পড়ুন : চেনা ছন্দে এনআরসির প্রতিবাদে শহর কাঁপালেন মমতা
কথায় আছে সমাজে মহিলাদের সহনশীল ক্ষমতা সব থেকে বেশী। তারই পরিচয় দিচ্ছেন রাতের পর রাত ধরে আন্দোলনরত মহিলারা।
কোনও রাজনৈতিক উদ্দেশ্য নয়, পরবর্তী প্রজন্ম যাতে দুধে ভাতে থাকতে পারে তাঁর জন্যই তাঁদের এই আন্দোলন।
“সিএএ তুলে না নেওয়া অবধি তাঁদের এই আন্দোলন চলবে”
সাফ জানিয়ে দিচ্ছে পার্ক সার্কাস ময়দানের প্রায় হাজারের বেশী গলার স্বর। আগামী ২২ তারিখ সুপ্রিম কোর্ট কি রায় দেয় তার দিকে তাকিয়ে এই মহিলারা। “যদি রায় আমাদের পক্ষে হয় তাহলে এখান থেকে মিষ্টি খেয়ে এবং খাইয়ে যাবো। রায় আমাদের পক্ষে না হলে এই আন্দোলন চলবে”, জানাচ্ছেন মহিলারা।
মহিলাদের এই আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে তাঁদের সঙ্গে দেখা করেছেন বহু রাজনৈতিক ব্যাক্তিত্ব।
কিছুদিন আগেই তাঁদের সঙ্গে দেখা করে গেছেন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরম।
মুখ্যমন্ত্রীর সহযোগিতায় আন্দোলনরত মহিলাদের জন্য খাবার, বায়ো টয়লেট এবং টেন্টের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
“সকাল বেলা একবার এসেছিলাম, তারপর বাড়ির কাজ সেরে সবার জন্য খাবার তৈরি করে আবার এসেছি বাকি সবার পাশে দাঁড়াতে”।
প্রতিবাদে গর্জে উঠছে পার্ক সার্কাস আন্দোলনে সামিল সমাজের সর্বস্তরের মানুষ
মহিলাদের আন্দোলন দেখে উপস্থিত হয়েছেন প্রায় হাজারের বেশী পুরুষরাও। মহিলাদের নেতৃত্বে শ্লোগান দিচ্ছেন তাঁরাও।
দু হাত জড়ো করে নিজ নিজ ধর্মের উদ্দেশ্যে প্রার্থনা করে চলেছেন সকলেই। যে হাতগুলো এতদিন ধরে নিজের পরিবার সামলে এসেছে আজ সেই হাত গুলোই প্রতিবাদে মুষ্ঠিবদ্ধ হয়েছে।
আরও পড়ুন : কিছুক্ষণের মধ্যে কলকাতায় প্রধানমন্ত্রী, শহরজুড়ে বিক্ষোভে পড়ুয়ারা
“আমাদের পেটে ভাত জুটছে না, দেশে চাকরী নেই সেইসব থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিতে মোদি সরকার এই সব আন্দোলন করে চলেছেন”। বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন এক মহিলা ।
মাথার ওপর খোলা আকাশকে সাক্ষী রেখে চলছে গান্ধী, আম্বেদকর এবং নেতাজির নামের শ্লোগান চলছে গোটা পার্ক সার্কাস ময়াদান জুড়ে।
এই মহিলাদের কাছে তাঁরাই আদর্শ। রোজ সংবিধানের প্রস্তাবনা পাঠ জানিয়ে দিচ্ছে তাঁদের এই আন্দোলন কিসের জন্য।
শুধুমাত্র শাহিনবাগ এবং পার্ক সার্কাস নয়, ভারতের প্রতিটি প্রান্তে মহিলাদের আন্দোলন প্রমাণ করছে কোনও রাজনৈতিক দলের হয়ে লড়াই না করেও নিজেদের অধিকারের জন্য লড়াই সম্ভব।
অবাক করা বিষয় সকলেই বলছেন, “গুলদস্তা হেয় হামারা ভারত, ইসকো মাত তোরো”।
জ্যোৎস্নাভরা আকাশের নীচে উড়ছে জাতীয় পতাকা। মহিলাদের গর্জনে কেঁপে উঠছে ব্যস্ত কলকাতা।
বহুত্ববাদের ভারতবর্ষে সহনশীল মহিলাদের এই আন্দোলনকে কুর্নিশ জানাচ্ছে গোটা দেশ।