নাগরিকত্ব ইস্যুতেও রায় দিয়েছে মানুষ
।। শুভজিৎ চক্রবর্তী ।।
‘নাগরিকত্ব’ শুধুমাত্র একটি শব্দ হলেও এটি একটি ধারণা। একটা সময়ে মানুষ শুধুমাত্র একটি রাষ্ট্র সীমার নাগরিকত্ব পেত। একজন ব্যক্তি একটি রাষ্ট্রের নাগরিক যেমন হতে পারে, তেমনই একাধিক রাষ্ট্রের নাগরিকও হতে পারে। আর ‘নাগরিকত্ব’ শব্দের সঙ্গে সেই রাষ্ট্রের কিছু কর্তব্য এবং নাগরিকের অধিকার যুক্ত থাকবে। সেটা সাংবিধানিকভাবেই অর্জন করা সম্ভব। আমাদের দেশেও ১৯৫০ সালে নাগরিকত্ব আইন লাগু করা হয়েছিল। তাঁর ফলে জন্মসূত্রে যে কেউ নাগরিকত্ব পেতে পারত। কিন্তু সেই আইনে একাধিক সংশোধন নিয়ে ক্রমাগত জটিলতা বাড়তে শুরু করে। এমনকি ভোটের বাজারে ব্যাপকভাবে চর্চা হয়েছে এই আইনকে নিয়ে।
ইতিহাস অনুযায়ী, অন্যান্য দেশ থেকে ধার্মিক প্রতারণার শিকার হয়ে মানুষকে এদেশে আসতে হয়েছে। ১২ শতকে ইরান থেকে পারসীরা আসে। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পাকিস্তান থেকে কিছু মানুষ এদেশে আসেন এবং কিছু মানুষ এদেশ থেকে পাকিস্তানে চলে যান। ১৯৫৯ সালে চিন তিব্বত দখল করলে প্রচুর মানুষ ভারতে চলে আসেন। ১৯৭৯ সালে সোভিয়েত যুদ্ধের সময় প্রচুর মানুষ আফগানিস্তান থেকে ভারতে আসেন। ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ অবধি দীর্ঘ সময় ধরে শ্রীলঙ্কার মধ্যে তামিলদের নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়। যার কারণে অনেকেই ভারতে চলে আসেন। সম্প্রতি আমাদের দেশে রোহিঙ্গা সমস্যাও আমাদের মধ্যে প্রকট হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এই মুহুর্তে দাঁড়িয়ে অসমের এনআরসি ইস্যুতে রণক্ষেত্র অসমের ছবি আমরা সকলেই দেখেছি। যা ফলে সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের বীজ বপনের পরেই দেশের একাধিক জায়গায় বিরাট আন্দোলনে ছবি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। শাহিনবাগ থেকে পার্ক সার্কাস, মহিলাদের আন্দোলন নিয়ে আলোচনা যেমন হয়েছে তেমনি সরকারের সমালোচনাও হয়েছে চুড়ান্ত। কিন্তু অসম থেকেই কেন শুরু হয়েছিল নাগরিকপঞ্জির কাজ? কেনই বা তার বিরোধিতা?
অসমের ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে ‘অভিবাসী’ বিরোধী, ‘অনুপ্রবেশকারী’ বিরোধী এবং বাঙালী বিরোধী আন্দোলনের কথা। ১৮২৬ সালে অসম ব্রিটিশ অধিকারে আসার পর থেকেই সেখানে একাধিক অঞ্চলের মানুষের আনাগোনা বাড়তে শুরু করে। তাঁদের মধ্যে বেশীরভাগ ছিলেন হিন্দু। পরবর্তীকালে চা বাগানের কাজের জন্য মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের উপস্থিতি বাড়তে শুরু করে। আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে অসমে জনসমাগম বাড়তে শুরু করে। পরবর্তীকালে নিজেদের শাসনকাজের সুবিধার্থে একাধিক অঞ্চলকে অসমের অন্তর্ভুক্তি করে ইংরেজরা। ভারতের প্রশাসনিক সহ অন্যান্য পদে কাজের জন্য অন্যান্য রাজ্য থেকে আসতে শুরু করেন। একইসঙ্গে চা বাগানে কাজের জন্য অন্যান্য প্রদেশ থেকেও কর্মচারীরা অসমে আসতে থাকেন।
বাইরে থেকে আসা বাঙালী মুসলমানরা পরে অসমের কৃষিতে ব্যাপক উন্নতি আনতে শুরু করল। কৃষকদের চাষ করা উদ্বৃত্ত ফসল রাজ্যের একাধিক জায়গায় পৌঁছে যাচ্ছিল। অসমের বাইরেও অন্য অঞ্চলে খাদ্য এবং অর্থকরী ফসল রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছিল। একদিকে চা শিল্পের প্রসার, অন্যদিকে কৃষির অগ্রগতি এই দুয়ের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সম্পদশালী রাজ্য হয়ে উঠতে শুরু করল অসম। তৎকালীন সংবাদমাধ্যমেও প্রকাশ হয়, অসমের অব্যবহৃত অনাবাদি জমিকে উর্বর করেছে ‘বিদেশী’ রাই। যার ফলে সরকারের সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধি পেয়েছে।
ধীরে ধীরে অসমের অসমীয়া এবং বাঙালী বিরোধী ভীত আরও মজবুত হতে শুরু করে। অসমের জনজাতির কাছে তা আতঙ্কের বিষয় হয়ে ওঠে। ১৮৭৪ সালে রাজস্ব বৃদ্ধির জন্য সিলেট, কাছাড় এবং গোয়ালপাড়া যুক্ত হয় অসমের সঙ্গে। তিন জেলাতেই বাংলা ভাষাভাষী মানুষের বাসস্থান। ১৯৪৭ সালে সিলেট পুর্ব পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হয়। ফলে সংখ্যার দিকে থেকে বাঙালী মুসলিম প্রতিনিধির সংখ্যা কম হয়। এরপর ১৯৫০ এর দাঙ্গায় প্রচুর মুসলমান পুর্ব পাকিস্তানে চলে যেতে বাধ্য হন। একইসঙ্গে পুর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দুরা পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা এবং অসমে আসতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে নেহেরু-লিয়াকত চুক্তির কারণে তাঁরা আবার দেশে ফিরে আসেন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় প্রায় তিন লক্ষ মানুষ পুর্ব পাকিস্তান থেকে অসমে আসেন পরবর্তীকালে তাঁরা আর ফিরে যাননি।
ক্রমশ…